Site icon Bangla Info Tube

ভারতীয় ছবি প্রদর্শনঃ পাকিস্তানের প্রয়োজন না সংকট?

ভারতীয় ছবি প্রদর্শন পাকিস্তানের প্রয়োজন না সংকট?; Image Credit: Freeguide.pk

Reading Time: 5 minutes

চলন্ত গাড়ি থামিয়ে অন্য ধর্মের লোকদের এনে প্ল্যাটফর্মে হত্যা করা হলো। বাকি যাত্রীদের মিষ্টি, দুধ আর ফল দিয়ে আপ্যায়নের পর ঘোষণা এলো, ‘ভাই বোনেরা, ট্রেন আসার সংবাদ দেরিতে পাওয়ায় আপনাদের উপযুক্ত আপ্যায়ন আমরা করতে পারিনি।

মান্টোর এই তিন লাইনেরআপ্যায়নগল্পটিই বলে দেয় ভারতপাকিস্তানের বৈরি সম্পর্কের গভীরতা। বহু আগে থেকেই হিন্দুমুসলিম বিতর্ক তুঙ্গে ছিল এই উপমহাদেশে। শেষমেশ৪৭ এর দেশ বিভাগই কফিনে শেষ পেরেকটা ঠোকে। 

আজন্ম দ্বৈরথ

১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৯৯ নানান সময়ে যেমন সম্মুখে লড়েছে এই দুই দেশ, তেমনি কাশ্মীরের মালিকানা কিংবা ক্রিকেটের মাঠেও গড়িয়েছে সেই দ্বৈরথ। ভারতপাকিস্তানের সীমানা তো বরাবরই অশান্ত। 

এর বাইরেও বহু জায়গায় যুদ্ধ কিন্তু চলছেই। আর তার সবচাইতে বড় ক্ষতির শিকার চলচ্চিত্র মাধ্যম। রমরমা বলিউড অথবা সাউথ পাড়ায় আঁচড়টা কম লাগলেও পুরো পাকিস্তানের শিল্পাঙ্গনই এতে কুপোকাত। 

পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের বেহাল দশা

পাকিস্তানি চলচ্চিত্রে স্বর্ণযুগ তেমন প্রচলিত না হলেও ভালো গল্পের অভাব ছিলনা।উমরাও জান আদা’, ‘আনারকলি’, ‘মাওলা জুতইত্যাদি ছবি তৈরি হলেও একসময় স্থবির হয়ে যায় এই শিল্প। বিভিন্ন সময়ে এদেশেরচলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থানানা পরিকল্পনার কথা বললেও আদতে খুব একটা সাহায্য করেনি। 

অন্যদিকে ভারতীয় ছবি নিষিদ্ধ করার ইতিহাস পাকিস্তানের জন্য নতুন নয়। ১৯৬২ সাল থেকেই এই শীতল যুদ্ধ চলছে। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া উল হক সেন্সর বোর্ডের উপর ইসলামভিত্তিক এবং কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন। 

‘নিরজা’ ছবিটিতে পাকিস্তানের নেতিবাচক উপস্থাপনই নিষিদ্ধের জন্য দায়ী।; Image Credit: Forbes

এর ফলে বহু ছবিই ব্যান হতে থাকে পাকিস্তানে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোনিরজা, ভাগ মিলখা ভাগ, রাঞ্ঝনা, মুল্ক, রাজি, প্যাডম্যান, নাম শাবানা, দঙ্গল, টাইগার জিন্দা হ্যায়, হায়দার, দিল্লি বেলি, তেরে বিন লাদেন ইত্যাদি।  ভারতীয় একেকটি ছবি পাকিস্তানে গড়ে আয় করে কোটি রুপি। সর্বশেষ ২০১৬ সালেসুলতানআয় করেছিল ৩৭ কোটি রুপি। 

দুর্ভাগ্যের শুরু

১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খান আইয়ুব আক্ষরিক অর্থে ভারতীয় ছবি নিষিদ্ধ করেন। তবে এর চাইতেও বেশি ক্ষতি হয় জিয়াউল হকের আমলে। উচ্চ কর আর সেন্সরশিপের কঠিন মনোভাব পাকিস্তানি চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংসের দিকে টেনে নেয়। তখন শিল্প বিকাশের অন্য মাধ্যম অর্থাৎ টেলিভিশনকে আঁকড়ে ধরে পাকিস্তান। পাকিস্তানি সিরিয়াল বা প্যাকেজ নাটকের বিকাশ ঘটে তখনই। সিনেমা বোদ্ধাদের হাতে তখন দুটি পথ খোলা ছিলহয় সেকেন্ডরেটেড সিনেমা দেখা নয়তো হলিউডবলিউডের পাইরেটেড কপি জোগাড় করা। 

বদলের যাত্রা

২০০৬ সালে পাকিস্তানি চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য ছিল বিশাল সুযোগের সময়। জেনারেল পারভেজ মোশারফ ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের উপর সকল নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেন। ফলে দর্শকেরা হলমুখী হতে থাকে আর বাড়তে থাকে হলের চাহিদাও। তবে এক্ষেত্রে হিসেবে কিছুটা গড়মিল করে ফেলে বিনিয়োগকারীরা। ২০১১ সালে যেখানে ৩৫ টি মাল্টিপ্লেক্স গড়ে ওঠে এবং ১০০ এর বেশি নির্মিত হতে থাকলেও এদের মূল লক্ষ্য ছিল উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি। অন্যদিকে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি কিংবা নিম্ন আয়ের জনতার জন্য কোন উপযুক্ত সিনেমা হলই নির্মাণ করেনি তারা। 

হেতু যাই হোক, ক্রমাগত হলের সংখ্যা বাড়ায় খানিকটা আশার আলো দেখতে পান পাকিস্তানি চলচ্চিত্র নির্মাতারা। ২০১১ সালে শোয়েব মনসুরেরবোলছবিটির সফলতার সাথে সাথেই বদলে যায় দৃশ্যপট। গোটা পাকিস্তান এবং এর বাইরেও ছবিটি প্রশংসা পায়। 

আশা জাগানিয়া ‘বোল’; Image Credit: India Today

পরের দুই বছরে পাকিস্তান প্রায় ২০ টি ছবি মুক্তি দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও ছবি প্রদর্শন প্রচারণার জন্য তদবির চালাতে থাকে তারা। 

এই ক্ষেত্রেও ভারতকে পাশে পায় পাকিস্তানি শিল্পীরা। আতিফ আসলাম, রাহাত ফাতেহ আলি খান, আদনান সামি, আলি জাফরসহ অনেক পাকিস্তানি গায়কই নিয়মিত হন বলিউডে। এর সাথে সাথে ফাওয়াদ খান, ইমরান আব্বাসের মতো সুদর্শন অভিনেতারাও নজর কাড়তে সমর্থ হন ভারতীয় দর্শকদের। মাহিরা খান, সাবা কামার কিংবা মাওরা হোকানে প্রমুখ অভিনেত্রীরাও প্রথমবারেই শাহরুখ খান, ইরফান খানের সাথে স্ক্রিন শেয়ারের সুযোগ পান। 

এর মধ্যেই পাকিস্তান এগুতে থাকে চলচ্চিত্র নির্মাণের দিক দিয়ে। বেশ কিছু চলচ্চিত্রা বক্স অফিসে দামামা বাজালেও গোটা দেশের হলগুলোকে চালাবার জন্য যথেষ্ট ছিলনা। 

বিরোধে দুই দেশ

এই দুই দেশের চলচ্চিত্রের উপর কঠোর আঘাত আসে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। পাকিস্তানি জঙ্গিবাদী দলজাইশমুহাম্মাদ’  কাশ্মীরে অবস্থানরত ভারতীয় আর্মিদের উপর হামলা চালায় এবং ১৯ জনকে হত্যা করে। স্বভাবতই পুরো দেশজুড়ে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রযোজকেরা সকল পাকিস্তানি অভিনেতাঅভিনেত্রীদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ফলে ভারতে ব্যস্ত থাকা অভিনেতা ফাওয়াদ খান, আলি জাফর, মাহিরা খান, রাহাত ফাতেহ আলি খান, আতিফ আসলাম সহ বহুজনকেই দ্রুত কাজ ছেড়ে পাকিস্তানে ফেরত যেতে হয়। 

শাহরুখ- মাহিরার ‘রাইস’ নিষিদ্ধ হয় পাকিস্তানে; Image Credit: The Express Tribune

অন্যদিকে পাকিস্তানি হল মালিকেরাও ভারতীয় ছবি নামিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। তবে এর ফল মোটেই সুখকর ছিলনা পাকিস্তানের জন্য। তিনমাসের ভেতর পাকিস্তানের হলগুলোতে লোক সমাগম নেমে আসে ১১% এ। 

দুই দেশের রাজনৈতিক দ্বৈরথ ক্রমেই শিল্পের জন্য আঘাত হয়ে আসে। পাকিস্তানের চলচ্চিত্রাঙ্গন দাঁড়াবার আগে থেকেই বলিউড সে দেশের জনগণের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। দেব আনন্দ অথবা শাহরুখ খান, কিংবা হালের দীপিকা পাড়ুকোনপাকিস্তানে এদের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। পাকিস্তানে ভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্রের মধ্যে বলিউডই পাকাপোক্ত স্থানে আছে। কিছু ইরানি তুর্কি ছবি দেখা গেলেও ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমেই টিকে আছে পাকিস্তানের হলগুলো। কেননা, প্রতি সপ্তাহে নতুন চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়ার মত অতটাও সাবালক হয়নি পাকিস্তানি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। 

অল্প সময়েই ভারতীয় হার্টথ্রবে পরিণত হন ফাওয়াদ খান; Image Credit: News Pakistan

এক সমীক্ষায় জানা যায়, ২০০০ সালে পাকিস্তানের মোট হল সংখ্যা ছিল ৩০; যা ২০১৩ তে গিয়ে দাঁড়ায় ১০০ তে। বিনিয়োগকারীরা বেশ সচেতনই ছিলেন তখন এবং ভারতীয় ছবি আমদানিতে তাদের আন্তরিকতাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আকস্মিক দুরবস্থায় বিহ্বল হয়ে যান তারা। তবে অবস্থা বেশিদিন টেকে নি। ২০১৭ সালেই হল মালিকেরা আবার ভারতীয় ছবি আমদানি শুরু করেন। 

তবে পাকিস্তানি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য যে ভাগ্যদেবী সহায় নন সেটা দেখা গেল বছরেরই ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া আরেক জম্মুকাশ্মীর সংঘাতে। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখেজাইশমুহাম্মাদএর আত্মঘাতী গাড়ি বোমা হামলায় ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর ৪০ জন সেনা নিহত হন।

ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী সকল প্রকার ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। অন্যদিকে ভারতও সকল পাকিস্তানি শিল্পির উপর আজীবন নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়।  

হল বাঁচাতেই বলিউড

রণনীতি বা রাজনীতিযে কারণেই এই নিষেধাজ্ঞা চলুক না কেন এতে বেশি ক্ষতির শিকার পাকিস্তানই। গত বছর পাকিস্তানে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ছিল মাত্র ২১ টি, যেখানে ভারত নানান ভাষার ১৮১৩ টি চলচ্চিত্র মুক্তি দিয়েছে নিজ দেশে। পাকিস্তানে যেখানে হলের সংখ্যা সাকুল্যে ১০০ সেখানে ভারতের ৬০০০ টি সিংগেল স্ক্রিন ছাড়াও ২১০০ টি মাল্টিপ্লেক্স আছে। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, এই ব্যানব্যান খেলায় পাকিস্তানের অবস্থাই বেগতিক। পাকিস্তানের হল থেকে আয়ের ৭০% আসে ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে।

পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় থিয়েটার চেইন সিনেপ্লেক্সের ম্যানেজার মির্জা সাদ বেগ। তিনি জানান, ‘ নিষেধাজ্ঞার তিনমাসের ভেতর দর্শক আসা কমে গেছে। পাকিস্তান যদি এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে চায় তাহলে প্রতি সপ্তাহে টি নতুন ছবি মুক্তি দিতে হবে। এছাড়া আমরা অনেক কর্মচারী ছাটাইয়ের কথাও ভাবছি।‘ 

কী হবে ভবিষ্যতে?

অ্যামাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্স, এইচবিও এরকম বহু সাইট চ্যানেল ক্রমেই গল্প পরিবেশনের ধারায় বদল আনছে। সে তুলনায় পাকিস্তান অনেক পেছনে। সম্যক কোন উদাহরণ চাইলে নন্দিতা দাসেরমান্টোআর সারমাদ খুসাতেরমান্টোদেখতে পারেন। অপেক্ষাকৃত কম স্ক্রিন টাইম, নিখুঁত সিনেমাটোগ্রাফি আর চতুর প্রচারণার জন্য নন্দিতা দাসেরমান্টো বেশি আলোচিত। অন্যদিকে, গল্পের গাঁথুনি, নিখাদ অভিনয় এবং কিছু অংশের শৈল্পিক উপস্থাপন সত্ত্বেও সারমাদের বৈচিত্র্যহীন সিনেমাটোগ্রাফি, কম প্রচারণা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক কারণের জন্য বেশ আড়ালেই পড়ে গেছে এটি, যদিও পুরস্কারের ঝুলি বেশ ভারিই এর। 

তবে গোটা পাকিস্তানি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবার জন্য ভারতীয় ছবি আমদানিকেই একমাত্র পন্থা হিসেবে দেখছে হল মালিকেরা। দেখা যাক, কোথাকার জল কোন সীমানায় গড়ায়

লেখক- সারাহ তামান্না 

Exit mobile version