পরমাণু বোমা আমাদের কি করতে পারে,কতটা আঘাত হানতে পারে- ১৯৪৫ এর আগপর্যন্ত পৃথিবী জানতো না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ প্রথম দেখে একটি পরমাণু বোমা কত বেশি শক্তিশালী,কত বেশি বিপদজনক। ঠিক সে কারণেই পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার ও ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন চুক্তি করা হয়েছে। একটাই কারণ- মানবজাতিকে পরমাণু অস্ত্রের ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো। কিন্ত এখনও পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টায় আছে বেশকিছু দেশ। আবার আমেরিকা,রাশিয়ার মত দেশগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে পারমাণবিক অস্ত্রকে।
তৎকালীন নাৎসি জার্মানি আমেরিকার আগে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে ফেলতে পারে এ আশঙ্কায় ১৯৩৯ সালে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট নিজ দেশের অস্ত্র তৈরির জন্য অনুমতি প্রদান করেন। ধীরে ধীরে কাজ শুরু হয় এবং ১৯৪২ সালে এ প্রজেক্ট অফিসিয়ালি ইউএস আর্মির হাতে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার যৌথ এই উদ্যোগ ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’ নামে পরিচিত ছিল। এ প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলেন রবার্ট ওপেন হেইমার, যিনি বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্রের জনক হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৫ এর মাঝামাঝিতে তারা ৩টি অস্ত্র তৈরি করতে সমর্থ হয়। ১৬ জুলাই,১৯৪৫- নিউ মেক্সিকোর জর্দানা দেল মুয়ের্তো মরুভুমিতে ‘ট্রিনিটি’ কোড নামে পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো হয়।
পারমাণবিক বোমার প্রথম ব্যবহার হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই। যুদ্ধের শেষের দিকে আমেরিকা জাপান আক্রমণের পরিকল্পনা করে। জাপান পিছু না হটাতে আমেরিকা তাদের নতুন অস্ত্র জাপানের উপর প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ‘ফ্যাট ম্যান’ যায় হিরোশিমা শহরে আর ৯ আগস্ট ‘লিটল বয়’ যায় নাগাসাকিতে। দুটো শহর মিলিয়ে ১,২৯,০০০-২,২৬,০০০ এর মত মানুষ মৃত্যবরণ করে।
পারমাণবিক অস্ত্রধারি দেশ
পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি অনুযায়ী যেসব দেশ ১ জানুয়ারি,১৯৬৭ এর পূর্বে পরমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা করেছে তারা ‘পরমাণু-অস্ত্রধারী দেশ’। সে সংজ্ঞা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য,ফ্রান্স ও চায়না পরমাণু অস্ত্রধারী। কিন্ত বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া প্রকাশ্যে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে, তাই তাদেরকেও পরমাণু অস্ত্রধারী বলা যায়।
এছাড়া ইসরায়েলও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে বলে সন্দেহ করা হয়, যদিও তারা কখনো স্বীকার করেনি। এগুলো বাদেও বেলজিয়াম,জারমানি,ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও তুর্কিতে ন্যাটোর চুক্তির আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করা আছে। এছাড়া দক্ষিন আফ্রিকাও ১৯৮০ সালের দিকে এ অস্ত্রের অধিকারী ছিল, কিন্ত ১৯৯০ এ তারা তা অকেজো করে ফেলে। আর সোভিয়েতের অংশ হিসেবে বেলারুস,ইউক্রেন ও কাজাখস্তানেরও এই ভয়াবহ অস্ত্র ছিল কিন্ত সেগুলো পরে রাশিয়াকে দেওয়া হয়।
নিউক্লিয়ার ট্রায়াড
মূলত কোন দেশের এয়ারক্রাফট বম্বার, ল্যান্ড-বেস্ড মিসাইল ও ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন থাকলে তাকে নিউক্লিয়ার ট্রায়াডের (স্থল, আকাশ ও জলভাগ— তিন অবস্থান থেকেই পরমাণু হামলা চালানোর ব্যবস্থা) অধিকারী বলা হয়। আমেরিকা প্রথম এই ত্রয়ীর অধিকারী হয়। এছাড়া রাশিয়া,চায়না ও ভারতও আছে এই তালিকায়। একসময় ফ্রান্সও ছিল তালিকায়, তবে এখন আর নেই। অনুমান করা হয় যে ইসরায়েলও নিউক্লিয়ার ট্রায়াডের মালিক, কিন্ত সেরকম প্রমান এখনও নেই। বর্তমানে ধারনা করা হচ্ছে যে পাকিস্তান এই তিন ধরনের অস্ত্রের মালিক হওয়ার পথে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকা কানাডা ও ব্রিটেনের সহায়তায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, যা পরে জাপানে নিক্ষেপ করা হয়। এরপরেও যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে সচেষ্ট থাকে। তারাই প্রথম হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করে ১৯৫২ সালে। এছাড়া স্নায়ু যুদ্ধের সময় তারা বিশাল এক অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করে। সেসময় তাদের কাছে প্রায় ৩১,১৭৫ টি পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। সিএনবিসির তথ্য অনুযায়ী,বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ৬,৫৫০ টি অস্ত্র আছে।
রাশিয়া
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৯ সালে প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। এবং ১৯৫৫ সালে নিজেদের হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করে। স্নায়ু যুদ্ধকালীন সময়ে আমেরিকার সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে। ১৯৪৯ এর পর থেকে ৫০,০০০ এর মত অস্ত্র তারা তৈরি করেছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে এর পুরো অস্ত্রভাণ্ডার রাশিয়ার হাতে আসে। বর্তমানে রাশিয়ার নিকট ৬,৮০০ টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে।
যুক্তরাজ্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালিন ‘ম্যানহ্যাটন প্রজেক্ট’- এর সাথে যুক্ত ছিল,কিন্ত ১৯৪৫ সালের পর আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে গোপনীয়তা অবলম্বন করলে যুক্তরাজ্য নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে মন দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়,এবং ১৯৫৭ তে নিজেদের হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করে।বর্তমানে তাদের ২১৫ টি অস্ত্র আছে।
ফ্রান্স
‘সুয়েজ ক্রাইসিস’ এর পর ফ্রান্স ঠিক করে যে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬০ সালে নিজস্ব গবেষণা দ্বারা পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালায়। ১৯৬৮ সালে তারা প্রথম হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করে। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্য নিজের ১৭৫ টি অস্ত্র ডিসআর্ম করে ও নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডারকে আরও আধুনিক করে তোলে। বর্তমানে তাদের ৩০০ টির মত অস্ত্র আছে।
চায়না
মূলত আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধক হিসেবে চায়না নিজেদের পারমানবিক অস্ত্র তৈরি শুরু করে। ১৯৬৪ সালে প্রথম পারমাণবিক ডিভাইস তৈরি করে তারা। ২ বছর পর তারা প্রথম ফিশন বম্ব তৈরি করে। তার পরের বছরেই তারা হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করে। অর্থাৎ ৩২ মাসের মাথায় তারা প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, এর থেকে দ্রুত কেউ পারেনি। বর্তমানে এদের ২৪০ টির মত টর্পেডো আছে, যদিও নিশ্চিত তথ্য পাওয়াটা মুশকিল। তাই ধারনা করা হয় ১০০ থেকে ৪০০ এর মধ্যে হবে সংখ্যাটা।
নন-এনপিটি পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ
এনপিটির বাইরে ভারত,পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া প্রকাশ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ভারত তাদের প্রথম পরীক্ষা চালায় ১৯৭৪ সালে। বর্তমানে এদের ১২০-১৩০ টি অস্ত্র আছে। পাকিস্তান প্রথম পরীক্ষা চালায় মে,১৯৯৮ এ । তাদের বর্তমানে ১৩০-১৪০ টি আছে। ধারনা করা হয় যে পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধ হবে ভারত-পাকিস্তানের মাঝে। দুইটি দেশই নিজেদের পারমানবিক অস্ত্রভাণ্ডার বৃদ্ধি করেই চলেছে। যদিও পূর্বে এনপিটি চুক্তিতে ছিল, কিন্ত ২০০৩ সালের দিকে উত্তর কোরিয়া এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে এবং ২০০৬ সাল থেকে প্রথম পরীক্ষা চালায়। বর্তমানে তাদের অন্তত ২০ টি টর্পেডো আছে। কোন কোন উৎস সংখ্যাটিকে ৬০ বলে। তবে সম্প্রতি কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম-জং-উন বলেছেন যে তারা পুরো কোরীয় উপদ্বীপকে পারমানবিক অস্ত্র-মুক্ত করবে। কিন্ত এ প্রতিশ্রুতির কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
আর ইসরায়েলের কথা বললে সবকিছুই ধারনা ও আন্দাজের উপর বলতে হবে। কারণ তাদের দেশ থেকে কখনো অফিসিয়ালি কিছু জানানো হয় না। কিন্ত সবাই বিশ্বাস করে যে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র আছে। কবে তারা প্রথম পরীক্ষা চালিয়েছে তা জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন উৎস থেকে তাদের অস্ত্রের সংখ্যা ২০ শোনা যায়,আবার কিছু উৎস ৮০ ও বলে।
সব মিলিয়ে বর্তমানে পৃথিবীতে ১৪,৪৮৫ টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে। আর এ সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না।
১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকির বিভীষিকার পর জাতিসংঘের উদ্যোগে এনপিটি চুক্তি করা হয় ১৯৬৮ সালে। ১৯৭০ সাল থেকে এটি বাস্তবায়ন শুরু হয়। পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা স্নায়ুযুদ্ধকালিন সময়ের তুলনায় অনেক কমে গেছে। ১৯৯৫ সালে এ চুক্তির মেয়াদ অনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এছাড়া সিটিবিটি বা কম্প্রিহেন্সিভ টেস্ট ব্যান চুক্তি ও আছে যা সামরিক ও বেসামরিক সব ধরনের নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের বিপক্ষে। কিন্ত ৮ টি দেশের না মানার কারণে এ চুক্তি এখনও প্রচলিত হতে পারছে না।
একটা সময় ছিল যখন মানুষ মনে করতো যে পারমাণবিক অস্ত্র হবে মানবজাতির ধ্বংসের কারণ। বর্তমানে সেরকম হুমকি একটু হলেও কমে এসেছে। এখন মনে করা হয় যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এর কারণে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তবে যেটাই হোক, পারমাণবিক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আমাদের বিশ্বনেতাদের সবসময় সচেতন হওয়া উচিত। কেউই চায় না যে হিরোশিমা ও নাগাসাকির পুনরাবৃত্তি হোক। পৃথিবী হোক শান্তির, কল্যাণের।