নানকিং গণহত্যা (দ্য রেপ অফ নানকিং): সভ্য বিশ্বকে অবাক করে দেয়া জাপানি বর্বরতা1 min read
পূর্ব এশিয়ার দুই শক্তিশালী দেশ জাপান ও চীন একটা সময় ভূমি ও ক্ষমতা দখলের জন্য নিয়মিতভাবে একে অপরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়েছে। উনিশ শতকের শেষের দিকে জাপান সামরিক শক্তিতে প্রচণ্ড প্রতাপশালী হয়ে ওঠে। তারা কোরিয়া দখল করার সিদ্ধান্ত নেয়। চীনও কোরিয়া দখলের আরেক দাবিদার ছিল। ফলে ১৮৯৪ সালে কোরিয়াকে কেন্দ্র করে সংঘঠিত হয় প্রথম সাইনো-জাপানিজ যুদ্ধ। ১৮৯৪ সালে জাপান কোরিয়াতে অবস্থান করা চাইনিজ সেনাদের উপর হামলা করে। এক বছরের মাথায় সেই যুদ্ধে জাপান চীনকে পরাস্ত করে এবং কোরিয়াকে চাইনিজ শাসন থেকে স্বাধীন ঘোষণা করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে জাপান আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। তারা এশিয়ার নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমেই তারা মনোযোগী হয় চায়না দখলে। সেসময় চীন নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত। ন্যাশনালিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের কারণে সামরিক শক্তিতে চীন সেসময় জাপানের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। এই সুযোগটাই জাপান ভালোভাবে কাজে লাগায়।
১৯৩১ সালে জাপান চীনের মানচুরিয়ান অঞ্চল ও ১৯৩৩ সালে যেহোল (Jehol) প্রদেশ দখলে নেয়। এরপর তারা পুরো চীন আক্রমণ ও দখলের জন্য অজুহাত খুজছিল। ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে চীনের পিকিং (বর্তমান বেইজিং) অঞ্চলে সামরিক মহড়ায় নিযুক্ত চাইনিজ সেনা ও জাপানিজ সেনাদের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাকে কেন্দ্রে করে জাপানিজরা চীনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ চালানোর অজুহাত পেয়ে যায়।
জাপানিজ সেনারা চীনের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে আক্রমণ করে এবং তেমন কোন বাধা ছাড়াই চীনের রাজধানী পিকিং দখলে নেয়। জাপানিজরা এই যুদ্ধে ইচ্ছা করেই চরম বর্বরতা চালায়। তারা ভেবেছিল তাদের বর্বরতা দেখে চাইনিজ সেনারা ভয় পেয়ে তাদের কাছে নতি স্বীকার করবে। কিন্তু অপর্যাপ্ত অস্ত্র নিয়ে স্বল্প প্রশিক্ষিত চীনা সেনা ও কমিউনিস্ট সমর্থকরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। জাপানিজ সেনারা চীনা প্রতিরোধের প্রতিক্রিয়ায় পুরো সভ্য বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে মানব ইতিহাসের অন্যতম বর্বর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও লুটপাট চালায়।

চীনের উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই জাপানিজরা চীনের পূর্ব উপকূলীয় এলাকা সাংহাইতে আক্রমণ করে। চাইনিজ ন্যাশনালিস্ট সেনাদের প্রতিরোধ সত্ত্বেও ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে জাপানিজরা সাংহাইয়ের দখল নেয়। সাংহাই দখল করার ফলে জাপানিজ সেনাদের ইয়াংসি (Yangze) নদীর দিকে যাওয়া সহজ হয়ে যায় এবং চীনা ন্যাশনালিস্টদের রাজধানী নানকিং (বর্তমানে নানজিং) দখলের পথ অবমুক্ত হয়।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সময়কালে জাপানিজদের হাতে চীনের হতভাগ্য জনগণ যে নৃশংস অত্যাচার সহ্য করেছে তার সবটুকু এখানে তুলে আনা সম্ভব নয়। এই লেখায় আমরা কেবলমাত্র দ্য রেইপ অফ নানকিং (নানকিং ম্যাসাকার) সম্পর্কে জানবো।

দ্য রেইপ অফ নানকিং (নানকিং ম্যাসাকার)
নানকিং প্রদেশ দখলের পথে চীনা প্রতিরোধে জাপানিজরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে যখন নানকিং পুরোপুরি জাপানিজদের দখলে চলে আসে তখন জাপানিজ সেনারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে আত্মসমর্পণকারী হাজার হাজার চীনা সৈন্যকে হত্যা করে। প্রায় ২০ হাজার চীনা যুবককে নানকিং শহরের বাইরে নিয়ে গিয়ে বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। এরপর জাপানিজ কর্মকর্তারা তাদের সেনাদের নানকিং লুট করতে এবং চীনা জনগণকে জবাই ও ধর্ষণ করতে উৎসাহিত করে।
টানা ছয় সপ্তাহ নানকিংয়ে বাস করা চীনাদের জন্য জীবন এক দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে। একদল মাতাল জাপানিজ সেনা ইচ্ছামতো পুরো নানকিং জুড়ে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাট চালায়। চাইনিজ সাধারণ জনগণকে রাস্তায় থামিয়ে তাদের লুট করা হতো। যদি কারো কাছে মূল্যবান কিছু না পাওয়া যেত তাহলে সাথে সাথেই তাদের হত্যা করা হতো। নানকিং দখলের প্রথম চার সপ্তাহে জাপানিজ সেনারা কমপক্ষে বিশ হাজার চীনা মহিলাকে ধর্ষণ করে। তাদের হাত থেকে কম বয়সী মেয়েরাও বাদ যায় নি। অপ্রাপ্তবয়স্ক চীনা মেয়েদের যোনিপথ কেটে জাপানিজরা তাদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হতো।

জাপানিজ কর্মকর্তারা তাদের সেনাদের চীনা জনগণকে হত্যা করার জন্য আরও ভয়াবহ উপায় খুজতে বলে। কারণ জবাই করা চাইনিজদের রক্তের স্রোত তাদের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠছিল। তারা চীনাদের জীবন্ত কবর দেয়া শুরু করে, অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলে। জীবন্ত চাইনিজকে অর্ধেক পুতে ফেলে ক্ষুধার্ত কুকুর ছেড়ে দেয়া হয়। আর ইয়াংসি নদীর পানি পুরোপুরি লাল না হওয়া পর্যন্ত সেখানে জবাইয়ের শিকার হওয়া হাজার হাজার মানুষের লাশ ফেলে দেয়া হয়। নানকিং শহরে লুট করার মতো কিছু অবশিষ্ট না থাকায় এক সময় জাপানিজরা শহরের এক-তৃতীয়াংশ জ্বালিয়ে দেয়।
জার্মান ব্যবসায়ী ও নাৎসি পার্টির সদস্য জন রাবে (Jhon Rabe) সেসময় নানকিং শহরের “ইন্টারন্যাশনাল সেফটি জোন”-এ অবস্থান করছিলেন। তিনি জাপানি সেনাদের বর্বতার শিকার হওয়া চাইনিজ বেসামরিক নাগরিকদের লাশ দেখে অবাক হয়েছিলেন। পুরুষ, মহিলা, বৃদ্ধ, শিশু- কেউই রক্ষা পায়নি জাপানিজদের হাত থেকে। জন রাবে তার আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বলয়ে অনেক চাইনিজকে জায়গা দিয়ে রক্ষা করেছিলেন। তিনি চীনাদের রক্ষায় অ্যাডলফ হিটলারের হস্তক্ষেপের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু নাৎসি নেতা তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। জন রাবে নানকিং-এ জাপানিজদের গণহত্যার বর্ণনা দিয়ে ১৯৯৬ সালে তার একটি ডায়েরী প্রকাশ করেছিলেন।

জাপানিজ সেনারা তাদের নানকিং বিজয়ের উল্লাস ধরে রাখতে অস্ত্র হাতে চাইনিজদের লাশের পাশে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলে। জাপানি সেনা কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতা আস্তে আস্তে বিদেশ পর্যবেক্ষক, পত্রিকা ও সংবাদাতাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এতে জাপানিজ হাই কমান্ড নানকিং এ তাদের নৃশংতার সকল প্রমাণ মুছে ফেলতে সচেষ্ট হয়।
ফার ইস্ট (টোকিও ওয়ার ক্রাইম ট্রায়ালস) আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা এটি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন যে, নানকিং পতনের ছয় সপ্তাহের মধ্যে জাপানিজরা কমপক্ষে ২ লাখ চীনা বেসামরিক ও যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করেছিল। বিচারকরা এটি মানতেও প্রস্তুত ছিলেন যে, গর্তে এবং নদীতে ফেলে দেওয়া লাশগুলো হিসেবে নিলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে। ইতিহাসবিদরা মনে করে নানকিং ম্যাসাকারে কম করে হলেও ৩ লাখ ৭০ হাজার চীনা নাগরিককে প্রাণ হারাতে হয়েছে।

এটি তো ছিল কেবল এক নানকিং এর হিসেব। ইতিহাসবিদরা মনে করেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে চীনের বিরুদ্ধে জাপানের অলিখিত যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কয়েক মিলিয়ন চীনা নাগরিক ও যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করা হয়েছে।
নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শী ও ফটোগ্রাফিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও জাপান সরকার নানকিং গণহত্যা এখনো অস্বীকার করে। ১৯৩৭-১৯৪৫ সালের ইতিহাস জাপানি স্কুলে বিকৃত করে পড়ানো হয়। “নানজিং ম্যাসাকার” জাপানিদের বইয়ের “নানজিং ইনসিডেন্ট” নামে জায়গা পেয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে দুই পক্ষের যুদ্ধের সময় কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। নানজিং এর গণহত্যা কিংবা গণধর্ষণের উল্লেখ জাপানিজ ইতিহাসে নেই।
লেখক- হাসান উজ জামান