‘চলচ্চিত্র নির্মাণ আসলে একটি দলগত কাজ। আমি হয়তো সেই দলের নেতৃত্ব দেই সামনে থেকে। কোন ছবির সাফল্যের পরে আমরা দেখতে পাই পরিচালককে। কিন্তু প্রোডাকশনে যে কাজ করেছে, যে খাবার এনেছে, যে ট্রলি ঠেলেছে– তাদের অবদানও সমান।‘
পরিচালক তৌকির আহমেদ এভাবেই জানিয়ে দিলেন খ্যাতি আর সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছুলেও তাঁর পা আছে মাটিতেই।
অভিনয় থেকে পরিচালনায়
অভিনয়ের জগতে আসার গল্পটা বেশ অতর্কিতেই বলা যায়। বাবা ছিলেন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা। তাই পারিবারিক একটা চাপও ছিল সেদিকেই পেশা খুঁজে নেবার। কিন্তু ক্যাডেট কলেজের দিনগুলোতেই তিনি টের পেলেন, সৃজনশীল কিছু করতে চান। শেষমেশ বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যায় ভর্তি হলেন। ক্লাস শুরুর আগে বেশ কিছুটা সময় হাতে ছিল। সে সময়টাই হয়ে যায় তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। তখন থিয়েটারে নাট্য কর্মী চেয়ে বিজ্ঞাপন আসছে পত্রিকায়। এমনই এক বিজ্ঞাপন ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’ দেখে ইন্টার্ভিউয়ে দাঁড়ালেন। আড়াই হাজার তরুণ- তরুণী থেকে ২৫ জনকে বেছে নিয়েছিল তখন রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসি মজুমদার, আব্দুল্লাহ আল মামুন, তারিক আনাম খান প্রমুখের ইন্টার্ভিউ বোর্ডটি। এরপর ‘তোমরাই’ নামক মঞ্চনাটক থেকেই পরিচিতি বাড়তে থাকে তাঁর।
আশির দশক, মঞ্চে নিয়মিত অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছেন যুবক তৌকির। প্রয়াত অভিনেতা ও নাট্যকার আব্দুল্লাহ আল মামুনের পরামর্শেই টেলিভিশনে হাতেখড়ি ঘটে তাঁর। “ফিরিয়ে দাও অরণ্যে” নেশাগ্রস্ত যুবকের চরিত্রে তাঁর দুর্দান্ত রূপায়ন তখনই দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। তখন থেকেই মেধার দ্যুতির জোরে কাজ করতে থাকেন স্বনামধন্য পরিচালকদের সাথে।
তবে শুধু নাটকেই নয়, চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও সুনাম কুড়ান তিনি। প্রিয়তমেষু, রাবেয়া, লালসালু, জালালের গল্প, কমলা রকেটসহ বেশ কয়েকটি ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। তবে আগের মতো অভিনয়ে নিয়মিত না থাকলেও প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরেই আছেন শিল্পের এই ধারাটির সাথে।
তবে স্থপতি, নাট্যকার, নাট্য-পরিচালক বা অভিনেতার বাইরেও তাঁর ভিন্ন একটি সত্তা আছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ তথা পরিচালনার মুনশিয়ানায় ছাড়িয়ে গেছেন তিনি অনেককেই। আজকের আলোচনায় তৌকির আহমেদের পরিচালক জীবনের দিকেই আলোকপাত করবো আমরা।
তানভীর মোকাম্মেলের ‘নদীর নাম মধুমতি’ করার সময়েই চলচ্চিত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের বিষয়টি তাঁর মাথায় আসে।
জীবন থেকে নেয়া
‘একটা মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ। একটা সৎকারের অধিকার তো তার আছে।‘
ফজলুর রহমান বাবুর মুখে এই সংলাপ দেখে কেঁপে ওঠেন নি এমন মানুষ পাওয়া দুর্লভই। বিষণ্ণ বিধুরতার আরেক প্রতীকই যেন ‘অজ্ঞাতনামা’। প্রবাসী শ্রমিক এবং তাদের মানবেতর জীবনের গাঁথা নিয়েই এই ছবির গল্প। শুধুমাত্র পরিবারকে স্বচ্ছন্দে রাখতে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কীভাবে নিজেদের নাম-পরিচয়ের পাশাপাশি মৃত্যুতেও তাদের স্বাভাবিক সৎকারের অধিকার হারিয়ে ফেলেন –সে কঠিন সত্যটাই উঠে এসেছে ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিতে।
বাণিজ্যিকভাবে অসফল হলেও পুরস্কারের ঝুলি ছিল ষোলো আনায় ভরা। ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৬’ তে সেরা চলচ্চিত্র ও সেরা গল্পের পুরস্কারটি পায় ‘অজ্ঞাতনামা’। ‘এশিয়া প্যাসিফিক চলচ্চিত্র উৎসব-২০১৭’ এ সেরার বিজয়মাল্যটাও পায় এই ছবি। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অনুষ্ঠিত ‘Cutting Edge International Film Festival-2016’ এ ‘বেস্ট ন্যারেটিভ ফিচার’, কসোভো চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সেরা চলচ্চিত্র’ ও ‘সেরা পরিচালক’ এর পুরস্কার, সার্ক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ সেরা চলচ্চিত্র’ বিভাগে পুরস্কার, ইতালির ‘রিলিজিয়ন টুডে ফিল্ম ফেস্টিভালে’ সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারসহ নানান পুরস্কারের ভূষিত হয় বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম স্মরণীয় ছবিটি।
তবে এটিই কিন্তু তাঁর প্রথম অথবা আলোচিত ছবি নয়। পরিচালক হিসেবে তৌকির আহমেদ প্রথম নাম লেখান ২০০৪ সালের ‘জয়যাত্রা’ ছবিটির মধ্য দিয়ে। আমজাদ হোসেনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘অবেলায় অসময়ে’ কে কেন্দ্র করে নির্মিত এই ছবি দিয়েই নিজস্ব ধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন দর্শকদের। তৌকিরের ছবিতে বাড়তি বাগাড়ম্বর কিংবা অহেতুক সজ্জা নেই, আছে জীবনের চরম বাস্তবতা ও তার পর্দাহীন চিত্রের প্রকাশ।
প্রথম চলচ্চিত্রেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বগলদাবা করেন তিনি সেরা পরিচালক, প্রযোজক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে। এছাড়াও ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’, ‘এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভাল’ এ পুরস্কৃত হয় এটি।
সাফল্যের সুতোয় গাঁথা
তৌকির আহমেদের অপর নাম যদি সাফল্য ধরা হয়, খুব একটা মিথ্যে বলা হবেনা। অভিনেতা থেকে চিত্রনাট্যকার অথবা পরিচালক– সব ক্ষেত্রেই তাঁর সাফল্য আকাশচুম্বী।
‘রূপকথার গল্পে’ চঞ্চল চৌধুরী, তাসকিন সুমিকে নিয়ে নির্মাণ করেন অসহায়ত্বের সুতীব্র এক কাহিনী। ‘মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার’, ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে’ সেরার তকমা পায় এই ছবিটি ২০০৬ সালে।
২০০৭ সালে কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘দারুচিনি দ্বীপ’ নির্মাণ করে ঝুড়ি ঝুড়ি পুরস্কারের পাশাপাশি তরুণদের মনও জিতে নেন।
‘হালদা’ অথবা ‘ফাগুন হাওয়ায়’
‘অজ্ঞাতনামা’র ভূয়সী প্রশংসার পর স্বভাবতই প্রত্যাশা বেড়ে যায় সব মহলের। তবে সেটাকে চাপ হিসেবে না নিয়ে প্রেরণা হিসেবেই নিয়েছেন তিনি। তার ফলাফল এসেছে ‘৮ম সার্ক চলচ্চিত্র উৎসবে’ ‘হালদা’র ঈর্ষণীয় সাফল্যের মাধ্যমেই। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত এই উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক, শ্রেষ্ঠ সম্পাদক ও শ্রেষ্ঠ আবহ সঙ্গীত- এই কয়টি বিভাগে অর্জন করেছেন পুরস্কার। চট্টগ্রামের হাটহাজারির হালদা নদীর পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই ছবিটিতে অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা, মোশারফ করিম, জাহিদ হাসান, ফজলুর রহমান বাবু প্রমুখ।
অন্যধারা সৃষ্টির জন্য আগে থেকেই একটা পরিচিতি মিলে গেছে তৌকির আহমেদের। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে মুক্তি পায় ‘ফাগুন হাওয়ায়’ চলচ্চিত্রটি। তিশা ও সিয়াম জুটিকে প্রথমবারের মতো পর্দায় দেখা গেছে এই ছবিতে। তবে তার চাইতেও অভূতপূর্ব ব্যাপার হচ্ছে, এটিই প্রথম কোন চলচ্চিত্র যা সরাসরি ‘ভাষা আন্দোলন’কে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে।
অনাড়ম্বর বহুমুখিতা
‘প্রতিসরণ’, ‘ইচ্ছামৃত্যু’, ‘অজ্ঞাতনামা’ – এই নামগুলো কয়েকটি মঞ্চনাটকের। ভাবছেন, হতেই পারে! কিন্তু এগুলোর লেখক ও নির্দেশক কিন্তু আর কেউ নন, স্বয়ং তৌকির আহমেদ।
সমকালীন ভাবনা
সম্প্রতি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘বায়োস্কোপে’ সত্যজিৎ রায়ের খ্যাতনামা চরিত্র ‘ফেলুদা’ কে নিয়ে ‘নয়ন রহস্য’ নির্মাণ করেছেন তৌকির। এর নাম চরিত্রে আছেন আরেক গুণী অভিনেতা আহমেদ রুবেল। ইতোমধ্যে স্ট্রিমিংয়ে থাকা এই সিরিজ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তবে অধিকাংশই এই নির্মাণকে সাহসী পদক্ষেপই মানছেন।
সামনের দিনগুলোতে চলচ্চিত্র নিয়েই মনোনিবেশ করতে চান তিনি। তবে দেশি নাটকের বেহাল দশা নিয়ে যারপরনাই অসন্তুষ্ট। তাঁর মতে, কাজ প্রচুর হলেও আগের মতো গ্রুমিং কিংবা মান কোনটাই নিশ্চিত হচ্ছেনা।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তৌকির আহমেদের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ এর বিশ্বাসযোগ্যতা এবং অনাড়ম্বর উপস্থাপন। ছোট বিষয়কে উপজীব্য করে দর্শকের মনে গভীর বেদনাবোধ সৃষ্টিই যেন তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রকে দিয়েছে আলাদা প্রাঞ্জলতা।
লেখক- সারাহ তামান্না
আরও পড়ুন- রাফ কাট মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
আরও পড়ুন- চলচ্চিত্রের মহারাজা- সত্যজিৎ রায়
আরও পড়ুন- অন্যরকম নুহাশ