তাজউদ্দীন আহমদঃ ইতিহাসের অন্তরালে ইতিহাসের নায়ক1 min read
Reading Time: 11 minutesস্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম নায়ক তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে দেশের ভেতরের-বাইরের সকল প্রতিকূল পরিস্থিতি বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করে তিনি যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তা ইতিহাসের পাতায় নিশ্চয়ই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তবে কোন ঐতিহাসিক ঘটনা সবাই একই চোখে দেখবেন না, ঘটনা উপলব্ধিতে ভিন্নতা, এমনকি মতপার্থক্যও থাকতে পারে। কিন্তু মূল ঘটনা আড়াল করা কিংবা কিছু ক্ষেত্রে বিকৃত করা অপরাধই বটে। তাজউদ্দীন আহমদের ক্ষেত্রে আমরা অবাক হয়ে দেখতে পাই যে, জাতির কাছে তার যে সন্মান প্রাপ্য সেটি থেকে তিনি কোন এক অজানা কারণে বঞ্চিত। এটি যতটা না তাজউদ্দীনের আহমদের দুর্ভাগ্য, তার চাইতে বড় দুর্ভাগ্য এই জাতির।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নাম মুখস্ত করার মধ্যেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কিত জ্ঞান সীমাবদ্ধ। দুঃখজনক হলেও এটি সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাজউদ্দীন আহমদের অবদান উপলব্ধি করতে যতটুকু তথ্য দরকার সেটি পাঠ্য বইয়ে অনুপস্থিত। এমনকি আমাদের রাষ্ট্রীয়-সরকারি উদ্যোগে পালিত স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান, আলোচনাতেও তাজউদ্দীন থাকেন উপেক্ষিত। তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ গত বছর(২০১৯) তার বাবার জন্মদিন উপলক্ষে “নতুন প্রজন্ম খুঁজে নেবে তাজউদ্দীন আহমদকে” শিরোনামে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লিখেছিলেন-
“বছরের শুরুতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য পাঠ্যবই বিতরণ অনুষ্ঠানে যখন যোগদান করি, তখন আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির বইগুলোতে চোখ বুলাই। বইগুলোতে তাঁর জীবনী চোখে পড়েনি, তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে অতি সংক্ষেপে। উদাহরণস্বরূপ ষষ্ঠ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের মাত্র অর্ধ প্যারার একটি লাইনে যুক্ত হয়েছে শুধু তাঁর নাম ও পদবিটি। ওই ন্যূনতম উল্লেখ থেকে আজকের শিশু–কিশোর, তরুণ প্রজন্ম জানবে না বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর অসামান্য অবদান ও সাফল্যের কথা। তারা জানবে না যে তাজউদ্দীন আহমদের সুদক্ষ, সাহসী, দূরদর্শী ও স্বাধীনতার প্রতি আপসহীন নেতৃত্ব ছাড়া আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর হতো না। স্বাধীন দেশের মাটিতে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও সসম্মানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো না, যদি না সেদিন তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের হাল না ধরতেন। একজনকে বাদ দিয়ে অপরজনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ।”
শারমিন আহমদ যথার্থই লিখেছেন যে, “একজনকে বাদ দিয়ে অপরজনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ”। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে তাজউদ্দীন সব সময়ই কাজ করে গেছেন আন্তরিকভাবে। ১৯৬৪ সালে তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৬৬ সালে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবের সাথে তাজউদ্দীনের সম্পর্ক এবং আওয়ামী লীগে তাজউদ্দীনের অপরিহার্যতা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন-
“আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছয় দফা প্রণয়ন ও প্রচারে এবং আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) সহকর্মী হিসেবে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা তাঁর বিস্ময়কর সংগঠননিষ্ঠা, সামর্থ্য ও যোগ্যতা প্রমাণ করে। তাঁকে ছাড়া ছয় দফা আন্দোলনের কালে (১৯৬৬-১৯৭১) শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অন্য রকম চরিত্র লাভ করত। উন্নততর চরিত্র লাভ করত কি?”
প্রিয় পাঠক, সঠিক ইতিহাসের গুরুত্ব এবং স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় রেখে আমি আপনাদের সামনে নিজের উপলব্ধি থেকে ইতিহাস তুলে ধরা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে চাই। আমি বরং কয়েকজন বিশিষ্ট এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গের লেখা কিংবা বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃত করে যুদ্ধকালীন সময় থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীনের পরবর্তী সময়ে তাজউদ্দীন আহমদের কর্ম এবং ভাবনা আপনাদের সামনে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করতে চাই।
৭ মার্চ ও ২৫ মার্চ
৭ মার্চ, ১৯৭১ শেখ মুজিবের ভাষণ এবং ২৫ মার্চ স্মরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন-
“বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণটি সাজিয়ে দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন। ২৫ মার্চ পর্যন্ত নেতারা কী করবেন, তা ছিল অনিশ্চিত। তবে একটা পরিকল্পনা ছিল আত্মগোপন করে তাঁরা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। সেই অনুযায়ী তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলেন। গিয়ে শোনেন তিনি বাড়িতেই থাকবেন, আত্মগোপনে যাবেন না। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত এল না। তাজউদ্দীন একটি লিখিত বিবৃতি ও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর রেকর্ড করতে একটি টেপ রেকর্ডারও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাক্ষরও পেলেন না, কণ্ঠস্বরও পেলেন না।”
প্রিয় পাঠক, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের উদ্ধৃতটি পড়ে আপনারা যেন ভুল বার্তা না পান সেজন্য কিছু ব্যাপার পরিস্কার করার প্রয়োজন বোধ করছি। প্রথমত, এই লেখাটি লেখার প্রধান উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে ধরা, কাউকে ছোট কিংবা বড় করা নয়। দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান কাণ্ডারি। দলীয় ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের ছিল নিঃশর্ত সমর্থন। (যদিও স্বাধীনতা পরবর্তী সময় তাদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি দেখা দিয়েছিল। এ ব্যাপারটিও আপনাদের সামনে যথাসময়ে তুলে ধরা হবে।)
তাজউদ্দীন আহমেদের কন্যা শারমিন আহমেদ তার “তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা ” নামক একটি বইয়ে ২৫ মার্চ নিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের সুরে একই কথা তুলে ধরেছেন। তবে শারমিন আহমদ ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধে স্বাধীনতার লিখিত ঘোষণা পাঠ না করলেও বিকল্প উপায়ে তিনি সেই ঘোষণা দেন। এর সাক্ষী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহযোগী হাজি গোলাম মোরশেদ।
মুজিবনগর সরকার গঠন
২৭ মার্চ, ১৯৭১, তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা ত্যাগ করার সময়ে একটি চিরকুটে তার স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন লিলিকে লিখেছিলেন-
“লিলি আমি চলে গেলাম। যাবার সময় কিছুই বলে আসতে পারি নি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না…..মুক্তির পর। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও।”
৩০ মার্চ, ১৯৭১, তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের স্বার্থে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। এই দিনে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী টুঙ্গি গ্রামের এক সেতুর নিচে আত্মগোপনে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নেন একটি স্বাধীন সরকার গঠন করে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করার।
২৫ মার্চ দিবাগত রাতে শেখ মুজিবুর রহমান সিদ্ধান্ত নিয়ে যুদ্ধে না যাওয়া এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের দলীয় অন্তর্বিরোধের মধ্যে এমন একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেয়া যে কতটা কঠিন ছিল সেটি বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। একথা বলা বাড়াবাড়ি হবে না যে, আওয়ামী লীগ সহ অন্য সব দলই সেসময় সিদ্ধান্তহীন হয়ে পড়েছিল। এমন সময়ে তাজউদ্দীনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ পথ চলে। তবে তাজউদ্দীনের এই সিদ্ধান্ত যে কতটা যৌক্তিক এবং সুদুরপ্রসারী ছিল সেটি বুঝতে অনেকেরই বেশ সময় লেগেছিল।
তাজউদ্দীন আহমদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পর্কে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন–
“আমি মনে করি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ই ছিল তাঁর জীবনের সেরা সময়– ‘the finest hour’।”
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন–
“১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর তাজউদ্দীন ও প্রথম বাংলাদেশ সরকার ছাড়া কি স্বাধীন বাংলাদেশ হত?”
১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তের সৃতিচারণ করে বলেছিলেন–
“পালিয়ে যাবার পথে এদেশের মানুষের স্বাধীনতা চেতনার যে উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম, সেটাই আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অনিবার্য সুযোগ দিয়েছিল। জীবননগরের কাছে সীমান্তবর্তী টুঙ্গি (কুষ্টিয়া জেলায়) নামক স্থানে একটি সেতুর নিচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তা হল একটি স্বাধীন বাংলা সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে কাজ শুরু করা।”
৩০ মার্চেই তাজউদ্দীন আহমদ এবং তার পথ চলার সঙ্গী ব্যরিস্টার আমীর-উল-ইসলাম ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তরক্ষী প্রধান ইন্সপেক্টর জেনারেল গোলোক মজুমদারের সাথে দেখা করেন। পর্বত সমান আত্মমর্যাদাসম্পন্ন তাজউদ্দীন গোলোক মজুমদারকে দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ভারত সরকার তাদের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরুপে গ্রহণ করলেই কেবল তারা আশ্রয়ের জন্য ভারত সরকারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে, তার আগে নয়।
১ এপ্রিল, ১৯৭১, তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যরিস্টার আমির-উল-ইসলাম, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তরক্ষী প্রধান আইজি গোলোক মজুমদার ও বিএসএফের নিরাপত্তা অফিসার শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় নয়াদিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
৩ এপ্রিল, ১৯৭১, ১০ নম্বর সফদার জং রোডে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম দেখা করেন। তাজউদ্দীন নিজ দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে বরাবরই সাবধানী এবং সচেতন ছিলেন। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন-
“এই যুদ্ধ বাংলাদেশের গণমানুষের যুদ্ধ। বাংলাদেশ চায় না যে ভারত তার সামরিক বল দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়ে দিক। এই স্বাধীনতার যুদ্ধ করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকেই। ভারত বাংলাদেশকে গণ্য করবে একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র হিসেবে।”
১০ এপ্রিল, ১৯৭১, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় শিলিগুড়ির জঙ্গলের গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে তাজউদ্দীন আহমদের দিকনির্দেশনাপূর্ণ ঐতিহাসিক এক ভাষণ প্রচার করা হয়। এই ভাষণের মাধ্যমে তাজউদ্দীন বিশ্ববাসীকে জানান দেন স্বাধীন বাংলাদেশের কথা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামের কথা, একই সাথে তিনি বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানান নয়া রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য। এটি উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই ভাষণটির খসড়া তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যরিস্টার আমীর-উল-ইসলাম এবং অর্থনীতিবীদ রেহমান সোবহান মিলে তৈরি করেছিলেন।
শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করে নবগঠিত সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর অসহযোগ আন্দোলনের সময়কার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে। মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ছিলেন এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এ এইচ এম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
১১ এপ্রিল, ১৯৭১, তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্যে বিভিন্ন সেক্টরের নাম ঘোষণা করেন এবং সেই সাথে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ দেন। কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর সঙ্গে আলাপ করে তাজউদ্দীন আহমদ তার ওপর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করেন।
১৭ এপ্রিল, ১৯৭১, তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক ও এলাকাবাসীর সামনে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সে দিন তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন-
“পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।…সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশুরাষ্ট্রকে লালিত–পালিত করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য।”
একই অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন আহমদ তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ওই আম্রকাননের নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’। মুজিবনগরকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঘোষণা করা হয়।
এই মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব দিতে তাজউদ্দীনকে বহু প্রতিকূলতার মধ্যেই বহুমুখী কাজ করতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাজউদ্দীনের কর্ম পরিধি স্মরণ করে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন-
“বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন-গঠন, আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদসমূহের প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধের সামরিক শক্তির পুনর্বিন্যাস, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক তৎপরতা, পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করে বাঙালি কূটনীতিকদের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণায় উৎসাহদান, ভারত সরকারের সঙ্গে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ যোগাযোগ রক্ষা—এসব বহু ক্ষেত্রে তাঁকে এককভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল।”
এ কথা হয়তো অনেকেরই জানা আছে যে, তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। যুদ্ধকালে মুজিবনগরে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পাশের ছোট একটি কক্ষে তিনি থাকতেন। এই সময় তাঁর সম্বল ছিল একটিমাত্র শার্ট যা তিনি নিজ হাতে ধুয়ে শুকিয়ে তারপর পরিধান করতেন।
দল এবং দলের বাইরের বাধা
তাজউদ্দীন আমহদকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শুধু পাকিস্তান কিংবা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নয়, নিজ দল আওয়ামী লীগের অনেকের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছিল। কিন্তু দেশকে স্বাধীন করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তাজউদ্দীন সব বাধা মোকাবেলা করে গেছেন অসীম প্রজ্ঞ্রা ও পরম ধৈর্যের সাথে।
তিনি কোন অধিকারবলে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এমন প্রশ্ন ওঠে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ পাকিস্তান ও সিআইয়ের পক্ষ হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠন করে শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে মোশতাকের এই পরিকল্পনার ঘোর বিরোধী ছিলেন। পাকিস্তানের সাথে মোশতাকের এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে তাজউদ্দীন আহমেদ মোশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে রেখেও তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। তখন দলের অনেকেই বলেন তাজউদ্দীন শেখ মুজিবের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন কামনা করেন না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন বলেছিলেন-
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য বহুভাবে চেষ্টা করে। সংগ্রামের এক পর্যায়ে আমেরিকা প্রশ্ন তোলে—‘স্বাধীনতা চাও, না মুজিবকে চাও?’ এর উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই। স্বাধীনতা এলেই মুজিবকে পেতে পারি।’ কারণ, আমি জানতাম, আদর্শের মধ্যে শেখ মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হবে। আর এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ২৭ বছর রাজনীতি করেছি, তাঁকে আমি গভীরভাবে জানি।”
প্রিয় পাঠক, মোশতাক আহমেদ এবং তাজউদ্দীন আহমদের এই বিরোধ নিয়ে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন-
“বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ মার্কিন সহায়তায় পাকিস্তানের সঙ্গে আপোস করতে চেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাঁর এই বিশ্বাসঘাতকতা ফাঁস হয়ে গেলে তাজউদ্দীন তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে রেখেও সকল দায়িত্বভার থেকে অব্যাহতি দেন। (মোশতাক এই পরাজয় কখনো ভোলেননি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-অর্জনের পরে তাঁর সর্বক্ষণের কাজ হয়েছিল সর্বক্ষেত্রে তাজউদ্দীনের বিরোধিতা করা।)”
একই ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্মানিত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন-
“খন্দকার মোশতাক ও তাঁর কিছু অনুসারী তাজউদ্দীনের নেতৃত্ব মেনে নিতে চায়নি। যত দূর জানা যায়, মোশতাক শেখ মুজিবের নেতৃত্বও কখনো আন্তরিকভাবে মেনে নেননি। তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন। নিজেকে তিনি অধিকতর যোগ্য মনে করতেন এবং দলে সর্বোচ্চ আসন আশা করতেন। তখনকার বিশ্ব বাস্তবতায় মোশতাকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দিল্লি-মস্কোর বিরোধী ও যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী। যুদ্ধকালে তিনি মার্কিন সহায়তা নিয়ে শেখ মুজিবের মুক্তির কথা বলেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না, প্রধানমন্ত্রী হতে প্রয়াসপর ছিলেন।”
অপরদিকে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে যুবদলের এক অংশ তাজউদ্দীন এবং মুজিবনগর সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে অনাস্থা জানায়। তারা মুজিবনগর সরকারের অনুমোদন না নিয়েই ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী র’এর সয়াহতায় মুজিব বাহিনী গড়ে তোলে। এসব নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তখন আওয়ামী লীগের ভেতরে উপদলীয় কোন্দল দেখা দেয়।
প্রিয় পাঠক, একটি ব্যাপার আপনাদের নিশ্চয়ই খটকা লাগছে। ভারত সরকার একদিকে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গড়া মুজিব নগর সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিলো, অপরদিকে তারা অত্যন্ত ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থে গড়ে ওঠা মুজিবনগর সরকারের বিরোধী মুজিব বাহিনীকে হাত ছাড়া না করে নিজেদের বশে রাখার চেষ্টা করলো। এ এক ধাঁধাই বটে।
এ ব্যাপারে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন-
“ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-র আনুকূল্যে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতারা মুজিব বাহিনী গঠনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্বের বাইরে, বাংলাদেশ সরকারের বিরোধিতাকারীদের দিয়ে, কেন একটি সমান্তরাল সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলতে উৎসাহ ও সহায়তা দিলো ভারত সরকার, তাজউদ্দীন তাঁর কারণ জানতে চেয়েও কখনো কোনো জবাব পাননি। আবার ভারতের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে একটি গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন বলে জোর প্রচারণা হয়। এতে তাজউদ্দীনের ভাবমূর্তি খানিকটা যে কালিমালিপ্ত হয়, সে-কথা অস্বীকার করা চলে না। (১৯৭৫ সালে দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে খন্দকার মোশতাক এই গোপন চুক্তি খুঁজে পাওয়ার অনেক চেষ্টা চালিয়েছিলেন, কিন্তু যে-চুক্তি হয়নি, তা খুঁজে পাওয়া কেমন করে আর সম্ভবপর হয়!)”
শেখ ফজলুল হক মনি এবং মুজিব বাহিনীকে নিয়ে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের উপলব্ধি হল এমন-
“যুদ্ধকালে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অনুসারীরাও তাজউদ্দীনের নেতৃত্ব মেনে নিতে চাননি। মোশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে এঁরা কাজ করতেন। মণিও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অভিলাষী হয়েছিলেন।
যুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরে জেনারেল) এম এ জি ওসমানীও তাজউদ্দীনকে মানতে চাইতেন না—মোশতাকের সঙ্গেই তাঁরও ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজিক পরিণতির পরে মোশতাকের অনুকূলে ওসমানীর সক্রিয় ভূমিকার কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
ফজলুল হক মণি ও তাঁর অনুসারীরাও তাজউদ্দীন সরকারের প্রতি যথেষ্ট অনুগত না থাকার ফলে সমস্যা জটিল হয়েছিল। তাঁদের উদ্যোগে গঠিত মুজিব বাহিনী ওসমানীর কমান্ডের বাইরে থেকে যুদ্ধ করেছিল। ইন্দিরা সরকার তাঁদেরও আলাদাভাবে সহায়তা দিয়েছিল। ”
প্রিয় পাঠক, তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কেবল আওয়ামী লীগের নেতা নন বরং স্বাধীনতাকামী জাতির নেতা হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি কেবল আওয়ামীলীগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কথা ভাবেননি। তিনি মাওলানা ভাসানী, কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহের মতো নেতাদেরও মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদে জায়গা দিয়েছিলেন। ভিন্ন দলের কর্মীদেরও মুক্তিবাহিনীতে জায়গা দিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের উপলব্ধি ছিল এই যুদ্ধ কোন একক দলের নয় বরং পুরো বাংলাদেশের।
শেখ মুজিব-তাজউদ্দীনের বিরোধ ও বাংলাদেশের ক্ষতি
স্বাধীনতার পরে শেখ মুজিবের সাথে তাজউদ্দীন আহমদের নানা বিষয়ে মত বিরোধ দেখা দেয়। তাদের এই বিরোধের পূর্ণ সুযোগ নেন মোশতাক আহমদ এবং মুজিব বাহিনীর নেতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন-
‘বাকশাল গঠন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের গুরুতর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় তাজউদ্দীন হতাশ হয়েছিলেন। এসব ঘটনা বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি করে।’
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের বক্তৃতা থেকে আরও জানা যায় বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় তাজউদ্দীন আশঙ্কা করেছিলেন, এতে হানাদারদের অনুচরেরা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর বাকশাল গঠনের পর তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন-
‘মুজিব ভাই, এই জন্যই কি আমরা ২৪ বছর সংগ্রাম করেছিলাম? যেভাবে দেশ চলছে তাতে আপনিও থাকবেন না, আমারাও থাকবো না। দেশ চলে যাবে আলবদর-রাজকারদের হাতে।’
তাজউদ্দীন ১৯৭৪ সালে বিভিন্ন সময় তাঁর স্ত্রীকে বলেছেন-
‘তুমি বিধবা হতে চলেছ। মুজিব ভাই বাঁচবেন না, আমরাও কেউ বাঁচব না। দেশ চলে যাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে।’
তাজউদ্দীন আহমেদ- শেখ মুজিবের বিরোধ নিয়ে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন-
“বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীনের নীতিগত বিষয়ে কিছু কিছু মতান্তর দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা এই সুযোগে তাঁদের দুজনের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। তাজউদ্দীন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু তাঁর এই ইচ্ছা গোপন থাকেনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন এবং সেই সঙ্গে পদত্যাগপত্রের খসড়াও পাঠিয়ে দেন। তাজউদ্দীন সেই খসড়া-অনুযায়ীই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তাতে তাঁদের দুজনেরই ক্ষতি হয়, সর্বোপরি ক্ষতি হয় বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরে খুনিরা তাজউদ্দীনকে গ্রেপ্তার করে। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার একজন বাদে আর সকল সদস্য কারাগারের অভ্যন্তরে নিহত হন। ”
স্বাধীনতার পর থেকেই তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। বাকশাল তাদের সম্পর্কের একরকম ইতি টেনে দেয়। বাকশাল ও মন্ত্রীপরিষদ থেকে তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শিরিন আহমদের “তাজউদ্দীন আহমদঃ নেতা ও পিতা” বইটি থেকে জানা যায়, শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন সেসময় নীতিগত ও আদর্শিক ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রীসভায় না থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও, তিনি নিজে থেকে পদত্যাগ করে তার নেতা শেখ মুজিবকে বিব্রত করতে চাননি। আবার নিজের আজীবনের নীতি ও আদর্শের সঙ্গেও তিনি আপোস করতে চাননি। শেখ মুজিব যে দিন তাকে ইস্তফা দিতে বলবেন সেদিনই তিনি ইস্তফা দেবেন- এমনটিই ছিল তাজউদ্দীনের ভাবনা।
বাকশালের প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ব্যক্তিগত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরীকে সাক্ষী রেখে শেখ মুজিবকে ফোন করে বলেছিলেন-
“আপনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা। আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার এই একদলীয় শাসনের সঙ্গে একমত নই…. বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেওয়া আছে যে, সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা কোন পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা বক্তৃতায় সব সময় বলেছি একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশের কথা, যার ভিত্তি হবে গনতন্ত্র। যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সব সময়, আজকে আপনি একটি কলমের খোচায় সেই গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন। বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দ্য ডোরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইউর পজিশন ।”
প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে দূরত্ব এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়া পুরো জাতিরই জন্যই চরম দুর্ভাগ্য বয়ে। এই দুই নেতা এক থাকলে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো অন্যরকমই হতো।
আওয়ামী লীগে তাজউদ্দীন আহমদের কোণঠাসা হয়ে পরার বিষয়ে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন-
“তাজউদ্দীনের সংগঠনমনস্কতা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে অল্পই গুরুত্ব পেয়েছে। শেখ মুজিব সাংবিধানিক ব্যাপারে সাফল্য অনুভব করেছেন আওয়ামী লীগের সমর্থনে এবং নিজের সমর্থনে জনসাধারণকে জয় করতে পেরেই তাঁর উৎসাহ ছিল প্রতিপক্ষের মোকাবিলায়, দলীয় আত্মগঠনের এবং জনসমর্থনকে দীর্ঘস্থায়ী করার সমস্যাবলি নিয়ে অল্প ভেবেছেন। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা ও রীতিনীতি ও আত্মসমালোচনা বলে কিছুই বিকশিত হয়নি। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতি অতি দ্রুত ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়ল। অন্যান্য দলের রাজনীতিও এই দুর্বলতার শিকার ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দুর্বলতা প্রধান জাতীয় দুর্বলতা রূপে দেখা দেয়।”
উপসংহার
মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতে তাজউদ্দীন আহমদ ঘটনাচক্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু সে সময়কার প্রতিকূল পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যক্তিগত স্বার্থ, দলীয় স্বার্থের উর্ধে গিয়ে মৃত্যুকে পরোয়া না করে তাজউদ্দীন আহমদ যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাতে তাকে যথাযথভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করা এবং যথাযথ সন্মান জানানো এই জাতির দায়িত্বই বটে। একদিকে দেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আক্রমণ, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত অন্যদিকে খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র, মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্ব মাথায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়তে তাজউদ্দীন আহমদকে কাজ করতে হয়েছে।
প্রিয় পাঠক, শিক্ষা, রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এমন সব ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ যে কতটা উন্নত চিন্তার অধিকারী ছিলেন সেসবের কিছুই এই লেখায় তুলে ধরা হয় নি। এই লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাঠ্যপুস্তক এবং মুখে স্বাধীনতার চেতনার তুবড়ি ছোটানো আলোচকদের আলোচনার বাইরে থাকা তাজউদ্দীনকে আপনাদের সামনের উপস্থাপন করা।
তথ্যসূত্র-
১। জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, ৩ জুলাই ২০১২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ‘তাজউদ্দীন আহমদ স্মারক বক্তৃতা’
২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ২০১৪ সালে তাজউদ্দীন আহমদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ড কর্তৃক আয়োজিত ‘তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবন’ শীর্ষক বক্তৃতা
৩। তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রথম বাংলাদেশ সরকার, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ স্মারক বক্তৃতা, তাজউদ্দীন আহমদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৪
৪। তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের আলোকে, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক
৫। তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা, শারমিন আহমদ