নাদিয়া গুলাম- নারী হয়েও ১০ বছর পুরুষের বেশে1 min read
Reading Time: 5 minutesসবেমাত্র প্লেন ল্যান্ড করেছে। দরজা ঠেলে বেড়িয়ে এল এক ২১ বছর বয়সী আফগান যুবক। পরনে আফগানি পোশাক আর মাথায় পাগড়ী। জীবনে এই প্রথম আফিগানিস্তানের বাইরে পা রাখা এই যুবক কেবলমাত্র আমেরিকা আর রাশিয়া ছাড়া আর কোন দেশের নাম শোনে নি, সেই দুটো দেশ যারা তাদের দখল করতে এসেছিল। অবাক বিস্ময়ে দেখছিল ঝাঁ চকচকে পৃথিবীকে, পারফিউম আর লিপস্টিকে সজ্জিত মেয়েদের। একটি ব্যাগে কিছু কাপড়, একটি কুরআন আর একটি নকল পরিচয় নিয়ে মুক্তির খোঁজে এসেছিল। মুক্তি তালেবানদের শোষণ থেকে, তার চেয়েও বড় মুক্তি নিজের ছদ্ম পরিচয় থেকে, জেলমাই থেকে নাদিয়া হবার মুক্তি।
কখনো কৃষক, কখনো তালেবানদের রান্নার রাধুনি আবার কখনো ইমাম- ৩৪ বছর বয়সী এই আফগান নারী তার একজীবনে হাজার জীবন যাপন করেছেন অন্য এক পরিচয়ে- তার মৃত ভাই জেলমাই এর পরিচয়ে। সম্প্রতি প্রকাশিত তার আত্মজীবনী Hidden Under My Turban বইয়ে তিনি তার এই জীবন তুলে ধরেছেন।
“আমার একটি মেয়ে আছে যে একাই সাতটা ছেলের সমান”, উচ্ছ্বসিত নাদিয়ার মা জানান। তার মেয়ের আত্মজীবনী পড়ে আপ্লুত মা মেয়েকে নিয়ে করেন গর্ব। বইয়ে নাদিয়া বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন তালেবানদের আবির্ভাবের পর কিভাবে বদলে গিয়েছিল তার জীবন।
বোমা এবং ব্যথা
১৯৯২ সালে আফগানিস্তানে নাদিয়ার বাসায় বোমা হামলা হলে বদলে যায় দৃশ্যপট। আট বছরের নাদিয়া মেধাবি, চটপটে, তার ভাইয়ের চেয়েও। দিনটি ছিল শুক্রবার, পবিত্র দিন, নামাযের দিন। মায়ের পিছে পিছে রান্না ঘরে গিয়েছিল নাদিয়া। হঠাৎই বিকট শব্দে সব অন্ধকার। বেঁচে ফিরলেই বিকৃত হয়ে যায় নাদিয়ার চেহারা। নরক যেন ভর করে ছোট্ট নাদিয়ার শরীরে। খোঁজ পাওয়া যায় না নাদিয়ার ভাইয়ের। এর ফলে নাদিয়া এবং আরো তিন কন্যা সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েন তার মা। সব হারিয়ে নাদিয়ার পরিবার জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেয় জালালাবাদের একটি শরণার্থী শিবিরে। হাসপাতাল থেকেও ফিরিয়ে দেয়া হয় নাদিয়াকে। শরীর ভর্তি জখম আর ঘা নিয়ে নাদিয়া শিবিরে পড়ে থাকে। এমন সময় এক জার্মান স্বেচ্ছাসেবী দল তার চিকিৎসার ভার নেয়। অতটুকুন বয়সেই পড়ে আটটা অপারেশন। নাদিয়া স্মরণ করেন, “আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসি যেন একটি জীবন্ত মমি হয়ে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়া”।
কিন্ত অধৈর্য্য হয়ে ওঠেন নাদিয়ার মা। না তিনি ক্যাম্পে মানিয়ে নিতে পারেন, না পশতু ভাষা বোঝেন, না পারেন সবার সাথে মিশতে। তাই সিদ্ধান্ত হয় ফিরে যাবেন তারা কাবুলে, নিজ ভূমিতে।
বছর পার হয়ে যায়, মুজাহিদিনরা পালিয়ে যায় কাবুল ছেড়ে। তাদের মাথায় পাগড়ি আর চোখে সুরমা দেয়া একদল মানুষ। যারা দাবি করেন তারা শান্তি এনেছেন। অবশ্য সাথে এনেছে হাতিয়ার। মেয়েদের বাইরে যাওয়া বন্ধ। পুরুষদের দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক। এত চাপে আর স্বৈরাচারীপরিবেশে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যায় নাদিয়ার বাবা। বোমা হামলায় আহত, হতাশ, কিছু করার জন্য মরিয়া নাদিয়া সিদ্ধান্ত নেন নিজের পরিবারকে বাঁচাতে হলে তার হারানো ভাইয়ের পরিচয় ধারণ করে হলেও কাজে নামতে হবে। মাত্র ১১ বছর বয়সে নাদিয়া হয়ে গেল জেলমাই। সময়টা তখন ১৯৯৬।
সেদিন থেকে নাদিয়া তার চুল ঢেকে ফেলে পাগড়ির নিচে, বুকে শক্ত করে বাধে লম্বা কাপড়ের টুকরা যাতে শরীরের অবয়ব না বোঝা যায়, ব্যবহারেও আনে আমূল পরিবর্তন– কখনো কর্কশ, কখনো বদমেজাজি। বাড়িতে মাকে ২৪ ঘন্টা পাঠ পড়ায়- জেলমাই, জেলমাই, জেলমাই। যাতে মা নাদিয়াকে এই নাম ডাকতেই অভ্যস্থ হয়। বোনেরা ভুল করে নাদিয়া ডেকে ফেললে চলত প্রহার।
“আমি জানতাম না আমাকে এত কষ্ট সহ্য করতে হবে”, জীবনের এই প্রান্তে এসে জানান নাদিয়া। “আমি জানতাম না এটা এত কঠিন হবে। আমি নিজেকে নিজে বলতাম, মাত্র কিছুদিনের ব্যাপার, সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি আবার নাদিয়া হয়ে যাব”। কিন্তু ছোট্ট নাদিয়া জানত না দশ বছর কি ঝড় অপেক্ষা করছে তার জন্য।
সর্বদা সতর্ক
কৃষকের সহকারী হিসেবে নাদিয়া যোগ দেন “বিসমিল্লাহ আস্তাবল”- এ যেখানে তাকে প্রতিদিন বেগুন আর টমেটো তুলতে হত। একদিন আস্তাবলের মালিক তাকে কুয়া পরিস্কার করতে দেন। অসাবধানতাবশত কুয়ায় পড়ে যান তিনি। কিন্ত দম বন্ধ হওয়া স্বত্বেও তিনি তার জামা খুলতে পারেননি, যদি সব ফাঁস হয়ে যায়! কিন্তু ঈশ্বরের আশীর্বাদে বেঁচে ফেরেন তিনি। এ যাত্রা বেঁচে ফিরলেও বাচঁতে পারেন না বয়ঃসন্ধির হাত থেকে। বয়ঃসন্ধিতে শরীরের পরিবর্তন ঠেকাতে তিনি ছয়মাস টানা রোজা রাখেন। ভেবেছিলেন হয় এতে শরীরের বৃদ্ধি আটকাতে পারবেন, কিন্ত না, হেরে জান জেনেটিক্সের কাছে। শরীর বাড়তেই থাকে, সাথে বাড়তে থাকে লুকানোর কষ্ট! আরো শক্ত করে বুকে কাপড় বাঁধেন।
অনেক বছর পর আজ নাদিয়া ছোট করে চুল রাখেন, নিজের ইচ্ছেমতো কাপড় পড়েন। তিনি স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বলেন, “ বার্সালোনায় চলে আসার পর যেদিন প্রথম একজন মেয়েকে রাস্তায় হিজাব ছাড়া, কোন সঙ্গী পুরুষ মানুষ ছাড়াই হাটতে দেখি আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি ভেবেছিলাম তার পোষাকের জন্য তার বিপদ হতে পারে। আমি তাকে বাঁচাতে চাইছিলাম”।
ফিরে যাই তার জীবনে। নাদিয়া যখন জেলমাই। পরিবার চালাতে নাদিয়া বেনী কেটে ফেলতেন। তালেবানরা এলে তিনি ভয়ে কাঁপতেন, মেয়েবেলার শারীরিক পরিবর্তনে তিনি ভয় পেতেন। মনে করতেন কেউ না কেউ বুঝে ফেলবে। “বেশিরভাগ সময় মানুষ যখন আমার দিকে তাকাতো আমার মনে হত তারা বুঝি আমার সত্যতা জেনে ফেলবে”, অতীত মনে করেন নাদিয়া। তাকে চলাফেরা, কথা বার্তায় খুব সাবধানে চলতে হত। যেন কেউ বুঝতে না পারে। ছেলেরা যা যা করত সবই তিনি করতেন। মেয়েদের নাচ দেখতে যেতেন, ধুমপান করতেন, যেতেন সিনেমা দেখতে, এমনকি ভর্তি হিয়ে ছিলেন স্কুলেও।
সব চলছিল ঠিকঠাকমতো, কিন্ত ভাগ্যের কি খেলা! স্থানীয় মোল্লা তাকে তার ছত্রছায়ায় নেন। নাদিয়া হয়ে ওঠেন তার প্রিয় শিষ্য। কিন্ত হঠাৎই একদিন মোল্লা জিজ্ঞেস করেন, “আজকে কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবে? আজ ফযরের নামাযের সময় ইমামতি করবে তুমি। হাঁটুর ব্যাথায় আমি মনে হয় আর পারব না”। নাদিয়া ভাবেন ঈশ্বর না জানি আর কি কি পরীক্ষা রেখেছেন।
লোকাল ইমাম হিসেবে তালেবান নাদিয়াকে দায়িত্ব দেয় আশেপাশের এলাকা থেকে ছেলে, যুবক এবং বৃদ্ধদের ধরে ধরে মসজিদে আনতে আর যদি তারা না মানে তাহকে তাদের পিটিয়ে নিয়ে আসতে। নাদিয়া লেখেন, “আমার হাতে লাঠি নিয়ে আমি যখন বাচ্চা ছেলেদের মারছিলাম, আমি বুঝতে পারছিলাম ঈশ্বরের অনেক দয়া কিন্ত ইশ্বরের তৈরি মানুষ কত নিষ্ঠুর”!
অসম্ভব ভালবাসা
সারাদিনের অসম্ভব খাটা খাটুনির পর একটু খানি আদর যত্ম মিলত আস্তাবলের মালিক বিসমিল্লাহর মেয়ে ওয়াসিমার কাছ থেকে। একটু খানি সহচার্য আর সাহস দিয়ে নাদিয়ার জীবনকে হয়ত খানিকটা সহজ করে তুলেছিল ওয়াসিমা। ওয়াসিমার কাছে নাদিয়া ছিল জেলমাই, তার ভালবাসা। কিন্ত শুধু নাদিয়াই জানত তা ছিল অসম্ভব। অসম্ভব ভালবাসা আরো একবার এসেছিল নাদিয়ার জীবনে, ১৭ বছর বয়সে৷ তারই ক্লাসের এক ছাত্র, আহমান। আহমান জানত না নাদিয়ার আসল পরিচয়। “আমি আমার অনুভুতি গুলো লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করতাম”, বইয়ে লেখেন নাদিয়া। “ আমি নামাজে বসে কান্নাকাটি করতাম যেন আমি প্রেমে না পড়ি”।
মুক্তির আলো
ছেলের ছদ্মবেশে নাদিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পান।
২০০৭ সালে, তার সারার সাথে পরিচয় হয়। সারা তখন CaWaf নামক একটি এনজিও সংস্থার কর্মী ছিলেন যিনি আফগান নারীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন। তার পৃষ্ঠপোষকের সহায়তায় নাদিয়াকে তার বোমার আঘাতের ক্ষতের চিকিৎসা করাতে স্পেনে পাঠানো হয়। স্পেন থেকে তিনি পরে বার্সালোনায় চলে আসেন এবং গত ১২ বছর তিনি এখানেই আছেন। “আমি প্রতি রাতেই দুঃস্বপ্ন দেখি”, জানান নাদিয়া, “যেন এর থেকে আমার মুক্তি নেই”।
সেই দ্বৈত পরিচয়ের জীবন ছেড়ে এসে নাদিয়া এখন গাড়ি চালান, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হন- সবই করেন নাদিয়া হিসেবে, একজন মেয়ে হিসেবে। অবশ্য তিনি জানেন এই বই প্রকাশের মাধ্যমে তার জীবনের ঝুঁকি আছে। তার মনে হয় কিছু খারাপ ঘটতে পারে তার জীবনে।
যদিও বছরে একবার তিনি কাবুল যান, যেখানে তার পরিবার এখনো রয়েছে। তিনি জেলমাই হিসেবেই সেখানে যান। তার মা এখনো তাকে ছেলে বলে ভাবতেই পছন্দ করেন।
নাদিয়া পাকাপাকিভাবেই মাতৃভূমি ফিরতে চান এবং চান সহায়তা। তিনি দেশে ফিরে মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চান। তিনি চান তার জীবন যুদ্ধ যেন আফগানিস্তানের বাকি মেয়েদেরও উদ্বুদ্ধ করে। যে আলোর জন্য তিনি অন্ধকার ছেড়ে এসেছিলেন, সেই পথে যেন অন্য মেয়েরাও চলে।