ইতিহাস

ভারতবর্ষে দ্বিজাতি তত্ত্বের কি খুব প্রয়োজন ছিল?1 min read

নভেম্বর ৯, ২০১৯ 4 min read

author:

ভারতবর্ষে দ্বিজাতি তত্ত্বের কি খুব প্রয়োজন ছিল?1 min read

Reading Time: 4 minutes

ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি মারাত্নক ট্রাজেডি আছে। একটি ১৮৫৭ সালে– যখন ব্রিটিশরা উপমহাদেশে প্রবেশ করেছিল। আরেকটি ১৯৪৭ সালে– যখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিয়েছিল। প্রশ্ন হতে পারে, ১৯৪৭ কেন ট্রাজেডি? তখন তো ওরা আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছিল। হ্যাঁ, ইংরেজরা আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তারা আমাদের মাঝখানে চির ফাটল ধরিয়ে উপমহাদেশ ত্যাগ করেছিল। যার গ্লানি আমরা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি।

দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা

দ্বিজাতি তত্ত্ব হলো একটি রাজনৈতিক মতবাদ। ধারণা করা হয়, স্যার সৈয়দ আহমদ খান সর্বপ্রথম এটি জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। এটি ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত করার একটি মতবাদ।

১৯০৯ সালে ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্র

১৯৪০ এর পর থেকেই ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। একদিকে ভারতের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস– যার নীতি হলো সমগ্র ভারত এক জাতি। অন্যদিকে মুসলিম লীগ– যারা স্বতন্ত্রে বিশ্বাসী। মুসলিম লীগ কেন মুসলমানদের আলাদা করতে চায় তা সময়মতো বলা হবে। এখন বলছি স্যার সৈয়দ আহমদ খানের দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা।

সমগ্র ভারতবর্ষ যখন জাতীয়তাবাদে উত্তাল, তখন সৈয়দ আহমদ ভারতের মুসলমানদেরকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গা না ভাসিয়ে নিজেদের আলাদা জাতি হিসেবে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার আহবান জানান। তাঁর এ মতবাদ মুসলিম লীগের তৎকালীন শাসকদের কাছে মধুর মতো লেগেছিল। কেননা তিনি মুসলিম লীগের কাজকে দু’ধাপ এগিয়ে দিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে সৈয়দ আহমদের মতবাদের সঙ্গে সুর মেলান কবি ও দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবাল। তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বকে আরো খোলাসা করে সবার সামনে আনেন। ১৯৩০ সালে মুহাম্মদ ইকবাল সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে এ সম্পর্কে বলেন যে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মাত্র আট কোটি মুসলমান। সকলের মাঝে এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই এর সমাধান হিসেবে হয় ব্রিটিশদের গোলামী করতে হবে নয়তো সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা হয়ে যেতে হবে।

তবে ১৯৪০ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে দ্বিজাতিতত্ত্বের স্পষ্ট ধারণা দেন। তাই তাঁকেই এর প্রবক্তা বলা হয়। তিনি বলেন, “হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই দুটি পৃথক অবস্থার মধ্যে অবস্থান করে। তারা কখনো নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয় না বা একসঙ্গে কোন অনুষ্ঠানও করে না এবং প্রকৃত অর্থেই তারা পৃথক মেরুতে অবস্থানকারী পৃথক দুটি জাতি। প্রায়ই দেখা গিয়েছে যে, এক জাতির নায়ক অন্য জাতির খলনায়ক, একের বিজয়গাঁথা অন্যের পরাজয়কে চিহ্নিত করে। এভাবে এক আঙ্গিকে দুটি জাতিকে একটি একক রাষ্ট্রের অধীনে আনার যেকোন প্রয়াসের ক্ষেত্রে অসন্তোষ দেখা দিবে এবং এ ধরণের যেকোন প্রয়াসই চূড়ান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।”

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

কেন এই জাতি বিভাজন

মুসলিম লীগ চেয়েছিল মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি। কিন্তু কংগ্রেস সেটা মানতে নারাজ ছিল। তারা বলেছিল, ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ, কোনমতেই একে বিভাজন করা চলবে না। এদিক থেকে দল দুটি দ্বিমত পোষণ করলেও একটা নীতিতে তাদের আবার ঐক্যমত ছিল। সেটা হলো, প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা বন্টন করা যাবে না। পুরো রাষ্ট্রের সরকার হবে এককেন্দ্রিক। তবে ঝামেলাটা বাঁধে ক্ষমতা দখল নিয়ে– কার হাতে থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের ভার। আসলে জওহরলাল নেহেরু এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উভয়েরই কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বে থাকা না থাকা নিয়ে ছিল আসল মাথা ব্যথা।

আর ঐ যে বলেছিলাম, মুসলিম লীগ মুসলমানদের আলাদা করতে চায়; এটা বলার কারণ হলো, ভারতীয় সংবিধান অনুসারে ১৯০৯, ১৯১৯ এবং ১৯৩৫ সালে একের পর এক পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এসব নির্বাচনে মুসলমানরা বিজিত হয়ে বাংলাসহ উত্তর-পশ্চিম প্রদেশগুলো নিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে। তখন মুসলিম লীগ চিন্তা করে, আরে! আমরা তো চাইলেই এখন আলাদাভাবে সরকার গঠন করে স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারি। তাহলে আমাদের কেন হিন্দুদের অধীনে থাকতে হবে?

জওহরলাল নেহেরু

জওহরলাল নেহেরু যতই বলুন না কেন ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ, আসলে ভারতবর্ষ কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না। তদুপরি যখন দেশ ভাগ হয়, তখন পুরো ভারত জুড়ে সতেরোটি জাতির বসবাস। তাই কংগ্রেসের ‘এক জাতি’র নীতিটি পুরোপুরি ঠিক নয়। বরং আসল সমস্যাটা যে ভাষায় ও শ্রেণিতে সেটা খুব স্পষ্ট। কিন্তু ইসলাম-হিন্দু ধর্মটাই মুখ্য হয়ে উঠে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কাছে। সমাজের উঁচু শ্রেণিতে বসবাস করা কংগ্রেস-লীগের হর্তাকর্তারা লাট সাহেবদের বিতাড়িত করে গদিতে বসতে চেয়েছিলেন। তারা সেভাবেই শাসন করতে চেয়েছেন ঠিক যেভাবে ইংরেজরা ভারত শাসন করেছিল। কিন্তু ধনী-গরিবের পার্থক্য ঘুচানোর কথা কেউ ভাবননি। তাই তো হাত মিলিয়েছিলেন ইংরেজদের মনগড়া সিদ্ধান্তে। যদিও এতে করে তাদের কিন্তু লাভ বিনে ক্ষতি হয় নি।

অবশেষে দেশভাগ

জিন্নাহ সাহেব দ্বিজাতিতত্ত্বের পরিষ্কার ধারণা দেওয়ার পর জাতিগত বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। আর সাম্প্রদায়িকতার এ আগুনে তেল ঢালে ব্রিটিশরা। তারা এটা বুঝাতে থাকে যে, শুধু জাতিগতভাবে স্বতন্ত্র হলে চলবে না, সীমানাপ্রাচীরও নির্মাণ করতে হবে। আহা! ব্রিটিশদের আমাদেরকে নিয়ে কত চিন্তা! ভারতবর্ষ টুকরো করতে সূদর ইংল্যান্ড থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল ব্যারিস্টার রেডক্লিফকে। যিনি কিনা এর আগে কোনদিন ভারতবর্ষে পদধূলি দেন নি। তিনি এসে ঠিক করে দিলেন ভারতের কারা কোথায় থাকবে, কে বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছাড়বে, আর কে অন্যের জমি দখল করবে।

তাই ফল হিসেবে যা হওয়ার তাই হলো। প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষকে উদ্বাস্তু এবং ধর্মভিত্তিক এ দাঙ্গায় প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। হাজারো মানুষ হারিয়েছিল তাদের আপনজনদের। ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট রেডক্লিফ তাঁর দায়িত্ব শেষ করে চলে যান। ১৪ আর ১৫ আগস্টে বিশ্বমানচিত্রে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের নাম তালিকাভুক্ত হয়।

বিভাজন পরবর্তী দুর্দশা

দেশ বিভাজনের পর দেখা গেল, পাকিস্তানে মুসলমানের চেয়ে ভারতে মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি। আবার পাকিস্তানের পূর্ব অংশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে অনেক হিন্দু রয়ে গেছে। তার মানে যে উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়েছিল তা পুরোটাই বিফল। এমতাবস্থায় জিন্নাহ এবং নেহেরু দুজনেই সুর পাল্টালেন। তখন তারা বললেন, ভারত এবং পাকিস্তান দুটিই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ! তাহলে আগে কি সমস্যা হয়েছিল? আগেও তো হিন্দু মুসলমান ভারতবর্ষ জুড়ে বসবাস করত। তাহলে কি এটা প্রমাণিত হয় না যে, শুধুমাত্র ক্ষমতালাভের মোহে অথবা ব্রিটিশদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করতেই এত বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীকে বিভাজিত হতে হলো? কারণ কথায় বলে না, একই জঙ্গলে দুই বাঘ রাজত্ব করতে পারে না।

দেশ ভাগের পর কোন দেশেরই সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় নি। আমাদের মানে, ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কি কোন পরিবর্তন হয়েছিল? যদিও পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষই ছিল মুসলিম তারপরও তাদের সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। সবচেয়ে বড় বৈষম্য ছিল ভাষায়। তাই তো দেশভাগের মাত্র চার বছর পর ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যায় ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল আমাদের সোনার ছেলেদের। সবশেষে তো পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বৈষম্য আর শোষণের চূড়ান্ত প্রতিবাদ রূপে ১৯৭১ সালে ত্রিশ লক্ষ শহীদের তাজা রক্ত ও হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা পেল আমাদের বাংলাদেশ।

লেখক- নিশাত সুলতানা

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *