বাংলাদেশ

ড. কুদরত-এ-খুদার জীবনী1 min read

ডিসেম্বর ১০, ২০১৯ 4 min read

author:

ড. কুদরত-এ-খুদার জীবনী1 min read

Reading Time: 4 minutes

তখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের দখলে। সময়টা ১৯০০ সালের ১০ মে (১৩০৭ বঙ্গাব্দের ২৬ বৈশাখ)। জন্মগ্রহণ করলেন বাংলার আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদা। যিনি কিনা পরবর্তীতে নিজের কর্ম দিয়ে হয়ে উঠেন স্বদেশপ্রেম ও মানবসেবার এক মূর্ত প্রতীক।

কুদরত-এ-খুদার পারিবারিক পরিচয়

কুদরত-এ-খুদা বেড়ে উঠেছেন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। কুদরত-এ-খুদার জন্মস্থান বীরভূমের মাড়গ্রামের মাতুলালয়ে। কিন্তু তাঁর পিতৃভূমি মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার সীমানাবর্তী মৌগ্রামে। বাবা হযরত সৈয়দ শাহ সুফী খোন্দকার আব্দুল মুকিদ এবং মা সৈয়দা ফাসিয়া খাতুন। বাবা ছিলেন সে যুগের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির স্নাতক। সে সময়টায় ইংরেজি জানা মানুষ খুব সহজেই সরকারি অফিসে চাকরি পেত। কিন্তু খোন্দকার আব্দুল মুকিদ এসব কাজে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করেন। 

মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদার শিক্ষাজীবন

কুদরত-এ-খুদার প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল গ্রামের মক্তব। কিন্তু মক্তবের শিক্ষকদের নির্মম অত্যাচার কুদরতের শিশুমনে ভীতি সঞ্চার করে। একদিন ছোট্ট কুদরত মক্তবে গিয়ে দেখেন তাঁর সহপাঠীকে ঝুলিয়ে শাস্তি দিচ্ছেন স্বয়ং মক্তবের হাফেজ। এরপর থেকে শত চেষ্টা করেও তাকে মক্তবমুখী করানো যায় নি। তাই তাঁর বাবা মা তাঁকে কলকাতার মাড়গ্রামে বড় মামার কাছে পাঠিয়ে দেন। ততকালীন পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় গ্রাম ছিল মাড়গ্রাম। সেখানে ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল এম. ই. স্কুলে কুদরত-এ-খুদা আবার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এ স্কুলে বাংলার প্রচলন না থাকায় তিনি উর্দুতে শিক্ষাগ্রহণ করেন। 

সফলতার সাথে এম. ই. স্কুলের পাট চুকিয়ে ভর্তি হন কলকাতা মাদ্রাসায়। ১৯১৮ সালে প্রথম দশের মধ্যে থেকে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর ১৯২৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়নে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে কুদরত-এ-খুদা ছিলেন আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র। এরকম দুর্দান্ত রেজাল্ট থাকার পরও কুদরত-এ-খুদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার সুযোগ পান নি। কিন্তু মেধাবীদের কেউ ঠেকাতে পারে না। মুহম্মদ কুদরতকেও পারে নি। তিনি ব্রিটেনের অধ্যাপক জে. এফ. থর্পের কাছে গবেষণা করে ১৯২৯ সালে অত্যন্ত সফলতার সাথে ডক্টর অব সায়েন্স (ডি. এসসি.) ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর এ অসামান্য অর্জন ভারতবর্ষকে এনে দিয়েছিল অন্যরকম সম্মান। কেননা কুদরত-এ-খুদা ছিলেন গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম মুসলিম ডি. এসসি. ডিগ্রিধারী। আর সমস্ত ভারতীয় নাগরিকের মধ্যে অষ্টম ডি. এসসি. ডিগ্রী অর্জনকারী। এর পাশাপাশি তিনি লন্ডনের ‘সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ তেও ডক্টরেট হন।

ড. কুদরত-এ-খুদা

বর্ণাঢ্য কর্মজীবন

কর্মজীবনের শুরুতে মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদা অধ্যাপক হিসেবে ১৯৩১ সালে যোগ দেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৩৬ সালে বিভাগীয় প্রধানের আসন অলংকৃত করেন। ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। তাঁর একান্ত অনুরোধে কুদরত-এ-খুদা যোগ দেন ইসলামিয়া কলেজে। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সফলতার সাথে তিনি ইসলামিয়া কলেজের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে পুনরায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিরে যান।

এরপর তো ইতিহাস। সেই ১৯৪৭। ভাগাভাগি হয়ে গেল ভারত-পাকিস্তান। তখন কুদরত-এ-খুদা পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এসেই পূর্ব পাকিস্তানের জনশিক্ষা দফতরের পরিচালক পদে যোগদান করেন। পরবর্তী দুই বছর তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলা ভাষার জন্য কাজ করেন। বাংলা ভাষাকে নিয়ে লিগ সরকারের চক্রান্ত কুদরত-এ-খুদা সমর্থন করেন নি। তাই তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হল। আবার ১৯৫০ সালেই পাকিস্তান সরকার খানিকটা বাধ্য হয়ে মুহম্মদ কুদরতকে বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা বানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কুদরত-এ-খুদা পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৫৩ সালে তিনি এ পদ থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৫৪-৫৫ এই এক বছর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের বিজ্ঞান ও শিল্প সংক্রান্ত গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করা হলে তিনি পদত্যাগ করেন।

শুরু হয় ড. মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদার জীবনে এক নতুন অধ্যায়। স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। নব্য বাংলাদেশের শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হন তিনি। ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তিনি নানা সংস্কারমূলক কাজ করেন।

কুদরত-এ-খুদার বিজ্ঞান গবেষণা

ড. মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদা আমাদের দেশের অর্থাৎ ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে দেশকে সমৃদ্ধ করা যায় তা নিয়ে করেছেন বিস্তর গবেষণা। অবিভক্ত বাংলার কৃষি, খনিজ বা জলজ সম্পদ নিয়ে গবেষণা করেছেন বহু বছর। কুদরত-এ-খুদা ১৯২৭-৪৭ এই একুশ বছরে বিশুদ্ধ রসায়ন নিয়ে একুশটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ‘কিটোল্যাকটাল টটোমারিজম’ নিয়ে যে ছয়টি গবেষণা প্রকাশ করেছেন তা বিজ্ঞানমহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রথম পাঁচটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল জার্নাল অব কেমিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন- এ। আর শেষেরটা ১৯৪৭ সালে জার্নাল অব ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটিতে। ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবেষণা কেন্দ্রের পাকিস্তান জার্নাল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চে তিনি মোট আঠারোটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।

তাঁর অনেকগুলো পেটেন্টের মধ্যে পাটের পেটেন্ট নয়টি। তার মধ্যে পাট থেকে সুতা, পাটবীজ থেকে তেল, পাটকাঠি থেকে বোর্ড ও কাগজের মন্ড, পাটের অপজাত থেকে রেয়ন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও গুড় থেকে সুক্রোজ, ল্যাকটিক এসিড, ভিনেগার প্রভৃতির চারটি পেটেন্ট আছে। তামাক পাতার বদলে কুন্ডিপাতা ব্যবহারের পেটেন্ট নিয়েছিলেন ড. কুদরত। এসব উদ্ভিদের পাশাপাশি আরো অনেক ভেষজ উদ্ভিদের উপর গবেষণা করেছেন বিশ্ববরেণ্য এ বিজ্ঞানী।

লেখক কুদরত-এ-খুদা

মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদা শিল্প ও কৃষি ব্যবস্থা নিয়ে ‘যুদ্ধোত্তর বাংলার কৃষি ও শিল্প’ নামের তিয়াত্তর পৃষ্ঠার একটি বই লেখেন। কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে এ বইটি অকাট্য দলিলস্বরূপ। ১৯৩৯ সালে ‘বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী’ নামে তিনি একটি বই লেখেন। এম. এসসি-এর শিক্ষার্থীদের জন্য রসায়ন শাস্ত্রের উপর বাংলায় বেশ কয়টি বই লিখেছেন তিনি। এছাড়াও তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য বই হলো, বিজ্ঞানের সরস কাহিনী, বিজ্ঞানের সূচনা, জৈব রসায়ন, পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প সম্ভাবনা, পরমাণু পরিচিতি, বিজ্ঞানের পহেলা কথা, পবিত্র কোরআনের পূত কথা, অঙ্গারী জওয়ারা প্রভৃতি। এছাড়া ড. মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদা ১৯৬৩ সালে ‘পুরোগামী বিজ্ঞান’ ও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘বিজ্ঞানের জয়যাত্রা’ নামে দুটি বিজ্ঞান সাময়িকী সম্পাদনা করেন।

সম্মাননা

ড. মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদা তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে এ দেশকে উপহার দিয়েছেন বিজ্ঞানের এক নতুন জগৎ। দেশের উন্নয়নে তাঁর অসামান্য সব অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও দেয়া হয়েছে অনেক সম্মাননা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিনি একুশে পদক, মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রভৃতি সম্মাননা পেয়েছেন। এছাড়া পাকিস্তান সরকার তাঁকে তঘমা ই পাকিস্তান, সিতারা ই ইমতিয়াজ প্রভৃতি সম্মানে ভূষিত করে।

১৯৭৭ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকায় মহান এ বিজ্ঞান প্রেমিক আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নেন। শিক্ষাব্রতী ও গবেষক ড. মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদা তাঁর কর্মফলের মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন আজীবন। 

লেখক- নিশাত সুলতানা 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *