জোকারে ফিনিক্সিয় উপাখ্যান1 min read
Reading Time: 6 minutesগ্রিক মিথোলজি অনুসারে ফিনিক্স পাখির প্রথাগত কোন মৃত্যু নেই। পূর্ণবয়স্ক ফিনিক্স মরে ছাই হলে তা থেকেই জন্ম নেয় নতুন অনুসারী। ছাই সরিয়ে নবজন্ম নেয়াই ফিনিক্সের নিয়তি ও পরিণতি। সেটাই যেন জোকারে দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে প্রমাণ করলেন ওয়াকিন ফিনিক্স।
হিথ লেজারের পর আর কেউ যে ‘জোকার’ চরিত্রের প্রতি সুবিচার করবেন- সেই আশা প্রায় সবাই ছেড়েই দিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে লেজারই সেরা ‘জোকার’; কিন্তু টড ফিলিপসের ‘জোকার’ হিসেবে ফিনিক্সও একেবারে কম নন।
গল্পটা আমাদের
এ বছর আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘Live from Dhaka’ দেখেছেন তারা অনেকেই প্রধান চরিত্র সাজ্জাদের দোটানার সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারবেন। সেই সাজ্জাদের মতোই অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক বা নিরাপত্তার প্রশ্নে কমবেশি সবাই আমরা অনিশ্চিত। তবুও চাওয়ার পাল্লাটা খুব হাল্কাই আমাদের। পেটপুরে খাওয়া, ছাপোষা চাকরি, একটু নিরাপত্তা আর একটু প্রিয়জনের উষ্ণতা। ব্যস! অল্প ভালোবাসা পেলেই আমাদের জীবনটা বেশ কেটে যায়। কিন্তু এই আটপৌরে জীবনযাপনেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বিভেদ, অবিচার। আর তারই প্রতিফলন ঘটে একসময় মানসিক বৈকল্যে।
জোকার চলচ্চিত্রের আর্থার ফ্লেক যেন আমাদেরই প্রতিরূপ। পৃথিবীর কাছে যার চাওয়া অল্প একটু সম্মান আর হাস্যরসে জনতাকে বিনোদিত করা। কিন্তু কী ঘটে তাঁর সাথে? যার পরিণতিতে সে হয়ে ওঠে বিকারগ্রস্ত এক খুনি? চলুন তবে শুনে নেই তাঁর গল্পটা।
আর্থার ফ্লেক- আমি অথবা আপনি
১৯৮১ সালের গোথাম শহর। এরই পুরোনো বাসিন্দা আর্থার ফ্লেক। শহরের স্যাঁতসেঁতে, নোংরা, কর্দমাক্ত পরিবেশে প্রতিদিন যুঝতে হয় তাঁকে। বঞ্চনা, ক্ষুধা, ক্লেশের সাথে প্রতিদিন লড়াই করতে করতে ক্লান্ত সে।অথচ মুখে হাসি টেনে রাখা যে বাধ্যতামূলক। ভাঁড়বেশে কখনো দোকানের সাইন হাতে, কোনদিন হাসপাতালে ,কোনদিন মঞ্চে অভিনয় করতে হয় তাঁকে। এসবই করতে হয় পেটের দায়ে। কেননা ওই অল্প কটা টাকার চাকরিতেই ঘোরে আর্থার ও তার অসুস্থ মা পেনির সংসারের চাকা। অথচ মন পড়ে থাকে স্ট্যান্ড আপ কমেডির রসিকতায়। ফ্র্যাঙ্কলিন মারের কমেডি অনুষ্ঠানেও ভীষণ আগ্রহ। আর্থারের গোটা জীবনটাই যেন রসবোধের জন্য উৎসর্গ করা। সিনেমার শেষ লাইনে সেজন্যই উচ্চারিত হয় ‘I used to think that my life was a tragedy. But now I realize, it’s a comedy.’
অল্পগল্প শুনে মনে হচ্ছে , বেশ তো আর্থারের জীবন! না, এর পেছনেও আছে ভয়ানক এক সত্য আর অস্তিত্বহীনতার সংকট। তাঁর পেশা নিয়ে খোঁটা দেবার লোকের অভাব নেই। তাছাড়া প্রত্যহ বুলিং, মারধোর তো আছেই। তবুও প্রয়োজন আর মায়ের প্রতি ভালোবাসার খাতিরে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে। নিয়মিত সাইকোথেরাপির কাউন্সেলিংয়ে যেতে হয় তাঁকে, এক কড়া ওষুধও বেঁধে দেয়া। তবুও সারছে না ভেতরে অসুখ, বাড়ছে টানাপোড়েন। সিউডোবুলবার এফেক্টে (PBA) আক্রান্ত হওয়ার ফলে আর্থার কখনোই তাঁর হাসি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। তাই তাঁর অস্বাভাবিক অট্টহাস্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় প্রায়ই।
এরই মধ্যে কর্পোরেশন বন্ধ করে দেয় এই থেরাপির ব্যবস্থা। শেষ আশাও যেন হারিয়ে যায় ফ্লেকের। এর মাঝে হাসপাতালের শিশুদের বিনোদন দেবার চাকরিটাও খুইয়ে বসে সে। এরপরেই শুরু হয় মূল ট্র্যাজেডি। ফেরার পথে মেট্রোরেলে আকস্মিক আক্রমণে খুন করে বসে তিন যুবককে। নিছকই দুর্ঘটনা হিসেবে একে মেনে নিতে পারতো ফ্লেক। কিন্তু ক্রমশ জন্মপরিচয়ে ধোঁয়াশা, প্রেমিকা সোফির সাথে সম্পর্কের অবনতি, মানসিক অসুস্থতার মাত্রা বৃদ্ধি আর সর্বোপরি কলুষিত সমাজের আঘাতে বদলে যায় সে। খুনি জোকার হয়ে ওঠে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক বিপ্লবের নাম।
আর্থারের সাথে আমাদের সবচাইতে বড় মিল হতাশায়, রাগ ও অনুকম্পায়। কড়াইয়ের ব্যাঙের মতো আমরাও প্রতিদিন মানিয়ে চলতে শিখি সমাজের সাথে। কিন্তু সেই সমাজই একদিন বিষাক্ত ছোবলে মৃত্যু ডেকে আনে। আর্থারও আমাদের মতো দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এক মানুষ। এই সমাজ তাঁকে পরিচয় দেয়নি, দেয়নি সুস্থতার নিশ্চয়তা, এমনকি মাথা গোঁজার ঠাই কেড়ে নিতেও ছিল বদ্ধপরিকর। প্রবল নিরাশা, ক্রমাগত বিষাদ, আত্মশ্লাঘা তাঁকে ঠেলে দিয়েছে আত্মবিকৃতির পথে। তাই তো বারবার প্রশ্ন আসে, ‘Is it just me, or is it getting crazier outside?’ এ যেন ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের প্রতি বিদ্রুপ!
লরেন্স শেরের সিনেমাটোগ্রাফিই সেই প্রতিদিনের গল্পকে দিয়েছে আলাদা ব্যঞ্জনা। গোথামের নোংরা গলি ঘুঁজি থেকে আর্থার যখন মেয়র থমাস ওয়েইনের প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন আচমকাই বন জুন হোর ‘প্যারাসাইটে’র কথা মনে হতেই পারে। একই শহরে একই আকাশতলে কী অতুল বৈষম্য! অথচ আর্থারের লোভ প্রাসাদে নয়, আত্মপরিচয়ে।
ফিনিক্সের চ্যালেঞ্জ
জোকার চরিত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী? হিথ লেজারকে পেরিয়ে যাওয়া নাকি ‘জোকার’কে নিজের ভেতর ধারণ করা? ইতোমধ্যেই ফিনিক্স প্রমাণ করেছেন নিজেকে।
চরিত্রের উৎস কমিক বুক হলেও ফিলিপসের ‘জোকার’ মূলত প্রথাগত সমাজের ত্রুটিগুলো তুলে ধরেছে। কোন অতিমানবীয় সুপার ভিলেন নয়, এমনকি সমাজ শত্রুও নয় এই জোকার। উল্টো ক্রমাগত শোষিত, বঞ্চিত পৃথিবীরই এক প্রতিভূ সে। যার মুখে দামি- পুষ্টিকর খাবার রোচে না, যাকে প্রতিদিন সহ্য করতে হয় গঞ্জনা, শূন্যতা যার সর্বাঙ্গীণ সঙ্গী। অনাদরে ক্লিষ্ট শুকনো শরীরেই দৈনিক জীবনযুদ্ধে নামতে হয় তাঁকে। পুরু সাদা-লাল মেকআপের আড়ালে ব্যর্থ কমেডিয়ানের আখ্যান লুকাতেই কেটে যায় সময়।
জোকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে বরাবরই ঠাণ্ডা মাথার অপরাধীকে দেখনো হয়েছে। কিন্তু এই ছবিতে একজন অনুভূতিপ্রবণ, একাকীত্বে ভোগা- বিষণ্ণ জোকারকে পেয়েছে দর্শক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি দৃশ্যে ফিনিক্স তাঁর শীর্ণ দেহ নিয়ে ফ্রিজে ঢোকেন। এ যেন উষ্ণতার আশায় দ্বারফেরত মানুষের নিজেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা। যার অনুভূতিকে কেউ বুঝতে চায়নি, উন্মাদ বলে তাড়িয়ে দিয়েছে- প্রচণ্ড অভিমানে সেই যেন সকল আবেগকে হিমবন্দি করে ফেলতে চাইছে আজ। সেই অসীম শূন্যতা আর আত্ম বিদ্রুপকে চিত্রনাট্য থেকে রক্তমাংসে এনেছেন ফিনিক্স। চেইন স্মোকার এই চরিত্রের জন্য ৫০ পাউন্ড ওজন ঝরিয়েছেন তিনি। জোকারের বেসামাল হাসির জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছেন দীর্ঘদিন। শুটিং শুরুর ৬ সপ্তাহ পরেই তিনি আর্থার থেকে ‘জোকার’ হিসেবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। সেই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ‘ব্যাপারটা ছিল ভ্রমণের মতো। ধীরে ধীরে আর্থার থেকে ক্রুদ্ধ জোকারে পরিণত হয়েছি।‘
ডি নিরো বনাম ওয়াকিন ফিনিক্স
সত্তরের ক্লাসিক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ‘Taxi Driver’ এর ট্র্যাভিস বিকলের সাথে তুলনা করা হচ্ছে ফ্লেককে। মার্টিন স্করসিস পরিচালিত সেই ছবিতে রবার্ট ডি নিরোর চরিত্রও ছিল একাকীত্বে ভোগা, সামাজিকভাবে নিগৃহীত এক যুবকের। কিছু সংলাপেও বেশ মিল রয়েছে এই দুই সিনেমার। যেমন-
‘I got some bad ideas in my head.’ (Taxi Driver, 1976)
‘All I have is negative thoughts.’ (Joker, 2019)
ট্র্যাভিস আর আর্থার দুজনই PTSD বা পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডারে দীর্ঘদিন ধরে ভুগেছেন। এমনকি দুজনের ভেতর নৈরাশ্য আর একাকীত্ব এতটাই মারাত্মক আঁকার ধারণ করে যে ট্র্যাভিস সিনেটর প্যালেন্টাইনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। আর তারই প্রতিরূপ দেখা যায় জোকারে। ফ্লেকও থমাস ওয়েইনের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে ওঠে, লাইভ টেলিকাস্ট লেট নাইট শোতে ফ্র্যাঙ্কলিন মারেকে খুনও করে সে।
বেশ কিছু দৃশ্যায়নে এই দুই চরিত্রকে একে অন্যের বিকল্পও মনে হয়েছে। যেমন- ট্র্যাভিসের সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘Are you talking to me?’ –এর কথা ভাবুন। সিনেটরকে হত্যার পর আতঙ্কিত জনতাকে কীভাবে নিজের পরিচয় জানাবেন- তা নিয়ে প্রায় তিন মিনিটের শট ছিল মুভিতে। তেমনটাই দেখা যায় জোকারেও। মুখচোরা ফ্লেককেও আমরা দেখতে পাই নিজ ঘরে প্রস্তুতি নিতে। তখন তাঁর মুখে সংলাপ- ‘Would you like to hear a joke?’
কিছুটা মিল আছে দুজনের বিব্রতকর প্রথম ডেটেও। ট্র্যাভিস যেমন পর্ণ দেখাতে গিয়ে বিব্রত করেছিল বেটসিকে, তেমনি আর্থারের স্ট্যান্ড আপ কমেডিতেও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়েছিল সোফি। তবে মজার ব্যাপার হলো, জোকারে ফ্র্যাঙ্কলিন মারে চরিত্রে দেখা গেছে রবার্ট ডি নিরোকেই।
পরিচালকের ভাবনা
কিন্তু পরিচালক টড ফিলিপস জানান ভিন্ন কথা, ‘ আমাদের প্রয়োজনটা ছিল ফিনিক্সের ভেতর জোকারের পুনর্জন্ম ঘটানো। জোকারের ভেতর ফিনিক্সকে ঢোকানো নয়।‘ আর সে কারণেই হয়তো বা আর্থার চরিত্রকে আপন আলোয় ফুটিয়ে তুলেছেন ফিনিক্স। ফিলিপস অবশ্য ওয়াকিনের মেদ ঝরাবার পক্ষপাতী ছিলেন না। রসিকতা করে বলেন, ‘আমি কিন্তু ফিনিক্সকে বলেছিলাম একটু ওজন বাড়িয়ে নিতে। গোলগাল জোকারকে কেউ তো আগে দেখে নি!’
৫৫ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত ‘জোকার’ এখন পর্যন্ত আয়ের করেছে ৫৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ প্রসঙ্গে বক্স অফিসের প্রধান বিশ্লেষক শন রবিনস সিএনএন বিজনেসকে বলেন, ‘ এই সাফল্যের মূল কারণ হলো শক্তিশালী এক সৃজনশীল দলের শ্রম। ছবিটাকে শুধু কমিক চরিত্রের এডাপশন না বরং নতুন এক কমিক জগতের উত্থান বলা যায়।‘
এক মহাকাব্যিক উন্মোচন
গোটা সেলুলয়েড জুড়েই ছিল শিল্প আর যুঝতে থাকা জীবনের বিপরীতমুখী স্রোত। পেনি আর আর্থারের রসায়ন যেমন করুণা জাগিয়েছে তেমনি অসহায়ত্বেরও চিত্র দেখিয়েছে। ক্লোজ শটের ফিল্মোগ্রাফি অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তুলতে বেশ সহায়তা করেছে। এছাড়াও অনেকগুলো শটই ছিল মনে রাখার মতন। বিশেষ করে তিন যুবককে হত্যার পর বাথরুমে হিল্ডার গুরনোডোটির কম্পোজিশনে স্লো মোশনের নাচ যেন নবজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছে। রোলিং স্টোনের মিক জেগার এবং ডেভিড বাউয়ির ‘ড্যান্সিং ইন দ্য স্ট্রিটস’ অনুকরণে নাচের মুদ্রাও এই জোকারের শৈল্পিক উপস্থাপন নিশ্চিত করেছে।
শেষ দৃশ্যে ফ্র্যাংক সিনাত্রার ‘That’s Life’ গানটি একই সাথে আশা এবং নিরাশার রাজসিক উপস্থাপন। জোকারের অরিজিন স্টোরিগুলোর মধ্যে এটিই বেশ মানবিকভাবে উপস্থাপিত। জোকার কীভাবে আরখাম এসাইলামে ভর্তি হলো –সে প্রশ্নেরও জবাব মিলবে এতে। ব্যাটম্যান সিরিজের সব ছবিতে থমাস ওয়েইনকে মহান দেখানো হলেও এখানে সে পুঁজিবাদের প্রতিনিধি। আর্থারের জৈবিক পিতা হবারও আভাস আছে এতে। অর্থাৎ বেশ প্রশ্নবিদ্ধ চরিত্র হিসেবে আছেন মেয়র সাহেব।
জোকার ভিনগ্রহ থেকে আসা কোন ভিলেন নয়। কিন্তু এটিই আমাদের মনে করিয়ে দেয় সভ্যতার উচ্চকিত সিঁড়িতে উঠলেও সমাজ এখনও বিকল, ব্যর্থ। মেটাফোর হিসেবে ছবিতে চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’ এর প্রদর্শনী দৃশ্য যেন মনে করিয়ে দেয় আরেক প্রহসনের কথাই, ‘পুঁজিবাদী যন্ত্র যখন সব দখল করে নেবে, তখন মানবতার পরিণতি কী ?’