নেটফ্লিক্সের বাজিমাত1 min read
Reading Time: 5 minutes২০১৮ সালে আলফানসো কুয়ারনের ‘Roma’ হইচই ফেলে দিয়েছিল সিনেমাপাড়ায়। মেক্সিকান নারীর সাধারণ জীবনের চিত্র সাদাকালো ফ্রেমে তুলে আনা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি স্ট্রিমিং সাইট নেটফ্লিক্সে এর মুক্তি দেয়া নিয়েও তর্ক–বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ আর প্রযুক্তির আসন্ন পরিবর্তন বড় চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দিয়েছে এর মধ্যেই। তারই পরিক্রমায় ২০১৯ সালটাও ছিল চমকে ঠাসা। অধিকাংশ স্ট্রিমিং সাইটেই এবছর চমৎকার কনটেন্টের দেখা মিলেছে।
নেটফ্লিক্স যেহেতু এখন সাইটগুলোর রাজাধিরাজ বনে গেছে, পয়লা তার খোঁজ নেয়াটাই মানায়। উনিশ সালে দর্শক দুর্দান্ত কিছু চলচ্চিত্র পেয়েছে এই সাইট থেকে। এর মধ্য থেকে গুটিকয়ের কথা জেনে নিই আজ।
The Irishman
আল পাচিনো, রবার্ট ডি নিরো, জো পেসি এবং মার্টিন স্করসেসি ইকুয়ালস টু ‘The Irishman’। দাঁড়ান দাঁড়ান, সময় নিন। একসাথে এত পেল্লাই অভিনেতা আর কিংবদন্তি পরিচালকের নাম হজমে সময় লাগবেই বৈকি। শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক স্করসেসি যেকাজেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে। শুধু ডি নিরোর সাথেই ‘Taxi Driver’, ‘The King of Comedy’, ‘ Goodfellas’, ‘Raging Bull’ প্রভৃতি অনবদ্য উপাখ্যান রচনা করেছেন তিনি। এবারও বছরের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত ছবি হিসেবে মর্যাদা রক্ষা করেছে স্করসেসি–নিরোর যুগলবন্দি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় এক ইতালিয়ান মাফিয়া পরিবারের সাথে কাজ শুরু করেন ফ্র্যাঙ্ক শিরান। তাঁর কাজ ছিল স্রেফ ট্রাকে করে টুকটাক পণ্য পরিবহন করা। ঘটনার ঘূর্ণাবর্তে তাঁর পরিচয় ঘটে আরেক অপরাধী দলের মাথা রাসেল বাফালিনোর সাথে। রাসেলের সাথে দ্রুতই সম্পর্কের উন্নতি ঘটে ফ্র্যাঙ্কের। বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পোড়া হৃদয় নিয়েই রাসেলের শত্রু বিনাশে মাঠে নামে সে। ঝটপটই শহরের কুখ্যাত ‘হিট্ম্যানে’ পরিণত হয় ফ্র্যাঙ্ক। ষাটের দশকে তাঁর পরিচয় ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার যৌথভাবে পরিচালিত লেবার ইউনিয়ন ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব টিমস্টারস‘ (আইবিটি) এর প্রধান জিফ হফার সাথে । রগচটা হফা আর ঠাণ্ডা মাথার ফ্র্যাঙ্কের রসায়ন জমে ওঠে কম সময়েই। কিন্তু স্বার্থের সামনে বন্ধুত্ব কতটা গুরুত্ববহ? হফার পাগলামো থামাতে কী পরিকল্পনা আঁটবে রাসেল? এতে ফ্র্যাঙ্কের ভূমিকাই বা কী?
গ্যাংস্টার ঘরানার আরেক অনবদ্য কীর্তি দেখলেই উত্তর মিলবে প্রশ্নগুলোর। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার এই ছবিটি নির্মিত হয়েছে ১৫৯ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে। তবে এর পরিকল্পনা স্করসেসি শুরু করেছিলেন ৩৫ বছর আগেই। চার্লস ব্রান্তের ‘ I Heard You Paint Houses’ এর নিরিখে এর চিত্রনাট্য লেখা হয়। রাসেল চরিত্রে জো পেসি ক্যামেরার সামনে এসেছেন দশ বছর বাদে। গ্যাংস্টার ধাঁচের গল্প দেখে তিনি প্রথমেই স্করসেসিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। টানা ৫০ বার প্রস্তাবের পরই মন গলে তাঁর। অন্যদিকে পাচিনোর সাথে স্করসেসির এটাই প্রথম কাজ। ছবিটি নিউ ইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রথম প্রদর্শিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু হলে ১ নভেম্বর মুক্তি পায়। তবে নেটফ্লিক্সের অফিসিয়াল সাইটে ঢালাওভাবে মুক্তি পায় ২৭ নভেম্বর। বর্তমানে এর আইএমডিবি রেটিং ৮.১।
The Marriage Story
চার্লিঃ নিকোলের কোন ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো লাগে? ও অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতিও খুব সহজে সামলে নেয়। অন্যের কথা খুব মন দিয়ে শোনে ও।
নিকোলঃ চার্লির কোন বিষয়টা ভালোবাসি? ও আসলে অদম্য। কোন পিছুটান, লোকের কথা ওকে থামিয়ে রাখতে পারেনা।
চার্লি আর নিকোল; নাট্য নির্দেশক –অভিনেত্রী দম্পতি। দুজনের ভেতর ভালোবাসা আর নির্ভরতা প্রবল। কিন্তু এর মাঝেও আসে ক্লান্তি, নিজেকে খুঁজে পাবার তাড়না। আর তখনই বিচ্ছেদের রাস্তাটা বেছে নিতে হয় তাদের। হৃদয় বেদনার্ত হলেও লড়তে হয় একমাত্র সন্তানের অধিকার নিয়ে।
নোয়াহ বামবাকের চিত্রনাট্য এং পরিচালনায় বছরের সেরা আবেগপূর্ণ চলচ্চিত্র ‘Marriage Story’। এর মূল দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ৫ বার গোল্ডেন গ্লোব মনোনীতা স্কারলেট জোহানসেন এবং অস্কার মনোনয়ন প্রাপ্ত অ্যাডাম ড্রাইভার। এছাড়াও লরা ডারন, রে লিওটা, অ্যালান আল্ডা প্রমুখ রয়েছেন এতে। এর মধ্যেই গোল্ডেন গ্লোব, অস্কার, অ্যাক্টরস গিল্ডসহ বহু এ্যাওয়ার্ডের ডাক পেয়েছে এটি। অন্যদিকে ভেনিস ও নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কৃত হয়েছে Marriage Story। নেটফ্লিক্সে এটি মুক্তি পায় ৬ ডিসেম্বর। আইএমডিবিতে এর রেটিং ৮.২।
The King
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘Henriad’ নাট্যসমগ্র অবলম্বনে ব্রিটেন সম্রাট পঞ্চম হেনরির উত্থানের গল্পই হল ‘The King’। ১৪০ মিনিট রানটাইমের ইতিহাসভিত্তিক ড্রামা জনরার ছবিটি পরিচালনা করেছেন ডেভিড মিশোদ। নেটফ্লিক্সে এটি মুক্তি পায় নভেম্বরের ১ তারিখ।
পিতা চতুর্থ হেনরির মৃত্যুর পর সিংহাসনে আসীন হন পঞ্চম হেনরি। বাউন্ডুলে স্বভাবের হ্যাল (পঞ্চম হেনরি) পিতার যুদ্ধংদেহী মনোভাবের বিরোধিতা করে এসেছিলেন সবসময়ই। তাই সম্রাটের দায়িত্ব পেতেই যুদ্ধ বিগ্রহের প্রতি উদাসীন অবস্থান নেন তিনি। তরুণ রাজার বালখিল্যতাকে টিপ্পনী কাটতেই উপঢৌকন হিসেবে খেলার বল পাঠান ফ্রান্সের রাজা ষষ্ঠ চার্লস। ব্যাপারটা প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেও ঘটনার ভয়াবহতা সামনে আসে যখন হ্যাল জানতে পারে তাকে হত্যার জন্য আততায়ী নিয়োগ করেছেন চার্লস। এর পরিক্রমাতেই যুদ্ধ ঘোষণা করে হ্যাল এবং দীর্ঘ অপেক্ষার পর জয় করে নেয় গোটা ফ্রান্সকে। কিন্তু এতেই শেষ নয়। জয় উদযাপনের পরপরই হ্যাল আবিষ্কার করে এই রক্তপাত আর যুদ্ধের দামামা পুরোটাই ছিল বানোয়াট ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
ছবির মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন জুরিপ্রিয় অভিনেতা টিমোথি শ্যালামেট। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন লিলি রোজ ডেপ, রবার্ট প্যাটিনসন, শন হ্যারিস ও জোয়েল এডগারটন। পিরিয়ড ড্রামা হিসেবে নন্দিত হলেও ইতিহাসের সত্যতা নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ছবিটি। এর আইএমডিবি রেটিং ৭.৩।
El Camino: A Breaking Bad Movie
বিখ্যাত সিরিজ Breaking Bad এর সর্বশেষ সিজনের পরের কাহিনিই হলো ‘El Camino: A Breaking Bad Movie’। ২০০৮–১৩ সাল পর্যন্ত চলা ক্রাইম থ্রিলার জনরার এই সিরিজের ভক্তকুলের কথা মাথায় রেখেই ছবিটি নির্মাণ করেন এর পরিচালক ভিন্স গিলিগান।
২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর “Felina”এপিসোডের মাধ্যমে ‘Breaking Bad ‘ মহাকাব্যের সমাপ্তি ঘটে। শেষ পর্বে ওয়াল্টার হোয়াইট পরিবারের ভবিষ্যৎ, জেসের পরিণতির পুরো উত্তর মেলেনি। নিউ মেক্সিকোর পথে শেষমেশ কী ঘটেছিল? নতুন রাস্তায় কী অপেক্ষা করছে জেসের জন্য?
পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এই সিরিজ নিয়ে যে উন্মাদনা এতটুকু কমেনি তা বোঝা যায় ছবি মুক্তির ঘোষণার সাথে সাথেই। ১১ অক্টোবর মুক্তির দিনই ২.৬৫ মিলিয়ন দর্শক এটি উপভোগ করে। এতে অভিনয় করেছেন অ্যারন পল,জেস প্লেমন, চার্লস বেকারসহ অনেকেই। আইএমডিবির খাতায় এর মার্কস ৭.৪।
Extremely Wicked, Shockingly Evil and Vile
কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার টেড বান্ডির দীর্ঘদিনের প্রেমিকা এলিজাবেথ কেন্ডালের দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি হয়েছে এই ছবিটি। বছরের শুরুতে টেড বান্ডির জবানবন্দি প্রকাশ করে নেটফ্লিক্স। সেই খাতিরেই দর্শক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ছবিটি। চকলেট বয় জ্যাক এফ্রনকেও ভিন্ন রূপে দেখবার জন্যও ছবির কাটতি বাড়ে।
লিজ কেন্ডালের স্মৃতি কথা ‘The Phantom Prince: My Life with Ted Bundy’ এর অনুকরণে ১০৮ মিনিটের চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন জো বারলিঞ্জার। কৌতুহল থাকলেও হতাশই হতে হয়েছে এর দর্শকদের। চলচ্চিত্র সমালোচক বেঞ্জামিন লি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘ ছবিতে আসলে তেমন কিছুই ছিলনা। নিরামিষ কাহিনিতে টেডের খুনে চরিত্রের ভয়াবহতা অনুভব করতে পারবেননা আপনি। একমাত্র এফ্রনের অভিনয়ই ছিল নজর কাড়বার মতো।‘ আইএমডিবিতে ৬.৬ পাওয়া ছবিটি বক্স অফিসেও ব্যর্থ।
বিনোদন জগতের হাল হকিকতই বদলে দিয়েছে স্ট্রিমিং সাইট গুলো। নেটফ্লিক্স, এমাজন, হুলু, শোটাইমের পর ডিসেম্বরে রণক্ষেত্রে নেমেছে অ্যাপল প্লাস। সামনের দিনগুলোতে যে দর্শক চাহিদা এবং উন্নত কনটেন্টের চাহিদা আকাশচুম্বী সেকথা বলাই বাহুল্য।