Why so serious?
সমালোচক মহল আর জনতার রায় খুব কম সময়েই এক রেখায় মিলেছে। সেই দুঃসাধ্যই সাধন করেছিলেন প্রয়াত হিথ লেজার। নেপথ্যে ডিসি কমিকসের অবিস্মরণীয় চরিত্র ‘জোকার’। উপরোক্ত সংলাপের দুরন্ত জনপ্রিয়তাই তার প্রমাণ।
ব্যাটম্যান ট্রিলজির ‘দ্য ডার্ক নাইট’ সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ থ্রিলারের জায়গা করে নিয়েছে এই জোকার চরিত্রের গুণেই। প্রথমদিকে সুপার হিরোদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হলেও বেশ অবহেলিতই ছিল ভিলেনরা। তবে থানোস, ম্যাগনেটো, ডক্টর ডুম, লোকি, লুথরের সুবাদে সুপার ভিলেনরাও এখন আইকনিক মডেলে পরিণত। আর সেই মিছিলে সবার আগে জ্যাক ন্যাপিয়ের ওরফে জোকার।
জোকারের উত্থান
ভিলেন মানেই মন্দ, হিরো মানেই সাহসী- এই ধারণা বদলে দিয়েছে ডিসি আর মারভেল কমিকস। বরং ‘ভিলেনরা সর্বদাই সুদূরপ্রসারি চিন্তা করে।‘ এই ধারণাকেই উস্কে দিতেই সৃষ্টি ব্যাটম্যানের চিরশত্রু ‘জোকার’ এর। ১৯৪০ সালে ‘ব্যাটম্যান’ কমিকসের এপ্রিল কিস্তিতে প্রথম দেখা যায় এক নতুন ধাঁচের ভিলেনকে। বিল ফিঞ্জারের লেখনিতে বব কেন এবং জেরি রবিনসন কমিকসের পাতায় ফুটিয়ে তোলেন জোকারকে। বব কেন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ এমনিতেই আমরা ব্যাটম্যানের জন্য শক্ত প্রতিপক্ষের কথা ভাবছিলাম। এর মধ্যে রবিনসন প্রায়ই কার্ড পেটাতে আসতো। সেই তাসের জোকার দেখেই বিল একদিন বলল, দেখ, এটাকে অনেকটা অভিনেতা কনরাড ভেইটের মতো দেখাচ্ছে, তাই না! ব্যস, এভাবেই শুরু হলো জোকারের যাত্রা।‘
তখন বব, ফিঞ্জার বা জেরি কেউই আঁচ করতে পারেন নি এই চরিত্রই বদলে দিতে যাচ্ছে ইতিহাসকে। প্রথম কিস্তিতেই জোকারকে মেরে ফেলার কথা ভেবেছিলেন ফিঞ্জার। অথচ পরবর্তীতে বারবার ব্যাটম্যানের যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে ফিরে এসেছে ডার্ক হিউমারে পূর্ণ জোকার। স্যাডিস্ট ( যে অপরকে নির্যাতন করে আনন্দ পায়), সিজোফ্রেনিক ( সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত), সাইকোপ্যাথ এই চরিত্রটিকেই এখন সর্বকালের সেরা সুপার ভিলেন মানা হয়।
কমিকসে জোকারের জীবন বৃত্তান্ত কখনোই পরিষ্কার ভাবে বলা হয়নি। এক কিস্তিতে বলা হয়, জ্যাক ছিল একজন কমেডিয়ান। সাফল্য তো দূরের কথা, অর্থাভাবে গর্ভবতী স্ত্রীর মৃত্যু দেখতে হয়েছিল তাকে। ‘রেড হুড’ নামে এক সন্ত্রাসী দলও খুলে সে। আরেক জায়গায় দেখা যায়, ব্যাটম্যানের কারণেই এক রাসায়নিক দুর্ঘটনায় বীভৎসভাবে মুখ পুড়িয়ে ফেলে জ্যাক। আবার ‘নির্যাতক বাবা’র গল্পও শোনা যায় জোকারের মুখে। চেহারা বিকৃতির জন্য স্পষ্টভাবে কোন কাহিনীকেই সমর্থন জানায় নি চরিত্রটি, উল্টে তার মুখে শোনা গেছে –‘ অতীতের ব্যাপারে বহুবিধ ধারণা পোষণ করতেই আমি ভালোবাসি।‘ পুরো মুখে সাদা পাউডার, টকটকে লাল লিপস্টিক, সবুজাভ অবিন্যস্ত চুল, কাটা মুখ আর প্রলয়ঙ্করী হাসি- এই নিয়েই জোকার।
পাতা থেকে পর্দায়
জোকার বরাবরই অনিশ্চয়তার প্রতীক। গৎ বাঁধা কোন পরিকল্পনা নেই, কিন্তু অন্য খল চরিত্রের চাইতে অনেক বেশি সংযত, দুর্ধর্ষ সে। কখনো হাতে পিস্তলের ছড়রা, কখনো মার্বেলের এলেবেলে ব্যবহার, আবার কখনো বোমার প্রলয়ঙ্করী আঘাতে পর্যুদস্ত করাই জোকারের কাজ। সে কখন কী করবে, কী ভাববে আগে থেকে কিছুই আঁচ করা যায় না। তার আবিষ্কৃত ‘জোকার ভেনম’ স্মাইলেক্স যেন এক প্রহসনমূলক অস্ত্র। এর এক ডোজে হাসতে হাসতেই হয়তো আপনি প্রবল যন্ত্রণা ভোগ করবেন, প্যারালাইজডও হয়ে যেতে পারেন।
হৃদয়হীন কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধিধারী এই চরিত্র কমিকসের পাতায় পাকাপাকি আসন গড়ে তুলেছিল আগেই। নির্মাতারা পরে একে রূপালি পর্দায় আনেন। ১৯৬৬ সালের ‘ব্যাটম্যান’ টেলিভিশন সিরিজে প্রথম দেখা যায় জোকারকে। কমিকস, বই, গেমস, ড্রামা সিরিজ, চলচ্চিত্রসহ নানা মাধ্যমে, এ পর্যন্ত ২৫০ টি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জোকারকে নিয়ে কাজ করেছে।
জোকার চরিত্রে আজ অব্দি বেশ কজন প্রথিতযশা অভিনেতাকে দেখা গেছে। পর্দার জোকার সম্পর্কে চলুন অল্প জেনে নিই।
সিজার রমেরো
১৯৬৬-৬৮ সাল অব্দি এবিসি নেটওয়ার্কে ‘ব্যাটম্যান’ সিরিজ প্রচারিত হয়। কমিকসের পাতা থেকে সেই প্রথম রক্ত মাংসে এই সুপার হিরোকে দেখতে পায় ভক্তরা। তবে এর উপরি পাওনা ছিল জোকার চরিত্রে সিজার রমেরোর অভিনয়। গোথাম সিটির শত্রু হিসেবে মুন্সিয়ানার পরিচয় দেন এই অভিনেতা। সিরিজ বাদেও ১৯৬৬ সালে ‘Batman: The Movie’ তেও দুর্ধর্ষ অভিনয় করেন প্রথম জোকার।
জ্যাক নিকোলসন
তালিকায় ছিল রবিন উইলিয়ামস, উইলিয়াম ডিফো, ব্র্যাড ডরিফ, টিম কারির মতো বাঘা বাঘা সব অভিনেতার নাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয় জ্যাক নিকোলসনেরই। ১৯৮৯ সালে টিম বার্টন পরিচালিত ‘Batman’ কে ক্লাসিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে জোকার চরিত্রটিই। ১৯৮৮ সালেই এর জন্য ৬ মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিক নেন নিকোলসন। শুধু রুপায়নেই নয়, অদ্ভুত মেকআপের জন্যও ছবিটি পায় অনন্য মর্যাদা। নিক ডুডমেনের মেকআপের ফলে নিকোলসনকে সত্যিকার অর্থেই জ্যাক ন্যাপিয়ার মনে হয়েছিল।
স্ট্যানলি কুবরিকের ‘The Shining’ দিয়ে আগেই সাইকোপ্যাথ চরিত্রে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন জ্যাক। তাই বব কেনও তাকে কাস্ট করতেই আগ্রহ দেখান। কমিকস আর সিরিজ থেকে জোকার যখন থিতিয়ে আসছিল তখন এটিই জোকারের পুনরুত্থান ঘটায়। ব্রিটিশ একাডেমি এ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব এ্যাওয়ার্ড প্রভৃতিতে সেরা পার্শ্ব চরিত্রের মনোনয়নও পান তিনি।
মার্ক হামিল
মার্ক হামিলের গল্পটা ভিন্ন। ১৯৯২-৯৫ সাল পর্যন্ত প্রচারিত ‘Batman: The Animated Series’ এ জোকারের কণ্ঠ দেন হামিল। এতেই তুমুল প্রশংসা জোটে তাঁর। অনবদ্য হিউমার, বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু প্রহসনে ভরপুর কৌতুক দিয়ে মন জয় করে নেয় হামিলের জোকার। এই সিরিজেই জ্যাকের বান্ধবী হারলে কুইনকে প্রথম দেখা যায়।
হিথ লেজার
“They laugh at me because I’m different. I laugh at them because they’re all the same.”
হিথ লেজারের উচ্চারিত প্রতিটি সংলাপই পেয়েছে আইকনিক সংলাপের উচ্চতা। ক্রিস্টোফার নোলানের ব্যাটম্যান ট্রিলজি আর জোকার রূপে লেজারের রসায়ন- সিনেমাবোদ্ধাদের কাছে ভালোবাসারই নামান্তর।
এই চরিত্রের জন্য রবিন উইলিয়ামস, আড্রিয়েন ব্রডিও ধর্না দিয়েছিলেন। কিন্তু নোলানের পছন্দ ছিল হিথকে। চরিত্রের খাতিরে লেজারও নিজেকে পুরোপুরি ঢেলে দিয়েছিলেন। যদিও তিনি প্রথমে ক্রিশ্চিয়ান বেলের ‘ব্যাটম্যান’ চরিত্রের জন্যই অডিশন দিয়েছিলেন। নোলানের নির্দেশেই লেজার ক্রমে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন। অ্যালান মুর ও ব্রায়ান বোল্যান্ডের ‘The killing joke’, গ্র্যান্ট মরিসন ও ডেভ ম্যাককিনের ‘Arkham Asylum: A Serious House on Serous Earth’ পড়ে ফেলেন, ডিসি কমিকসের জোকার সম্পর্কেও পড়তে থাকেন অবিরত। কুবরিকের A Clockwork Orange থেকেও ধারণা নেন। একমাস নিজেকে হোটেল ঘরে বদ্ধ রেখে বুঝতে চেষ্টা করেন জোকারের মানসিক অবস্থা। সেসময় নিয়মিত ডায়রি লিখতেন তিনি।
পর্দায় লেজার যেভাবে জোকারকে তুলে ধরেছেন, তার সাথে শুধু নিকোলসনকেই তুলনা করা সম্ভব। অনিন্দ্য অভিনয়ের জন্য ২০০৯ এ অস্কারও জেতেন তিনি। তবে ছবি মুক্তির আগে অর্থাৎ ২০০৮ সালের ২২ জানুয়ারি ওষুধের ওভারডোজে মারা যান লেজার। অধিকাংশের ধারণা, জোকার চরিত্রটিই তাঁকে বিষাদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এছাড়াও ইনসোমনিয়া, অতিরিক্ত বিষণ্ণতার সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।
ক্যামেরন মোনাহান
২০১৪ থেকে চলে আসা সিরিজ ‘গোথামে’র শেষ কিস্তিতে (২০১৯ এপ্রিল) দেখা গেছে জোকাররূপি ক্যামেরন মোনাহানকে। ওয়ারনার ব্রাদার্সের ব্যানারে এই সিরিজে ক্যামেরন প্রশংসিতও হন। সমালোচকেরা তাকে ‘ আধুনিক ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ নামেও অভিহিত করেন।
জেরেড লেটো
নিকোলসন, লেজার যেখানে জোকার দিয়ে অনন্য মাইলফলক রেখে গেছেন সেখান থেকেই শুরু করার কথা লেটোর। ২০১৬ সালের ‘সুইসাইড স্কোয়াডে’র জন্য তার প্রস্তুতিও ছিল দারুণ। কিন্তু লেটোর জোকারকে খুব একটা পছন্দ করেনি দর্শক, সমালোচকেরাও লেজার পরবর্তী জোকারকে নিয়ে হতাশ। ছবিতে খুব কম সময়ই পেয়েছেন লেটো। জোকার হিসেবে অসফলই বলা যায় তাকে।
ওয়াকিন ফিনিক্স
ডিসি ব্ল্যাক লেবেলের আওতায় মুক্তি পেতে যাচ্ছে ‘জোকার’ ছবিটি। ডিসি ইউনিভার্সের বাইরে ডিসি কমিকসের মূল চরিত্রগুলোকে নিয়েই কাজ করে ব্ল্যাক লেবেল। তাদের অভীষ্ট দর্শক এলেবেলে নয়, বলা যায় অনেকটা বোদ্ধা গোছের। অতএব ক্লাসিক এই চরিত্রে অভিনেতা নির্বাচনে বেশ হ্যাপা পোহাতে হয়েছে তাদের। ‘Her’, ‘You were never really here’, ‘The Master’ সহ বহু ছবি দিয়েই মেধার পরিচয় দিয়েছেন ওয়াকিন ফিনিক্স। তাই ফিনিক্সকে ঘিরে বেশ নিশ্চিন্তই ডিসি।
৪ অক্টোবর গোটা বিশ্বে মুক্তি পেয়েছে ওয়াকিন ফিনিক্সের ‘জোকার’। টড ফিলিপস পরিচালিত ছবিটি ইতোমধ্যেই সমালোচকদের মন জয় করে নিয়েছে। এবারের ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সম্মানজনক ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কারও অর্জন করে নিয়েছে এটি।