জামাল খাসোগি– কি ঘটেছিল তাঁর ভাগ্যে?1 min read
Reading Time: 3 minutes২ অক্টোবর, ২০১৮ – দুপুর বেলা বাগদত্তা হাতিস সেঙ্গিজকে নিয়ে তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে এলেন সাংবাদিক জামাল খাসোগি। তাদের বিয়ের জন্য কিছু কাগজপত্র দরকার ছিল, সে জন্যই আসা কনস্যুলেটে। বাগদত্তার হাতে নিজের ফোন দিয়ে প্রবেশ করেন কনস্যুলেটে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হল, তিনি বের হননি । বাইরে তখনো ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছেন হাতিস। বিকেল ৫টা বেজে গেল,কনস্যুলেট অফিস বন্ধ হয়ে গেল,কিন্ত খাসোগজি তখনো বের হননি। এভাবে হাতিস সেদিন রাত ১ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন, কিন্ত তিনি তখনো ফেরেননি। আর ফিরবেনও না।
কে ছিলেন জামাল খাসোগি?
১৯৫৮ সালের ১৩ অক্টোবর মদিনায় জন্মগ্রহন করেন জামাল আহমেদ খাসোগি। তাঁর দাদা মুহাম্মাদ খাসোগি ছিলেন সৌদি রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আজিজ আল সৌদের নিজস্ব চিকিৎসক। আমেরিকার ইন্ডিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে নিজের পড়াশুনা শেষ করেন তিনি। তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হয় সৌদি গেজেটে প্রতিবেদক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে। তিনি আল-হায়াতে বিদেশি প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। সে সময় তিনি মধ্য প্রাচ্যের ইরান, আফগানিস্তান, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে সংবাদ কাভার করেন। যার ফলে তাঁকে মধ্যপ্রাচ্যের উপর অভিজ্ঞ মনে করা হতো। যদিও পরের দিকে কোন সংবাদপত্রেই তিনি বেশিদিন কাজ করতে পারেননি, কারণ তাঁর সম্পাদকীয় নীতি। এর বাইরে তিনি সৌদি প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সালের মিডিয়া উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১৭ সালের জুনে তিনি আমেরিকায় চলে আসেন এবং ‘দা ওয়াশিংটন পোস্ট’ এর কলামিস্ট হিসেবে যোগ দেন। মৃত্যর আগ পর্যন্ত সেখানে তিনি কর্মরত ছিলেন।
জামাল খাসোগির রাজনৈতিক মতামত
খাসোগি মনে করতেন যে সৌদির উচিত ১৯৭৯ পূর্ব সময়ের নিয়মনীতি ফেরত আনা। তিনি আরও বলতেন যে সৌদির এখন উচিত এমন কোন উপায় বের করা যা সেক্যুলারিজম ও সৌদির নীতি দুটোকেই জায়গা করে দিবে, যেমনটি রয়েছে তুর্কিতে। ছেলে ও মেয়েদের সমান অধিকার নিশ্চিত করবে ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিবে। কাতারের উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য তিনি সৌদির সমালোচনা করেন।
এছাড়া তিনি সৌদির সাথে লেবাননের সমস্যা ও কানাডার সাথে কূটনৈতিক সমস্যা থাকার জন্যও সমালোচনা করেন। যদিও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের বেশকিছু সংস্কারকাজের প্রশংসা করেছেন তিনি। কিন্ত নারীবাদী কর্মী লুজাইন-আল-হাথলুল এর গ্রেফতার ও আরও দুই কর্মীর গ্রেফতারের জন্য তিনি সমালোচনা করেন। এছাড়া তিনি ইয়েমেনের উপর সৌদির হামলারও সমালোচনা করেন। তার মতে ক্রাউন প্রিন্স যদিও সংস্কার করতে ইচ্ছুক, কিন্ত তিনি সৌদির নীতির বিপক্ষে যেকোনো অবস্থান নিলে তা তিনি কঠোর ভাবে দমন করেন।
তার এসকল মতামত সৌদি কখনোই ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। সেজন্য তিনি নিজ দেশে পত্রিকার সম্পাদক বা চ্যানেলের হেড কোন পদেই টিকতে পারেননি। ওয়াশিংটন পোষ্টের পক্ষ থেকে বলা হয় যে খাসোগি সাইবার বুলিং এর শিকার হতেন, এবং তা করা হত সৌদির পক্ষ থেকে। ২০১৮ সালে তিনি নতুন রাজনৈতিক দল খুলেন ‘ডেমোক্রেসি ফর আরব ওয়ার্ল্ড নাউ’ নামে, যা প্রিন্স সালমানের জন্য নতুন রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে দাঁড়ায়। এমন একেকটা কারণ অজান্তেই তাঁর মৃত্য পরোয়ানা জারি করে ফেলে।
খাসোগির গুপ্তহত্যা
গত ২ অক্টোবর তিনি তুর্কির সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন। কিন্ত তারপর তিনি আর বের হননি, এমনকি সিসি ক্যামেরাতেও তাঁকে প্রবেশ করতে দেখা যায় কিন্ত বের হতে দেখা যায়নি। তাঁকে নিখোঁজ ঘোষণা করা হয়। ৪ তারিখে তুর্কির পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সৌদি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায়। কিন্ত তিনি তাঁর দেশের এ ব্যাপারে কোন অংশগ্রহন নেই বলে দাবি করেন। এদিকে তুর্কি কর্তৃপক্ষ দাবি করছিল যে খাসোগি কনস্যুলেটে অবস্থান করছিলেন।
৫ অক্টোবর মুহাম্মদ বিন সালমান ব্লুম্বারগকে বলেন যে খাসোগি কিছুক্ষণ পরে বা এক ঘণ্টা পরেই বের হয়ে যান। তারা নিজেদের পররাষ্ট্র মন্ত্রলায়ের মাধ্যমে তদন্ত করছেন সেসময় কি ঘটেছিল জানার জন্য। তিনি তুর্কি পুলিশকে তদন্ত করার আহবান জানান। তুর্কিদের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে তুর্কিরা চাইলে এসে কনস্যুলেট সার্চ করে দেখতে পারে। ১৫ অক্টোবর তুর্কি পুলিশ সৌদি কন্স্যুলেটে সার্চ করতে যায় এবং খাসোগি হত্যার প্রমান পাওয়ার কথা বলে।
১৯ তারিখে সৌদি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে যে খাসোগি মারা গেছেন। তারা বলেন যে কনস্যুলেটের ভেতরে হাতাহাতিতে তিনি মারা যান। ২১ তারিখে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রী আদেল-আল-জুবেইর বলেন যে ক্রাউন প্রিন্সের অজ্ঞাতে এক বিদ্রোহী অপারেশনে মারা গেছেন খাসোগি। এরই মাঝে বিশ্বনেতারা প্রায় সবাই সৌদিকে এ হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ ও সঠিক তদন্ত করতে বলেন। এদের মাঝে ট্রাম্প, থেরেসা মে, এরদোয়ান প্রভৃতি অনেকেই আছেন। ৩১ তারিখ জানানো হয় খাসোগিকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে ও তাঁর দেহকে টুকরো করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি এগারোজন সন্দেহভাজনকে এ হত্যার অভিযোগে সৌদি আদালতে তোলা হয়।
মুহাম্মদ বিন সালমানের ভূমিকা কি?
শুরু থেকেই খাসোগির অন্তর্ধান ও হত্যার জন্য দায়ী হিসেবে মুহাম্মদ বিন সালমানের নামই আসছিল। কারণ খাসোগি সৌদি প্রিন্সের বিরোধিতা করে লিখতেন। এমনকি তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন ও নিয়েছিলেন গ্রেফতার এড়ানোর জন্য। প্রথম থেকেই সৌদি কর্তৃপক্ষ ক্রাউন প্রিন্সকে নির্দোষ দাবি করে আসছে। অস্বীকার-স্বীকারের কাহিনী পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত বলা হয় মুহাম্মাদ বিন সালমানের অগোচরে এই ঘটনা ঘটেছে। তিনি কোনভাবেই এ বিদ্রোহী অপারেশনের অনুমতি দেননি।
সৌদি অস্বীকার করলেও পশ্চিমা বিশ্বে অনেকের ধারণা যে অনুমতি অবশ্যই দিয়েছেন ক্রাউন প্রিন্স। সৌদি তে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কিছুই হয় না। সেখানে এত বড় একটা মিশন প্রিন্স সালমানের অগোচরে করা হবে- ব্যাপারটা আসলেও সন্দেহজনক। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ- এর প্রধান জিনা হাস্পেল এ বিষয়ে সিনেটে কথা বলেন এবং সরাসরি অভিযুক্ত করেন মুহাম্মদ বিন সালমানকে। কিন্ত এতে কোন লাভ হয়নি।
তবে সেদিন যায় ঘটে থাকুক না কেন, এটা স্পষ্ট যে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছিল। বলিষ্ঠ কণ্ঠের জন্য মুসলিম বিশ্বের অন্যতম গুরত্বপুর্ণ ব্যক্তি ছিলেন খাসোগি। কিন্ত রাজনীতির মারপ্যাচে পড়ে সৌদি প্রশাসনের কাছে প্রান হারালেন এই মানুষটি।