পৃথিবীতে সবচেয়ে কার্যকরী, ঝামেলাবিহীন এবং সহজলভ্য শক্তির উৎস হলো পারমাণবিক শক্তি। পানিশক্তি, তাপশক্তি, সৌরশক্তি প্রভৃতি থেকে পারমাণবিক শক্তি তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার এবং কম ঝামেলার। কিন্তু তাই বলে পারমাণবিক শক্তিকেই একমাত্র সমাধান ভাবলে চলবে না। কেননা, পারমাণবিক পদার্থগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত পদার্থ।
অনেকেই মনে করেন নিউক্লিয়ার চূল্লী থেকে গলিত পদার্থ নিঃসরণ বা ইউরেনিয়াম সরবরাহই পারমাণবিক শক্তির সমস্যা। কিন্তু আসলে তা নয়। এর প্রধান সমস্যা এর বর্জ্য। বর্তমানে যেসব পারমাণবিক চুল্লীতে শক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে সবগুলোই নিউক্লিয়ার ফিশন পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থসমূহ বিভাজিত হয়। একটি পরমাণু ভেঙে অনেকগুলো কণায় পরিণত হয়। এ বিক্রিয়া চলার সময় প্রচুর পরিমাণে তাপ শক্তি উৎপন্ন হয়। এ তাপ সাধারণত পানিকে টারবাইন ঘুরিয়ে উত্তপ্ত করে সংরক্ষণ করা হয়। আবার পানি যাতে উত্তপ্ত হয়ে ফুটে বাষ্পে পরিণত না হয় সেজন্য পানিকে ঠান্ডা করার ব্যবস্থাও করতে হয়।
পারমাণবিক পদার্থ হিসেবে সাধারণত ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হয়। পারমাণবিক বিক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনের জন্য ইউরেনিয়ামকে ছয় থেকে আট বছর পর্যন্ত ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু এর তেজস্ক্রিয়তা হাজার হাজার বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকে যা মানবদেহের জন্য ও পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে এগুলোকে আমরা কী করব? উত্তরটা খুবই সহজ। পারমাণবিক বর্জ্যগুলোকে এমন জায়গায় রেখে দেওয়া যেখানে তারা আলাদা হয়ে থাকবে, তারা অন্য কোন পদার্থের কাছাকাছি আসবে না যাদের সহচর্যে এলে বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। সেখানে পারমাণবিক বর্জ্যগুলো শত শত বছরের জন্য থাকবে। কিন্তু এটা বলা যত সহজ করা তত কঠিন। বাস্তবিকভাবে বিশ্বজুড়ে কোন নিউক্লিয়ার বর্জ্যকেই এভাবে দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বল্প সময়ের জন্য যেখানে বর্জ্য রাখা হয় সেখানে তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো থেকে যায়।
অধিকাংশ পারমাণবিক বর্জ্য পানির পুলে সংরক্ষণ করা হয়। পানিতে পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণের ফলে বিকিরণ হয় না। তাই এটি তুলনামূলক সাশ্রয়ী ও সহজ। এই পুলগুলো সাধারণত পারমাণবিক চুল্লীর অভ্যন্তরে নির্মাণ করা হয়। এজন্য পারমাণবিক বর্জ্যগুলো নিঃসরণের সাথে সাথে পুলে ফেলা হয়। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পানিতে ফেলার পর সেখানে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়। এ শক্তির কারণে পানি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। পানি যাতে না ফুটে সে জন্য পারমাণবিক চুল্লীতে আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় আলাদা শক্তি। যদি কোনভাবে শক্তি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পানি শীতল রাখার পাম্প ও জেনারেটর বন্ধ হয়ে যাবে। ফলশ্রুতিতে পানি উত্তপ্ত হওয়া শুরু হবে এবং পানিতে থাকা তেজস্ক্রিয় পদার্থসমূহ বিকিরিত হবে। এর ফলে বিষাক্ত পদার্থসমূহ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
জাপানের ফুকুশীমাতে ঠিক এ ঘটনাটাই ঘটেছিল। সেখানে পারমাণবিক চুল্লীতে পানিকে শীতল করার পাম্পটি অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। যার দরুন বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক বর্জ্য বিকিরণের মাধ্যমে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
যদি পারমাণবিক বর্জ্য পুলে ঠান্ডা করে ১০-২০ বছরের জন্য জমা করে রাখা হয় তাহলে এটি একটি পিন্ডে পরিণত হয়। তারপর এটিকে কংক্রিট বা স্টিলের কন্টেইনারে রাখা যায়। এটা কোন স্থায়ী সমাধান নয়। এটা ভূমিকম্প প্রতিরোধ করে না বা সুনামি থেকেও রক্ষা করা যায় না। এই কন্টেইনারগুলো মানুষ তদারক করে। পিণ্ডগুলোকে যথেষ্ট নিরাপদে রাখতে হয় এবং তদারক করতে হয়। মানুষের পর্যবেক্ষণ ছাড়া এই বর্জ্যবাহী কন্টেইনার যেকোন সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং বিষাক্ত পদার্থ বিকিরিত হয়ে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী পারমাণবিক সংরক্ষণের জন্য চাই সঠিক ব্যবস্থাপনা। এটা রাজনৈতিক অবকাঠামোর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর তদারকি মানুষের দ্বারা না করে প্রযুক্তি দিয়ে করতে হবে এবং স্থায়ী সমাধানে যেতে হবে।
ফিনল্যান্ড ঠিক এমনটাই নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগবিহীন একটি পরিপাটি এলাকা। ফিনল্যান্ড এমন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয় নি যা থেকে তাদের পারমাণবিক বর্জ্যের কোন ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে যখন বর্জ্য থাকে মাটি থেকে ১৫০০ ফুট নিচে। ফিনল্যান্ডের বাল্টিক সাগরের একটি দ্বীপে খনন করে পারমাণবিক বর্জ্য রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পৃথিবীতে তারাই প্রথম ভূমি থেকে ১৫০০ ফুট নিচে এই বর্জ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। খুব শীঘ্রই মানে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২০ সাল নাগাদ পারমাণবিক বর্জ্য জমা করা শুরু করবে। তারা মাটির নিচে ছোট ছোট টানেল তৈরি করবে। এই টানেলগুলোতে বর্জ্য রেখে কাদামাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলবে যাতে করে কোন বিকিরণ ঘটতে না পারে। এ পদ্ধতিতে বর্জ্য লিকেজ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তখন সেখানে আর মানুষের তদারকির কোন প্রয়োজনই পড়বে না। অর্থাৎ সত্যিকার অর্থেই স্থায়ী সমাধান।
একটা জিনিস অবশ্য সমস্যায় ফেলতে পারে, আর সেটা হলো মানুষের সহজাত স্বভাব। এমনও হতে পারে মানুষ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে হাজার হাজার বছর পরে ওই জায়গায় খনন কাজ শুরু করল। তখন সেখান থেকে আবার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটতে পারে। তাই আমাদের উচিৎ ভবিষ্যত প্রজন্মকে সতর্ক করে যাওয়া যেন তারা এ ধরণের এলাকা এড়িয়ে চলে।
গবেষকরা বলেছেন পারমাণবিক বর্জ্যের ভয়াবহতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা এবং সেই সাথে এটি একটি গুরুত্বহীন, বিরক্তিকর বিষয় হিসেবে তাদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়ত এ স্থানগুলোর প্রতি আগ্রহ কম দেখাবে। তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পারমাণবিক বর্জ্যের স্থানগুলোর ভয়াবহতা নিয়ে একটি মেসেজ তৈরি করেছে যা জাতিসংঘের প্রধান প্রধান দেশগুলো তাদের নিজস্ব ভাষায় অনুবাদ করে নিয়েছে যেন আগামী অন্তত দুই হাজার বছর পর্যন্ত মানুষজন ওই স্থানগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়।
লেখক- নিশাত সুলতানা
আরও পড়ুন- ইতিহাস পুড়িয়েছে যেসব পারমাণবিক দুর্ঘটনা