কতটা ঝুকিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি?1 min read
Reading Time: 5 minutes“প্রবৃদ্ধি এখন সুতা কাটা ঘুড়ির মতো। সরকার যে পরিসংখ্যান বা উপাত্ত দিচ্ছে তাঁর সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই।“ – ডক্টর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য (ঢাকায় অনুষ্ঠিত সিপিবির এক সংবাদ সম্মেলনে)
ছোট্ট একটি বাক্য। প্রশ্নবিদ্ধ করছে অনেক কিছুকেই। এত দিন পর্যন্ত মনে করা হচ্ছিল উন্নয়ন ঘটলেও তা হচ্ছে এক পাক্ষিক। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, একটি গোষ্ঠী হঠাৎ করে প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হচ্ছে। অন্য দিকে সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর আয় যতটুকু বাড়ছে, জীবন যাত্রার ব্যয় এর সাথে হিসেব মেলালে তার অগ্রগতি সামান্যই। অথচ আয়ের সুষম বন্টন ঘটলে এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না।
কিন্তু এখন সিপিডি বলছে জিডিপি এর যে গ্রোথ সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে তার একটা বড় অংশ সরকারি ব্যয় দ্বারা প্রভাবিত। বরং আমাদের অর্থনীতি আছে ঝুঁকির মুখে। আমাদের বিশ্লেষণেও সেরকমটাই ধরা পরেছে। আমাদের বিবেচনায় নেওয়া প্রায় প্রতিটি নির্দেশক, সূচকে অবনমন ঘটেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির।
-
বেসরকারী বিনিয়োগ
বেসরকারী বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি গত কয়েক বছর ধরেই ২৩% এ আটকে আছে। অর্থাৎউদ্যোক্তারা নতুন করে আর বিনিয়োগ করতে খুব বেশি আগ্রহী হচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে এই বিশাল “সম্ভবনাময়” অর্থনীতি যেখানে সুশাসনের নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে(!), সেখানে আমাদের নিজস্ব বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে প্রবৃদ্ধি নেই কেন? নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রেও।
-
ঋণ
বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে কম। ব্যাংকিং সেক্টরের রুগ্ন অবস্থা, ব্যাংক থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ, খেলাপি ঋণ এবং বিনিয়োগকারীদের প্রতি ব্যাংক এর অনাস্থা এর মূল কারণ। আবার অনেকেই ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন, লাভ করতে পারছেন না। সিপিডির সাম্প্রতিক এক বক্তব্য জানিয়েছে বেসরকারী ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি গত বছর আগস্টে ছিলো ১৪.৯৪%, যা আগাস্ট ২০১৯ এ দাঁড়িয়েছে ১০.৬৮%। এটা মনিট্রি পলিসিতে উল্লেখিত টার্গেট ১৩.২% এরও অনেক কম।
এই অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার থেকে বারবার সুদ হার কমানোর নির্দেশনা দেওয়া হলেও তারল্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।মজার ব্যাপার হচ্ছে এই মুহূর্তে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মিলিত বরাদ্দ থেকেও বেশি। পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই অনাদায়ী ঋণ এর এই পরিমাণ শুধু মাত্র সরকারী হিসাব অনুযায়ী। বাস্তবের অবস্থা আরো ভয়াবহ।
-
ভেংগে পড়ছে ব্যাংকিং খাত?
ব্যাংকিং খাতের অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝতে গ্রহণযোগ্য সূচকগুলো হলো সম্পদের বিপরীতে আয়, নিট সুদ আয় ও সুদবহির্ভূত আয়। ইকুইটির বিপরীতে আয়, খেলাপি ঋণের হার, মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিত সংরক্ষণের হারও বিবেচনায় নেয়া হয় এক্ষেত্রে। গত ১০ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতের এই সব সূচকেই ধারাবাহিক অবনমন হয়েছে।
কোনো ব্যাংকের আরওই(Return on Equity) ১০ শতাংশের বেশি হলে সেটিকে আদর্শ ব্যাংক হিসেবে ধরা হলেও চলতি বছরের জুন শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর গড় আরওই ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও ২০১০ সালে দেশের ব্যাংকগুলোর গড় আরওই ছিল ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা মূলধন জোগান দিয়ে বছর শেষে বিনিয়োগকারীদের আয় হচ্ছে ৩ টাকা, যা দেশের মূল্যস্ফীতিরও প্রায় অর্ধেক।
একইভাবে বড় বিপর্যয় হয়েছে ব্যাংকের সম্পদের বিপরীতে আয়ে (ROA)। কোনো ব্যাংকের আরওএ ৩-৪ শতাংশ হলে সেটিকে আদর্শ মানদণ্ডে বিচার করা হয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আরওএ এর গড় ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকগুলোর আরওএ শূন্য দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে বছর শেষে ব্যাংকের নিট আয় হচ্ছে মাত্র ২০ পয়সা।
শুধু ইকুইটির বিপরীতে আয় বা সম্পদের বিপরীতে আয়ই নয়, বরং এক দশকে সম্পদের বিপরীতে নিট সুদ আয় ও সুদবহির্ভূত আয়, মূলধনের অনুপাত, খেলাপি ঋণের হার, মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিত সংরক্ষণের হারে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত।
-
পোশাক খাতে অনিশ্চয়তা
চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ কমেছিল তৈরি পোশাকের রফতানি। পতনের এ ধারা অব্যাহত পরের মাসেও। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) তৈরি পোশাক রফতানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে গেছে। একইভাবে কমেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানিও। সব মিলিয়ে অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সামগ্রিক রফতানি কমেছে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ।
মূলত অসম ও অনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে তৈরী পোশাকের রফতানিমূল্য প্রতিনিয়ত কমছে। অথচ শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন কারখানা। একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন জানাচ্ছে- গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়েছে অন্তত এক হাজার ৩০০ কারখানা। আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ না হলেও হাতে কাজ না থাকায় সাময়িকভাবে উৎপাদনে নেই আরো অন্তত দেড় হাজার কারখানা। এতে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন লাখ লাখ শ্রমিক। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রফতানি আয়ে।
রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, তৈরী পোশাকের উৎপাদন খরচ প্রতি বছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। বিপরীতে উৎপাদিত পণ্যের দাম না বেড়ে প্রতিনিয়ত কমছে। এ সময়ে প্রধান রফতানি বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পোশাকের দরপতন হয়েছে ৭ শতাংশের বেশি। ইউরোপে দরপতন হয়েছে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রা অবমূল্যায়ন হলেও বাংলাদেশে স্থিতিশীল রয়েছে। এসবের প্রভাবে দুর্যোগের ঘনঘটা বাজছে রফতানি বাণিজ্যে ৮৪ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী তৈরী পোশাক শিল্পখাতে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে বিশ্বে পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৮ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫৪ বিলিয়ন ডলারে; অর্থাৎ ক্রেতাদের চাহিদা কমেছে, যা মূল্যভিত্তিক বাজার প্রতিযোগিতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। বিজিএমইএ গবেষণা সেলের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৮ এই চার বছরে এক হাজার ২০০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নিকট ভবিষ্যতে আরো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। রফতানি বাণিজ্যের চাহিদা অনুযায়ী গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকা, দীর্ঘ লিড টাইম এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কম থাকায় প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে বলে জানা গেছে।
তবে শ্রমিক সংগঠন গুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট এইটি সূত্রের দাবি অন্যরকম। তাদের দাবি-“এটা এক ধরনের প্রোপাগান্ডা। দেশের রপ্তানি একটুও কমেনি৷ তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আসলে বড় পুঁজির কাছে ছোট পুঁজির মালিকেরা মার খাচ্ছেন, ছোট কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে৷ বড়দেরগুলো কিন্তু আরও বড় হচ্ছে৷ অভিযোগ, বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। বিদেশে টাকা পাঠিয়ে গার্মেন্ট কারখানা মালিকরা বলছেন সব শেষ৷
-
খারাপ খবর বিদেশে শ্রমিক রপ্তানিতেও
২০১৮ সালে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে ২৭ শতাংশ। এ বছরের প্রথম তিন মাসেও নিম্নমুখী ধারায় আছে শ্রম রপ্তানি। এর থেকে উত্তরণের জন্য নতুন বাজার খোঁজার বিকল্প নেই। কিন্তু সেখানেও লক্ষণীয় কোনো উদ্যোগ নেই।
দেশের শ্রম রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। বড় শ্রমবাজারের অন্যতম সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া। সৌদি আরবে বেকারত্ব বেড়ে এখন ১২ শতাংশ। ফলে সে দেশে বাজার সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আরব আমিরাতের বাজার খুললেও তা সীমাবদ্ধ শুধু গৃহশ্রমিক খাতে। এই তিন বড় বাজারে সংকটের কারণে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন কর্মী কাজ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যান। আগের বছর এটি ছিল ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন। আবার গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) জনশক্তি রপ্তানি ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ২০১ জন। এ বছর তা ১৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৯৯ জন।
-
সংকুচিত হচ্ছে পুরোনো শ্রমবাজার
অভ্যন্তরীণ বেকারত্ব কমাতে ১২ ধরনের কাজে কোনো বিদেশি নেবে না সৌদি আরব। এসব কাজে যুক্ত পুরোনো প্রবাসীরাও দেশে ফিরে আসছেন। সরকারের পক্ষ থেকে আরব আমিরাতের বাজার খুলে যাওয়ার দাবি করা হলেও বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। পুরুষ শ্রমিকদের বাজার সেখানে কার্যত বন্ধ। গত বছর সেখানে শ্রম রপ্তানি ছিল ১ শতাংশের কম। এ বছর তিন মাসে গেছেন মাত্র কয়েক শ নারী শ্রমিক। তবে দুই দেশের সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী, ধীরে ধীরে ১৯টি পেশায় পুরুষ কর্মী নেওয়ার কথা রয়েছে।
তবে আরো ভয়ের খবর জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থা স্টান্ডার্ড এন্ড পুওর( Standard & Poor)। প্রবাসী শ্রম শক্তির একটি বড় অংশ মধ্য প্রাচ্যে নির্মাণ কাজের সাথে জড়িত। তেলের দাম পরে যাওয়া, অটোমেশন এবং পারিপার্শ্বিক কারণে দ্রুতই নির্মাণ শ্রমিকের চাহিদা হ্রাস পাবে। বিপরীতে বৃদ্ধি পাবে নার্স, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইটি প্রফেশনাল এবং শিক্ষক এর চাহিদা। কিন্তু এই বিষয়ে এখনো যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই সরকারের।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি এই অর্থনীতি ভেংগে পরার সম্ভবনা আছে? যদি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে কোন অলৌকিক ঘটনা না ঘটলে অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা কখন তা এখনই বলার সময় আসেনি। কেবন মাত্র ফাটল গুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া গেলে এখনো সত্যিকারের প্রবৃদ্দির পথে যাওয়া সম্ভব। যে উন্নয়নে একটি মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী নয়, উন্নয়ন হবে সবার।
পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ- বাংলা ইনফোটিউবের এই বিশ্লেষণ বিভিন্ন সংস্থা এবং জাতীয় দৈনিকের বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে তৈরী। এটি সেই অর্থে কোন মৌলিক বিশ্লেষণ নয়। এটি কোন পূর্বাভাস বা ভবিষ্যত বাণীও নয়।