পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর ৫ টি সাবমেরিন1 min read
Reading Time: 5 minutesগত কয়েক দশক ধরে গোপনে সমুদ্রের তলদেশে বিশ্বের নানা দেশের ডুবোজাহাজগুলো পাহারা দিয়ে যাচ্ছে নিজ নিজ দেশকে। এরা এসএসএন (SSN) বা নিউক্লিয়ার অস্ত্র সম্বলিত যুদ্ধ ডুবোজাহাজ হিসেবে পরিচিত। এদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, এরা অস্ত্র বোঝাই থাকে এবং সেই সাথে ৬০ কিলোমিটার দূর থেকেই টর্পেডো ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে। ৩০০-৫০০ কিলোমিটার দূর থেকে এন্টি শিপ মিসাইল ব্যবহার করে জাহাজ এবং ডুবোজাহাজ ধ্বংস করতে পারে এই ডুবোজাহাজগুলো। তাছাড়াও এরা ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করে ১০০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্য ভেদ করতে পারে। অবশ্য এত এত সব অস্ত্রপাতি বোঝাই হলেও এদের আসল কাজ শত্রু শিবিরের এসএসএন গুলোকে নাস্তানাবুদ করা।
ইউএস এক্সপার্টসরা বিশ্বের পাঁচটি ভয়ংকর যুদ্ধ ডুবোজাহাজ বা এট্যাক সাবমেরিনের লিস্ট করেছে যা মার্কিন ম্যাগাজিন দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট এ প্রকাশিত হয়েছিল। আজকের এই লেখায় সেই পাঁচটি ডুবোজাহাজের সম্পর্কে জানবো।
সি উল্ফ ক্লাস (Seawolf class)
শুরু করা যাক সি উল্ফ দিয়ে। এই সাবমেরিনটি আসলে সোভিয়েত এট্যাক সাবমেরিন আকুলা (Akula) এবং সিয়েরা (Sierra) কে প্রতিহত করতে বানানো হয়েছিল। এর গতি ৩৫ নট বা ৬৫ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা এবং সর্বোচ্চ ৪০০ মিটার পর্যন্ত ডুবতে পারে। অন্যান্য পুরাতন সাবমেরিনগুলো যে সমস্যায় ভুগত তা হল রাশিয়ান সাবমেরিনের মত বেশি গভীরতায় ডুবতে পারত না। সি উলফ সেই সমস্যার অনেকটাই প্রতিকার করেছে।
এটি হচ্ছে প্রথম আমেরিকান সাবমেরিন যাতে পাম্প জেট ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে এই সাবমেরিনের আওয়াজ খুবই কমে যায়। এই পাম্প জেট মৃদু শব্দের সাথে উচ্চ গতি সৃষ্টি করতে পারে।
এই অত্যাধুনিক সাবমেরিনে রয়েছে বিএসওয়াই-২ সোনার টার্গেটিং স্যুইট- যা যে কোন সোর্স থেকে তথ্য নিয়ে আসতে পারে। অস্ত্রপাতির দিক থেকে বলতে গেলে এই সাবমেরিন প্রায় ৫০ ধরণের অস্ত্র বহন করে। এর অস্ত্রগুলো ৮x৬৫০ মিমি টর্পেডো টিউব ব্যবহার করে ছোড়া হয়। এতে অবশ্য ভিএলএস নেই, যা এই লেখায় উল্লেখিত অন্য তিনটি সাবমেরিনের আছে। যার ফলে টর্পেডো দিয়ে লোড করে অস্ত্র চালনা বেশ ধীরগতির আর সময়ও লাগে অনেক।
যদিও এটি অত্যন্ত আধুনিক এবং চমৎকার একটি সাবমেরিন, যাকে বলা যায় স্টেট অব দি আর্ট, কিন্তু তারপরো প্রায় ১৪০ জনেরও বেশি ক্রু প্রয়োজন হয়, যা রাশিয়ান এবং ব্রিটিশ সাবমেরিনগুলো থেকে অনেক বেশি। সি উল্ফের খরচ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার পার ইউনিট।
ভার্জিনিয়া ক্লাস (Virginia class)
এই সাবমেরিনটি আসলে লস এঞ্জেলস ক্লাস সাবমেরিনকে সামান্য পরিবর্তন আর পরিবর্ধন করে তৈরি করা হয়েছে। যদিও মানের দিক থেকে ভার্জিনিয়া কোন মতেই সি উল্ফের সমকক্ষ নয় তবুও এটি বিশ্বের ভয়ংকর ৫ টি সাবমেরিনের তালিকায় থাকবে।
ভার্জিনিয়ার সর্বোচ্চ গতি ২৫ নট এবং এটি সর্বোচ্চ ২৫০ মি ডুবতে পারে। এখানেই ভার্জিনিয়ার কমতি। এর পূর্বসূরির মত এতেও রয়েছে পাম্প জেট যা এর শব্দকে কমিয়ে এনেছে।
এটিতে ৬ টু স্ফেরিকাল বো সোনার, ২ টি টোড সোনার রয়েছে। সাথে রয়েছে সোনার টার্গেটিং সিস্টেম যা যে কোন সোর্স থেকে তথ্য আনতে সক্ষম।
ভার্জিনিয়াতে রয়েছে ২৭ টি অস্ত্রাদি যা জাহাজে অবস্থিত ৪ টি টর্পেডো টিউব এবং ১২ টি ভিএলএস টিউব দিয়ে ছোড়া হয়। আগেই বলেছি, এই ভিএলএস টিউব বা ভার্টিকাল লঞ্চিং সিস্টেম না থাকায় সি উল্ফের মিসাইল ছোড়ার গতি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু সেদিক থেকে এগিয়ে রয়েছে ভার্জিনিয়া। যার ফলে ভার্জিনিয়া অত্যন্ত দ্রুত মিসাইল ছুড়তে পারে।
ভার্জিনিয়া ক্লাসে বেশ বড়সর ক্রু প্রয়োজন, প্রায় ১৩০ জনেরও বেশি। এর খরচ প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার পার ইউনিট।
এস্টুট ক্লাস (Astute class)
ব্রিটিশ রয়াল নেভির এই সাবমেরিনের সর্বোচ্চ গতি ২৯ নট! কেন? কারণ এর ডিজাইনের সমস্যা। এর রিয়েক্টর আর টার্বাইন নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করতে পারে না। ফলে সর্বোচ্চ গতি ২৯ নটের বেশি হয় না। এটি ৩০০ মিটার পর্যন্ত ডুবতে পারে যা সি উল্ফের চেয়ে কম হলেও ভার্জিনিয়ার চেয়ে বেশি।
আগেরগুলোর মতই জেট পাম্প থাকায় শব্দের তীব্রতা একেবারেই নেই বললেই চলে। এইখানে একটি মজার তথ্য জানিয়ে রাখি। জেট পাম্প ব্যবহার করে শব্দের তীব্রতা কমানোর আইডিয়া কিন্তু ব্রিটিশদের। তারাই প্রথম জেট পাম্প ব্যবহার করে।
এতে রয়েছে সর্বমোট ৩৮ টি অস্ত্র যা ৫৩৩ মিমি ক্যালিবারের ৬ টি টর্পেডো দিয়ে ছোড়া যায়। এস্টুটের অস্ত্র ধারণ ক্ষমতা কম হলেও এন্টি সাব এবং এন্টি শিপের অস্ত্র বহন করতে পারে বিধায় এটি শীর্ষ ৫ সাবমেরিনের তালিকায় জায়গা পেয়েছে।
অন্য যে দুটি সাবমেরিনের কথা এর আগে বলেছি তাদের তুলনায় অত্যন্ত কম ক্রু প্রয়োজন হয়- মাত্র ৮৯ জন কর্মী ও অফিসার। এর প্রতি ইউনিটে খরচ ১.৮ বিলিয়ন পাউন্ড।
ইয়াসেন ক্লাস সাবমেরিন (Yasen class submarine)
রাশিয়ান এই সাবমেরিন প্রয়োজন পড়লে ৬০০ মিটার পর্যন্ত ডুবতে পারে এবং এর সর্বোচ্চ গতি ৩৫ নট যা একে পারফরম্যান্স এর দিক থেকে ১০ এ ১০ এনে দেয়। রাশিয়ানরা পশ্চিমা দেশগুলোর সাবমেরিনের এই কম ডুবতে পারার দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সাথে টেক্কা দিয়ে চলছে। শুধুমাত্র সি উল্ফই কিছুটা এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যদিও সদ্যই পাম্প জেটের অনুমোদন হয়েছে, তবুও এখন পর্যন্ত এটি প্রপেলার দিয়েই চলে। ফলে, ১০-১৫ নটের বেশি গতিতে গেলেই এটি শব্দ করতে শুরু করে। আর সাবমেরিনের জন্য এর থেকে খারাপ আর কি হতে পারে? শব্দের কারণে এর গোপনীয়তা বলে কিছু থাকছে না।
রাশিয়ানরাই কিন্তু প্রথম, যারা প্রশস্ত এপার্চার এরে ব্যবহার শুরু করে। ইয়াসেনও তার ব্যতিক্রম নয়। সাথে রয়েছে একটি টোড সোনার যা সোনার স্যুইটে তথ্য জমা করে। ইয়াসেনের একটি স্ফেরিক্যাল সোনারও রয়েছে।
ইয়াসেন শুধু রাশিয়ান নয়, বিশ্বের সকল সাবমেরিনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সম্বলিত যুদ্ধ জাহাজ। এর ৩২ টি অস্ত্র ১০ টি টর্পেডো দিয়ে ছোড়া হয়, যাদের ক্যালিবার ৫৩৩ মিমি থেক ৬৫০ মিমি পর্যন্ত। তার উপর এতে ৮ টি সাইলো রয়েছে যা ৯০০ মিমি ক্যালিবারের LACM বা ৫০০ মিমি এর ASHM দিয়ে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ ইয়াসেনের সর্বমোট অস্ত্র হল ৬৪ টি।
এই ৯০০০ টন সাবমেরিনটি আকারে বড় হলে কি হবে, ক্রু লাগে মাত্র ৯০ জন। অথচ ৭০০০ টন এস্টুটেই লাগে ৮৯ জন। ইয়াসেন ক্লাস সাবমেরিমের প্রতি ইউনিটে খরচ ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আকুলা ক্লাস সাবমেরিন (Akula class submarine)
ইয়াসেনের মতই বেশ গভীর পর্যন্ত যেতে পারে আকুলা। সর্বোচ্চ গভীরতা ৫০০ মিটার এবং সর্বোচ্চ গতি ৩৫ নট।
এটিরও জেট পাম্পের সুবিধা না থাকায় প্রপেলার ব্যবহার করে। যদিও Gepard (K-335) এর কল্যাণে শব্দ বাইরে যেতে পারে কম। তাই খুব একটা শব্দ করে না। যদিও তা সি উল্ফ বা ভার্জিনিয়ার মত এত নিঃশব্দ নয়।
যদিও এর বেশিরভাগ সেন্সরগুলো কোল্ড ওয়ারের সময়কার, কিন্তু এতে থাকা একুস্টিক ডিটেকশন সেন্সর, যাকে SOKS বলা হয়, এই সাবমেরিনটিকে অনন্য করে তুলেছে। তাই পুরাতন সেন্সর ব্যবহার অত বেশি চোখে লাগে না।
সি উল্ফের মত এটিও ৫০ টি অস্ত্র বহন করে যা ৪ টি ৫৩৩ মিমি ক্যালিবারের টিউব ও ৪ টি ৬৫০ মিমি ক্যালিবারের টিউব দিয়ে ব্যবহার করা হয়। এই দুই ধরণের ক্যালিবার ব্যবহার করায় সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। কারণ এতে বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এটিও আকারে বড়, প্রায় ৯০০০ টন হলেও মাত্র ৭০ জন ক্রু নিয়ে চলে যার ৩০ জনই অফিসার।
তথ্য সূত্রঃ The National Interest পত্রিকা অবলম্বনে