জাপান বাংলাদেশের কেমন বন্ধু?1 min read
Reading Time: 3 minutesস্বাধীন বাংলাদেশের সাথে জাপানের বন্ধুত্বসুলভ রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ১৯৭২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন প্রায় শত বছর পূর্বেই হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার আগে থেকেই বাঙালীদের সাথে জাপানের বেশ সুসম্পর্ক রয়েছে। একটা সময় ভারতবর্ষের এই অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ কারিগরি শিক্ষার জন্য জাপান অভিমুখে গমন করতো এবং সেই ধারা আজ পর্যন্তও অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও জাপানের বন্ধুত্বসুলভ আচরণ অনেক সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য জাপানের শিক্ষার্থীরা সেই সময় তাদের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর স্বাধীনতার পরপরই এই সম্পর্ক সুন্দর করে রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ফলপ্রসূ জাপান সফর করেছিলেন। এর পরবর্তীতে বিভিন্ন সরকারের আমলে বাংলাদেশ সরকার জাপানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিল। এমনকি স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসা প্রত্যেক সরকার প্রধানই জাপান সফর করেছিলেন।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বেড়েই চলছে। বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগের সাথে সাথে জাপান সরকার থেকেও সরাসরি প্রচুর সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে আসছে বাংলাদেশ। জাপান থেকে ঠিক যেমন বিভিন্ন পণ্য আমদানি করা হয় ঠিক তেমনই জাপানে বাংলাদেশী পণ্যের রপ্তানিও বেড়েছে আগের থেকে। অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলাদেশ-জাপানের এই ধরনের সম্পর্ক বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে নতুন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাপান ভ্রমণ করে আসলেন এবং এই ভ্রমণের সময় বাংলাদেশের যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ খাতে বেশ বড় ধরনের বিনিয়োগের চুক্তি করেছে জাপান। এরমধ্যে মাতারবাড়ি ও সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানসিট লাইন-১ সহ আরো বেশ কিছু প্রকল্পে জাপানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ। বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গিয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জাপানের সহায়তায় কক্সবাজার এলাকায় ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ। এসব ছাড়াও জাপানের পক্ষ থেকে আরো বড় ধরনের বেশ কিছু বিনিয়োগের আভাস পাওয়া গিয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে জাপানের অন্যান্য আরো কয়েকটি বিনিয়োগ
যেখানে ২০০৮ সালে জাপানের প্রায় ৭০টি কোম্পানি বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনে ব্যবসা ও বাণিজ্যে কর্মরত অবস্থায় ছিল সেখানে বিগত ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা বিপুল সংখ্যক হারে বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় ২৭৮টি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে।
জাপানের জনপ্রিয় মোটর সাইকেল ব্র্যান্ড হোন্ডা বাংলাদেশে তাদের মোটরসাইকেল তৈরি কারখানা তৈরি করেছে। একই সাথে জাপানের আরেকটি ব্র্যান্ড ইয়ামাহার কারখানা তৈরি করছে এসিআই নামক গ্রুপ। এই কারখানা তৈরিতে এসিআই গ্রুপের সাথে সহযোগিতা করছে ইয়ামাহা কর্পোরেশন।
অপরদিকে তামাক জাতীয় দ্রব্য উৎপাদনকারী জাপান টোব্যাকো বাংলাদেশের অনেক পুরানো তামাক ব্যবসা আকিজ গ্রুপকে কিনে নেয়। এই তামাক প্রকল্পে জাপান টোব্যাকো বাংলাদেশে প্রায় ১৪৭ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। এছাড়া ইস্পাত উৎপন্নকারী প্রতিষ্ঠান নিপ্পুন ইস্পাত দেশীয় একটি কোম্পানি ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রোডাক্ট এর সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে প্রকল্প স্থাপন করছে। জাপানের তথ্য অনুযায়ী বিগত ২০১৮ সালে বিভিন্ন জাপানি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার সাতশ পঞ্চাশ কোটি জাপানিজ ইয়েন বিনিয়োগ করেছে।
থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উন্নতির পেছনে যেমন জাপানিজদের প্রবল ভূমিকা রয়েছে ঠিক তেমনই আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারেও জাপানিজদের আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলছে। জাপান বাংলাদেশের এই বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য কেবল এক তরফাই নয়, তথ্য অনুযায়ী বিগত বছর ২০১৮ সালে জাপানে প্রায় ১১৭ কোটি ডলারের সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ এবং এই সংখ্যা তারও আগের বছর থেকে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি। অপরদিকে একই সময়ে জাপান থেকেও প্রায় ১৮৭ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে বাংলাদেশে।
জনশক্তি রপ্তানি করে বাংলাদেশ একটা বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। তবে এই দিক থেকে জাপানে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি বেশ হতাশা জনক। জাপানে বাংলাদেশের মানুষের সংখ্যা একদমই কম যেখানে অন্যান্য দেশের অনেক মানুষ জাপানে প্রতিনিয়তই যাচ্ছে। তবে এর অন্যতম একটি প্রধান দক্ষ শ্রমিকের অভাব। জাপানে বেশীরভাগ মানুষ যারা বিভিন্ন দেশ থেকে কাজ করতে যায় তারা নির্দিষ্ট সেই কাজের উপর অনেক দক্ষতা রাখে। সেদিক থেকে বাংলাদেশী জনশক্তি এখনো তেমন দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। এছাড়াও জাপানি ভাষা শেখাটা বাঙ্গালীদের জন্য বেশ কঠিনই।
এদিকে চীনও বাংলাদেশে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছে। চীন ও জাপানের একই সাথে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাওয়াটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেক কূটনীতি বিশেষজ্ঞ। আর তাই জাপানের সাথে সুসম্পর্কের কারণে জাপানের সাথে বৈরি সম্পর্কের দেশ চীনের সাথে যেন বাংলাদেশের সম্পর্কের কোন অবনতি না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখছেন দেশের সরকার এবং কূটনৈতিকরা। জাপান ও বাংলাদেশের শত বছর পুরনো এই বন্ধুত্ব দিন দিন আরো শক্তিশালী হবে বলে কূটনৈতিকরা ধারণা করছেন।