ঘর ভর্তি অবৈধ ডলার। রেইনফরেস্টের ঘন জঙ্গলে পোঁতা আছে কাড়ি কাড়ি ডলার। এক জীবনে এত অর্থ কামিয়েছেন যে, দেশ থেকে দেশে সে অর্থ লুকিয়ে রাখার জন্য কিনে ফেলেছিলেন একটা জেট বিমানও। হবেই বা না কেন তিনি যে ছিলেন অপরাধজগতের রাজা। আশির দশকে বিশ্বের বিলিয়নয়ারদের তালিকায় তার স্থান ছিলো সপ্তমে। বলছিলাম বিশ্বত্রাস পাবলো এসকোবারের কথা।
১৯৪৯ সালের ১ ডিসেম্বর। রিও এলাকার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পাবলো এসকোবার। কৃষক বাবা ও স্কুল শিক্ষিকা মায়ের তৃতীয় সন্তান এসকোবার, স্কুলজীবনেই পা বাড়ান বিপথে। গোপনে কবরস্থানের সমাধি শিলা চুরি করে সেগুলোকে ঘষে পরিষ্কার করে বিক্রি করে দিতেন স্থানীয় চোরাকারবারদের কাছে। মাঝেমধ্যে কবরস্থানে থাকা ভাস্কর্যগুলো চুরি করে সেগুলো বিক্রি করতেন চড়া দামে।
ধীরে ধীরে জাল টিকেট বিক্রি, গাড়ি চুরি, নিষিদ্ধ সিগারেট বিক্রির মত অপকর্মেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন এসকোবার। চোরাবাজারে গড়ে তুলেন নিজের আধিপত্য। ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন। একবছর পরেই জেল থেকে ছাড়া পেয়েই লেগে পড়েন কাজে। চোরাই পথের সেরা কিছু লোক নিয়ে নিজের একটা দল গড়ে তুলেন। পরবর্তীতে সারা বিশ্ব যাকে চেনে কুখ্যাত “মেডেলিন কার্টেল” নামে। যাদের উদ্দেশ্য ছিলো সারাবিশ্বে কোকেন পাচার করা। ১৯৭৫ সালে কলম্বিয়ার মেডেনের বিখ্যাত কোকেন ব্যবসায়ী খুন হন। ধারণা করা হয় এই খুনের পিছনের উদ্দেশ্য ছিল এসকোবারের একক একাধিপত্য স্থাপন।
এসকোবার নতুন নতুন রুটে অভিনব পদ্ধতিতে কোকেন পাচার করতেন। কখনো পাচারকারীর জিন্সের প্যান্টে কোকেন ছিটিয়ে দিতেন। পরবর্তীতে রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে প্যান্ট থেকে কোকেন নিঃসরণ করা হত। গর্ভবতী মহিলাদেরকে ইমিগ্রেশনে তেমন তেল্লাশি করা হয় না বলে তাদের শরীরে ঢুকিয়ে দিতেন কয়েক প্যাকেট কোকেন। গাড়ির টায়ার পর্যন্ত ছাড়েননি। এক একটা টায়ারের মধ্যে আটকে দিতেন বিশ কিলো কোকেন। কিন্তু তাতে পোষাচ্ছিলো না তার। তাই বিমানের চাকায় করে মাদক পাচার করার পদ্ধতি তাঁর মাথা থেকেই বের হয়েছিলো। যদিও সেক্ষেত্রে পাইলট ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মনরক্ষার জন্য দিতে হতো মোটা অঙ্কের ঘুষ।
এসকোবার নৌপথেও চালিয়েছেন চোরাই অভিযান। নৌকায় মাছের পেস্টের সাথে একসাথে ২৩হাজার কেজি কোকেন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন, যা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় চালান। কখনো বিমান থেকে প্যারাসুটে ঝাঁপ দেওয়া একদল লোক পানিতে নেমে চলন্ত জাহাজের ডেকারে ঢুকিয়ে দিত কোকেনের প্যাকেট।
আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে ছুটে চলতো বিভিন্ন রকম স্পিডবোট। কলম্বিয়া থেকে বস্তাভর্তি কোকেন নিয়ে আমেরিকার সমুদ্রের দিকে পাড়ি জমাতো তার বিমান। মাঝসমুদ্রে এসে বস্তাগুলো বিমান থেকে ফেলে দেওয়া হতো। আর বস্তাগুলো এমনভাবে তৈরি ছিলো যেন পানিতে ভাসতে পারে। আমেরিকার ড্রাগ মাফিয়ার স্পিডবোটগুলো সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটে চলতো ফ্লোরিডার দিকে।
কোকেন পাচারে এসকোবার এভাবেই এক একটি বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন। আশির দশকে এমনকি কিনে ফেলেন সাবমেরিন। নৌবাহিনীর চোখে ধুলো ছড়িয়ে সাবমেরিন দিয়েই পাচার করতে থাকেন মাদকের চালান। সারা বছর আমেরিকায় পাঠানো কোকেনের আশি ভাগই ছিলো এসকোবারের দখলে। প্রতিদিন পনের থেকে বিশ টন কোকেন পাচার করতো তার দল। সাপ্তাহিক আয় তাই গিয়ে দাঁড়ায় ৪২০ মিলিয়ন ডলারে! যদিও মাদকের এই বিশাল সাম্রাজ্য এসকোবার একদিনে গড়ে তোলেন নি। এজন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে।
“ঘুষ নয়তো গুলি” এই নীতিতে বিশ্বাসী এসকোবার কলম্বিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কব্জা করে ফেলেছিলেন। শুধু কলম্বিয়া নয়, বিশ্বের যেখানেই কোকেন পাচার হত সেখানেই ঘুষ নীতি প্রথাতে বাগিয়ে নিতেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা। যারা তার বিপক্ষে যেতেন, তাদের ভাগ্যে জুটতো নির্মম মৃত্যু। প্রায় চার হাজার লোক হত্যা করা হয়েছিল এসকোবারের নির্দেশে। যার মধ্যে বিচারক থেকে শুরু করে পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা কেউ রক্ষা পায়নি। কতটা নৃশংস ছিলেন তিনি, তার বর্ণনা দিয়েছেন এসকোবারের সহযোগী “পপাই”, যে কিনা মেডলিং দলের ভাড়াটে খুনী হিসাবে কাজ করতো। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর, মুক্তি পেয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেল খুলে বসেন। যেখানে তিনি বর্ণনা দিয়েছেন কতটা নির্মমভাবে মানুষ হত্যার আদেশ দিতেন এসকোবার।
এসকোবারের মোট সম্পত্তির পরিমাণ কত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ফোর্বসের ধারণা মতে প্রায় ত্রিশ বিলিয়ন ডলারের মালিক ছিলেন এই কোকেন সম্রাট। বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট, বিলাসবহুল দ্রব্য আর সুপারকারের পিছনে খরচ করার পরও কাড়ি কাড়ি ডলার তাকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল। কথিত আছে মাটিতে পুঁতে, পরিত্যক্ত বাড়ি কিংবা ফ্যাক্টরীর দেয়ালে লুকিয়ে রাখার কারণে বছরে প্রায় দুইশো কোটি ডলার ইঁদুরে কেটে, জলে লেগে নষ্ট হয়ে যেত।
একটা সময় হৃদয়হীন এসকোবার মেডেলিনের সাধারণ জনগণের পিছনেও খরচ করতে শুরু করেন। বিশ্বব্যাপী কুখ্যাত একজন মাদক সম্রাট হিসেবে পরিচিত হলেও দান করার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেন গরীবের বন্ধু। বিশেষত পশ্চিম কলম্বিয়ার মানুষ তাকে ঈশ্বরের মতো সম্মান করতো। তাই বলে তিনি অপকর্ম বাদ দিয়েছিলেন, তা কিন্তু নয়। যে হাতে খুন করতেন, সেই হাত দিয়েই করতেন গরীবদের সেবা। গরীব মানুষদেরকে বিনামূল্যে খাওয়া ও থাকার সুযোগ করে দিতেন তিনি। তাছাড়া বাড়িঘর, স্কুল, গির্জা, হাসপাতাল, পার্ক তৈরি তো রয়েছেই।
এত সব কিছুর পরেও শুরু থেকেই মানুষটার নজর ছিলো কলম্বিয়ার প্রসিডেন্টের চেয়ারের দিকে। ১৯৮২ সালে তিনি কলম্বিয়ার সাংসদ সদস্য হিসেবেও নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী লুই কার্লোস গালান ঘোষণা করেন তিনি প্রেসিডেন্ট হলে কলম্বিয়া থেকে মাদকের ব্যবসাকে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। তার কয়েকদিন পরেই গালানের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এই হত্যার পেছনে কলকাঠি নাড়িয়েছিলেন ডন পাবলো এসকোবার।
গালানের উত্তরাধিকারী সিজার গ্যাভিরিয়াকেও খুন করার চেষ্টা করা হয়। গ্যাভিরিয়াকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিমানে বোমা লাগানো হয়। এতে ১০৭ জন যাত্রীর সবাই মারা যায়, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে গ্যাভিরিয়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। পরের বছরেই গ্যাভিরিয়া কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। সেই সাথে এসকোবারের শাসনকালের সমাপ্তি পর্ব ঘনিয়ে আসে।
গ্যাভরিয়ার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র এবং কলম্বিয়া যৌথ উদ্যোগে এসকোবারকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করে। এসকোবার জানতো ধরা পড়লে কলম্বিয়া সরকার তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিবে।তাই নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি কলম্বিয়ার আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ করে দিবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। যার আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! অবশেষে ১৯৯১ সালে কলম্বিয়া সরকারের সাথে চুক্তি করে আত্মসমর্পণ করেন এসকোবার। শর্ত ছিলো নিজের কারগার তিনি নিজেই গড়বেন।
কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে তাই তৈরি করা হয় বিলাসবহুল কারাগার। নাম দেওয়া হয়- লা ক্যাথাড্রাল। হেলিপ্যাড, সুইমিংপুল, কৃত্রিম জলপ্রপাত, কম্পিউটার, টেলিফোন কি ছিলো না এই কারাগার। চুক্তি অনুসারে তার কয়েকজন সহযোগী তার সাথে দেখা করতে জেলে আসতেন। একদিন তার দুইজন অংশীদারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে এসকোবারে লাঠির আঘাতে মারা যায় তারা। তাদের লাশ ধামা-চাপা দিতে চুল্লিতে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দুইজন এজেন্ট তদন্ত করে নিশ্চিত হন যে জেলখানায় দুজনকে হত্যা করা হয়েছে। তারা সেই খবরটি একটি সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেয়। ফলে চারদিকে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু সরকারের সঙ্গে চুক্তি ছিল এসকোবার লা ক্যাথেড্রালে থাকা অবস্থায় কোন অপরাধ কর্মকান্ড করতে পারবে না, তাই চুক্তির লঙ্ঘনের দায়ে তাকে সাধারণ জেলে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এসকোবার মাটির নিচে তৈরি গুপ্ত সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যান।
এরপর কোকেন ডনকে ধরার জন্য প্রায় দুই হাজারের বিশাল এক “সার্চ ব্লক” টিম গঠন করেন সরকার। প্রায় ১৬ মাস ধরে তন্নতন্ন করে খোঁজার পর অবশেষে ১৯৯২ সালের ২ ডিসেম্বর, ৪৪তম জন্মদিনে একদিন পর, মৃত্যুকে বরণ করে নেন কোকেন সম্রাট পাবলো এসকোবার। নথিপত্রে শ্যুটআউটে মারা যাওয়ার কথা উল্লেখ্য থাকলেও এসকোবার পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন নাকি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তার প্রমাণ মিলেনি।
এক পারিবারিক বৈঠকে এসকোবার বলেছিলেন, পুলিশের হাতে তিনি কখনো মরবেন না। যদি দেখেন মৃত্যু সুনিশ্চিত তখন তিনি কানের নিচে গুলি করে আত্মহত্যা করবেন। তার লাশ যখন পাওয়ায় তখন তার বুকে, পায়ে আর কানের একটু নিচে গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়। এতে ধারনা করা হয়, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।
লেখক- ঐশ্বর্য মীম