ইতিহাস

দ্য ব্ল্যাক ডেথঃ ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক মহামারী1 min read

এপ্রিল ১৫, ২০২০ 4 min read

author:

দ্য ব্ল্যাক ডেথঃ ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক মহামারী1 min read

Reading Time: 4 minutes

তেরশো শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্ল্যাক ডেথ নামক একটি মহামারীর ভয়াবহতা অবলোকন করতে হয়েছিল মানব জাতিকে। ব্ল্যাক ডেথ নামে একে আখ্যায়িত করা হলেও আমরা অনেকেই এই মৃত্যুর ভয়াল থাবা’কে প্লেগ নামেও চিনে থাকি। বিশ্ব মানচিত্র কাঁপিয়ে দেয়া ভয়ংকর কোন অসুখের নাম বলতে গেলে প্রসঙ্গ ক্রমে প্লেগের নামটি চলে আসবেই। ইতিহাসের পাতা জুড়ে সময়ের সাথে সাথে প্লেগ রোগটিকে বিভিন্ন নামে অলংকরণ করা হলেও, কোন নামই যেন এই রোগটির ভয়াবহতার স্বরূপ প্রকাশ করতে সক্ষম হয়ে উঠেনি।

প্রথমবারের মতো যখন রোমান সাম্রাজ্যে এই রোগটি হানা দেয়, তখন একে ‘জাস্টিয়ান প্লেগ’ নামে নামকরণ করা হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে রোমান সম্রাট জাস্টিয়ান এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন বলে তার নামে এর নামকরণ করা হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে এই জাস্টিয়ান প্লেগের কালো থাবার ছায়াতলে মাথা পেতে দিতে হয়েছিল প্রায় আড়াই থেকে পাঁচ কোটি জীবনকে। মৃত্যু ক্ষুধায় কাতর এই রোগটি এতগুলো প্রাণ কেড়ে নেয়ার পরেও তার তান্ডব থামায় নি। ১৩৪৭ সালের দিকে অমানিশার অন্ধকারের মতোই পৃথিবীতে হানা দিয়ে আরেকটি মৃত্যু উৎসবের সূচনা করেছিল এই প্লেগ! তখন তার পুনরায় নামকরণ করা হয়েছিল ‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ’ নামে!

১৩৪৭ সালে কৃষ্ণ সাগর থেকে ফিরে আসা ১২টি জাহাজ থেকেই মূলত এই রোগটি ইউরোপে আগমন করে। এই ১২টি জাহাজ যখন বন্দরে এসে থামে, তখন আশেপাশের মানুষ এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখে রীতিমত যেন চমকে উঠে। জাহাজের বেশীরভাগ নাবিকই মৃত্যু বরণ করেছিলেন, আর যারা বেঁচে ছিলেন তারাও যেন তীব্র যন্ত্রণায় মানস চক্ষে নিজেদের মৃত্যু দেখছিলেন সামনাসামনি। কেননা তাদের সবার শরীর ছিল রক্ত আর পুঁজ মিশ্রিত বড় বড় ফোঁড়া দিয়ে ভর্তি।

ভয়ানক এই দৃশ্য দেখে চমকে উঠেছিল কর্তৃপক্ষও! যদিও সাথে সাথেই জাহাজগুলোকে বন্দর থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছিল, তবুও মনে হয় একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী পাঁচ বছরে ইউরোপে প্রায় দুই কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই ভয়াহব প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবে।

কীভাবে ব্ল্যাক ডেথ স্বমূর্তি ধারণ করেছিল? 

জাহাজে করে ব্ল্যাক ডেথের আগমন হলেও, ইউরোপে জোরালো গুঞ্জন উঠেছিল যে এই রোগটি ইতিমধ্যেই চীন, ইন্ডিয়া, পারস্য, সিরিয়া এবং মিশরের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ইউরোপিয়ানরা হয়ত তখনও ভাবতে পারেননি সুদূর পূর্ব দিক থেকে এই মহামারীর আগমন ঘটবে আর সবকিছু ওলটপালট করে দিবে।

ধারণা করা হয় যে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এশিয়াতেই এই ভয়াবহ রোগটির উৎপত্তি ঘটে এবং বাণিজ্য করতে আসা বিভিন্ন জাহাজে করেই রোগটি ধীরে ধীরে আরো অনেক দেশে ছড়িয়ে পরে।

এই রোগটি ঠিক যতটা না জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল তার চেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছিল এই রোগটির লক্ষণগুলো। এমন বীভৎস মৃত্যুর হাতে জীবন সপে দেয়ার জন্য তখনও ইউরোপিয়ানরা প্রস্তুত ছিল না। তবুও এই বীভৎস দৃশ্য দেখতে হয়েছিল পুরো ইউরোপকে। এই রোগে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির শরীর খুব অদ্ভুতভাবে ফুলে উঠে এবং শরীরের বিভিন্ন যায়গায় ফোঁড়ার মত হয়ে সেখান থেকে রক্ত আর পুঁজ বের হতে থাকে। এর পাশাপাশি জ্বর সর্দি আর বমির দেখা যেত আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে, এমনকি কারো কারো ডায়রিয়াও হত। তবে পুরো শরীরে ভয়াবহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো সবাইকে। মহামারী আকার ধারণ করে নেয়া এই রোগটি যদি কাউকে আক্রান্ত করতো তাহলে ভয়াবহ যন্ত্রণাময় একটি মৃত্যুর করাঘাত তার জন্য অবধারিত হয়ে যেত।

খুব দ্রুতই মহামারী আকার ধারণ করা এই রোগটি মূলত অন্যান্য আর সব কটা মহামারীর মতই ছোঁয়াচে ছিল। তৎকালীন সময়ে ইতালীয় কবি জিওভান্নি বোক্কাচিও লিখেছিলেন, “প্রথমেই আক্রান্ত ব্যক্তির কবজি অথবা বগলের নিচে টিউমারের মত কিছু একটা দেখা যেত। আর ধীরে ধীরে এটা এতই বড় হয়ে যেত যে সেটা একটা আপেলের মত আকৃতি ধারণা করত। এক সময় সেটা ফেটে পুঁজ আর রক্ত বের হয়ে আসত। সে এক বীভৎস দৃশ্য, এমন দৃশ্য সহ্য করতে না পারলেও অদৃষ্ট যেন ক্রূর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। যে ভয়াল দৃষ্টির প্রকোপে ইউরোপে তৎকালীন সময়ের এক তৃতীয়াংশ মানুষের ভাগ্যে লিখে দিয়েছিল এই অসহ্য ও বেদনাদায়ক মৃত্যু!”

কেমন ধরনের রোগ ছিল এই ব্ল্যাক ডেথ?

হ্যাঁ! বর্তমান সময়ে আমরা জানি প্লেগ রোগটি কি আর এটা কীভাবে ছড়ায়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এসে আলেকজান্দ্রায়ে ইয়ারনিস নামক একজন ফরাসি বিজ্ঞানী এই প্লেগ রোগের জীবাণু (ব্যাসিলাস) আবিষ্কার করেছিলেন।

ব্যাসিলাস নামক এই জীবাণুটি মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে সংস্পর্শ, বাতাস, আক্রান্ত মাছি এবং ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়াত। তৎকালীন সময়ে ইউরোপীয় অঞ্চলগুলোর প্রায় সবখানেই এই মাছি এবং ইঁদুর দেখা যেতই। বিশেষ করে বাণিজ্য জাহাজগুলোতে তো এগুলোর কোন কমতি ছিল না। আর এভাবেই মানুষের সংস্পর্শে ছাড়াও জাহাজে আক্রান্ত মাছি এবং ইঁদুরের মাধ্যমেও লোকালয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে এই রোগটি খুবই দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হয়।

ইতালির মেসিনাতে ছোবল দেয়ার পরই থেমে থাকেনি এই মহামারী! ধীরে ধীরে ফ্রান্স বন্দর নগর মসির্লিস সহ আফ্রিকার উত্তর অঞ্চলের আরেকটি বন্দর নগরী তিউনিসে ছড়িয়ে পরে। রোম ও ফ্লোরেস্নেও ছড়িয়ে যায় এই জীবাণুর সংক্রমণ। ১৩৪৮ সালের জুন জুলাইয়ের দিকে প্যারিস, নিয়ন এবং বর্তমানে বিখ্যাত নগরী লন্ডনেও ছোবল দেয় এই মৃত্যুদুত!

তখনকার সময় মানুষের জানা ছিল না একটি রোগ কীভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তারা জানতই না মানুষের সংস্পর্শ ছাড়াও ইঁদুর ও মাছির মাধ্যমেও এই রোগটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো ইউরোপের মানচিত্র জুড়ে। বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার তখন মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। তৎকালীন অনেক চিকিৎসকদের ধারণা ছিল জমে থাকা পুঁজ আর রক্ত বের করে দিলেই মিলবে রোগ মুক্তি। আবার অনেকে মনে করতো সুগন্ধি দিয়ে গোসল করালেই এই রোগের সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকা যাবে।

এই ভয়ানক রোগটি শুধু মানুষের মৃত্যুতে থেমে থাকেনি বরং শহর থেকে পালিয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য যারা গ্রামে চলে গিয়েছিল তাদের গবাদি পশুরাও মরে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। ভয়াবহ এই রোগ থেকে বাঁচার কোন উপায় কেউ খুঁজে পাচ্ছিল না, আপনজন ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, ভেড়া মুরগি শুকর সব মরে সাফ!

ঈশ্বরের ক্রূর অভিশাপ? 

সে সময়ের মানুষদের মধ্যে জীব বিজ্ঞানের জ্ঞান ছিল খুবই সামান্য। কীভাবে একটি জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে সে সম্পর্কে অনেকেই ছিল পুরোপুরি অজ্ঞ। আর তাই নিয়তির এই অমোঘ করাঘাতকে তখন অনেকেই ঈশ্বরের অভিশাপ অথবা শাস্তি বলেও মাথা পেতে নিয়েছিল। সমাজে পুঞ্জিভূত হতে থাকা পাপমুক্তির জন্যই ঈশ্বর এই রোগ দিয়ে মানুষকে শাস্তি দিচ্ছিল বলে তৎকালীন সকলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল।

তারা মনে করতে শুরু করেছিল, চিকিৎসা বিজ্ঞান নয় বরং ঈশ্বরের ক্ষমা প্রাপ্তির মাধ্যমেই কেবল মাত্র মিলতে পারে এই রোগ হতে মুক্তি। এই রোগটি শুধু মানুষকেই আক্রমণ করেনি বরং এর প্রভাব পড়েছিল মানুষের বিবেকের উপরেও। কিছু মানুষ বিশ্বাস করা শুরু করেছিলেন যে অন্য ধর্মাবলম্বীদের এবং ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের মেরে ফেলতে পারলেই ঈশ্বরের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব!

অনেকে ধারণা ছিল ইহুদীদের কারণেই এই রোগটি ঈশ্বর তাদের উপর অভিশাপ রূপে দিয়েছেন। আর ফলাফল স্বরূপ ১৩৪৮ সাল থেকে ১৩৪৯ সাল পর্যন্ত হাজার হাজার ইহুদীকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল। না! তারা কোন রোগের কারণে মারা যান নি বরং কুসংস্কারের কারণে বিবেকহীনদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা গণহত্যা নামক মৃত্যুর উৎসবের আঘাতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল হাজারো নিষ্পাপ ইহুদীদের।

যেভাবে ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে থাকল ব্ল্যাক ডেথের মৃত্যু ক্ষুধা! 

মহামারী আকার ধারণ করা ব্ল্যাক ডেথ নামক প্লেগ রোগটি ১৩৫০ সালের শুরুর দিকে কিছুটা প্রশমিত হলেও শত বছর পরপর এটি মানুষের মাঝে ফিরে আসতে থাকে। তবে ধীরে ধীরে সচেতন হতে থাকা এবং আধুনিক পরিষ্কার পরিছন্নতার ব্যবস্থার কারণে এই রোগটি অতটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। অনেকেই মনে করে থাকেন ব্ল্যাক ডেথ এখনো পুরোপুরি ভাবে কালের গর্ভে হারিয়ে যায় নি, কেননা এখনো প্রতি বছর এক হাজার থেকে তিন হাজারের মত প্লেগ রোগে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কারণে সেই লক্ষণগুলো এখন আর মহামারী আঁকার ধারণ করতে পারে না।

লেখক- ইকবাল মাহমুদ ইকু 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *