ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথ প্রদর্শক ও মহাত্মা গান্ধীর যোগ্য রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী জওহরলাল নেহরু ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতের সর্বপ্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। নব্য ভারত গঠনের বিশাল চ্যালেঞ্জ সামলে নিয়ে তিনি বহুধর্ম-বর্ণের ভারতকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর নড়বড়ে ভারতে তাঁর ফলপ্রসূ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং শিক্ষামূলক সংস্কার কোটি কোটি ভারতীয়র হৃদয়ে তাঁকে উচ্চাসীন করেছিলো। দীর্ঘ ১৭ বছরের শাসনামলে তিনি ভারতের সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসা ও শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়েছেন।
জওহরলাল নেহরু ছিলেন একাধারে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন রাজনীতিবিদ, পন্ডিত, প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ এবং লেখক। পন্ডিত জওহরলাল নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন।
তিনি অত্যন্ত উদারমনের একজন মানুষ ছিলেন। প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বিমান হামলার পর হিংস্র পশুগুলো চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে লোকালয়ে গিয়ে মানুষের উপর আক্রমণ করতে পারে, এই সন্দেহে ১৯৪৯ সালে জাপানের টোকিও চিরিয়াখানার প্রায় সব বন্য পশুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তাই, টোকিওর শিশুদের জন্য জওহরলাল নেহরু ইয়েনো চিরিয়াখানায় একটি ভারতীয় হাতি উপহার দেন।
জওহরলাল নেহরুর প্রথম জীবন এবং পরিবার
১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর গঙ্গার তীরঘেষা এলাহাবাদ শহরে বিখ্যাত আইনজ্ঞ মতিলাল নেহেরু ও স্বরুপ রাণীর কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে এসেছিলেন ভারতীয় ইতিহাসের এই মহাসারথি।
১৫ বছর বয়স পর্যন্ত গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশুনা করার পর তাঁকে ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করতে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি প্রথমে হ্যারো এবং পরবর্তীতে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে যোগ দেন। লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করে ২২ বছর বয়সে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি তাঁর বাবা ব্যারিস্টার মতিলাল নেহরুর সাথে আইন অনুশীলন করা শুরু করেন।
বাবা-মায়ের পছন্দে ১৯১৬ সালে তিনি ১৭ বছরের কমলা কৌলকে বিয়ে করেন। তখন তাঁর বয়স ছিলো ২৭। বিয়ের এক বছর পর তাদের কোল আলোকিত করে একমাত্র সন্তান ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী পৃথিবীতে আসে।
রাজনীতিতে জওহরলাল নেহরু
১৯১৭ সালে তৎকালীন বিখ্যাত ধর্মীয় পন্ডিত এনি বেসেন্ত গ্রেফতারের ঘটনাটি নেহরুকে “অল ইন্ডিয়া হোম রুল লীগ”-এ যোগদান করতে অনুপ্রাণিত করে। এরপর ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার এক অদ্ভুত ও অমানবিক আইন পাশ করে। সেই আইনে সন্দেহভাজন রাজনৈতিক শত্রুদের আটক করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো। অর্থাৎ ব্রিটিশ সেনাদের যাকে সন্দেহ হবে তাকেই ধরে নিয়ে জেলে অত্যাচার করতে পারবে এমন একটা বিষয়।
এই আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলাকালে ১৯১৯ সালের এপ্রিলে ব্রিটিশ সেনারা হাজার হাজার নিরস্ত্র বেসামরিক লোকের উপর গুলি চালায়। সেদিন গুলিতে ৩৭৯ জন লোক নিহত হয় এবং প্রায় এক হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা অমৃতসর গণহত্যা নামে পরিচিত। অমৃতসর গণহত্যার পর নেহরুর মনে ব্রিটিশ বিরোধী প্রচন্ড ক্ষোভ জন্ম নেয়। তখন থেকেই তিনি স্বাধীন এবং সার্বভৌম ভারতের তাগিদ অনুভব করতে থাকেন।
এদিকে মহাত্মা গান্ধীর দর্শন ও নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে তিনি অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২০-১৯২২) সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে যান। এজন্য তাঁকে প্রথমবারের মতো কারাভোগও করতে হয়। ব্রিটিশ শাসনামলের পরবর্তী আড়াই দশকে ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অপরাধে দীর্ঘ নয় বছর তিনি কারাগারেই কাটিয়েছেন।
১৯২৯ সালে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি ব্রিটেনের কাছ থেকে ভারতের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে নিয়মিত প্রচার প্রচারণা চালিয়ে গিয়েছেন। একই বছর ৩১ ডিসেম্বর রাভি নদীর তীরে এক জনসভায় তিনি স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৩০ সালে লবণের উপর কর আরোপ করার প্রতিবাদে নেহরু গুজরাটসহ ভারতের অন্যান্য অংশে ভ্রমণ করে গণআন্দোলনের ডাক দেন। কয়েকদিনের মাথায় গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। উল্লেখ্য যে, ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ সাল এই সময়ের মাত্র চার মাস ছাড়া বাকি সম্পূর্ণ সময়টা তিনি বোন এবং স্ত্রীসহ কারাগারে কাটিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের ভাইসরয় ভারতীয় নেতাদের সাথে কোনরূপ আলোচনা ছাড়াই, ব্রিটেন-ভারতকে মিত্রশক্তির বিরূদ্ধে যুদ্ধে যোগদানের ঘোষণা দেয়। এর প্রতিবাদে সিংহভাগ কংগ্রেস নেতা কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। যুদ্ধের পর ভারতীয়দের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হবে এই আশায় নেহেরু বৃটিশদের সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধশেষে বৃটিশ সরকার কংগ্রেস নেতাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করলে বাধ্য হয়ে গান্ধী ও বল্লভ ভাই প্যাটেল আন্দোলনের ডাক দেন।
শুরুর দিকে জওহারলাল নেহরু ও মাওলানা আজাদ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে কংগ্রেস “ভারত ছাড়” আন্দোলনের ডাক দেয়। শুরুতে সম্মতি না থাকলেও দলের সিদ্ধান্তে “ভারত ছাড়” আন্দোলনকে জনপ্রিয় করতে নেহরু ভারতের বিভিন্ন স্থানে সফর করেন। ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট “ভারত ছাড়” প্রস্তাব পাশ হওয়ার ঠিক একদিন পর নেহরু এবং গান্ধীসহ কংগ্রেসের অন্যান্য প্রায় সব কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৫ সালের জুন মাস অবধি তাদের প্রায় সবাইকেই কারাবন্দি থাকতে হয়েছিলো।
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারতীয় জনমত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভারতে নিযুক্ত তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল কর্তৃক আহূত সিমলা কনফারেন্স ব্যার্থ হলে, ২৯ আগস্ট ১৯৪৫ সালে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
১৯৪৫ সাল থেকে জেল থেকে বের হয়েই নেহরু তাই ১৯৪৬ এর নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। নির্বাচনের আগে থেকেই নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিমদের জন্য আলাদা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবী জানিয়ে আসছিলেন। তিনি চাইছিলেন ভারতকে ধর্মের ভিত্তিতে দুইভাগ করা হোক। মুসলিমদের জন্য আলাদা করে পাকিস্তান নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবিতে স্বোচ্চার ছিলেন তিনি। জওহারলাল নেহরু তাঁর দাবিকে সাধুবাদ জানান। ভারত ভাগে তাঁর প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিলো।
অবশেষে ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হয়।
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু
১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভের পর জওহরলাল নেহরু স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু সদ্য পাওয়া স্বাধীনতা এবং প্রধানমন্ত্রীত্বের স্বাদ উদযাপনের মতো যথেষ্ট ফুসরত ছিলো না নেহরু এবং তাঁর সরকারের। কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু থেকেই দুই দেশের মধ্যে বিরোধ চলছিলো। এছাড়া ভারত-পাকিস্তান জন্মের মাধ্যমে আলাদা ধর্মীয় সীমারেখা তৈরি হওয়ায় ভারতজুড়ে ভয়ানক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। দুই দেশ থেকেই লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। প্রাণ যায় অগণিত নীরিহ মানুষের। নেহরুকে এই সাম্প্রায়িক দাঙ্গা থামানোর জন্য বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিলো। তবে তিনি নিঃসন্দেহে সফল হয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেহরু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ছিলেন। ১৯৫১ সালে তাঁর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিনি ভারতে ব্যাপক শিল্পায়নের উৎসাহ দেন। শিল্পায়ন এবং কৃষিক্ষাতের সমন্বয়ে এক মিশ্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধন করাই ছিলো তাঁর উদ্দেশ্য। বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আধুনিক ভারত গঠনের জন্য তিনি গোটা ভারতজুড়ে অসংখ্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। এছাড়াও কুসংস্কারচ্ছন্ন ভারতে বিভিন্ন সামাজিক সংস্কার, বিনাপয়সায় শিক্ষা, নারীদের আইনী অধিকার-সম্পত্তির অধিকার ও স্বামীকে তালাক দেওয়ার মতো আইনগুলো সংস্কার করছিলেন।
বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধচলাকালীন সময় নেহেরু নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানালে সমালোচনার মুখে পড়েন। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে চীন ভারতের উত্তর সীমান্ত আক্রমণ করে বসলে তিনি বৈদেশিক সহায়তার অনুরোধ জানালে আবারও তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
জওহরলাল নেহরুর মৃত্যু
চীন-ভারত যুদ্ধের সময় নানাবিধ চিন্তায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৬৪ সালে কাশ্মীর থেকে ফেরার পথে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। একই বছর ২৭ মে নিজ কার্যালয়ে দায়িত্বরত অবস্থায় জওহরলাল নেহরু মৃত্যুবরণ করেন।
জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী এবং নাতি রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।