‘তুমি রবে নীরবে,
হৃদয়ে মম।‘
কথাটা আজ সত্যিই একজনের সাথে বড় যায়। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা নক্ষত্র– হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলী, রূপা, নিলু প্রমুখ বিখ্যাত চরিত্র তাঁর কলমের কালিতেই পেয়েছে জীবন।
কারো কাছে তিনি গল্পের জাদুকর, কারো কাছে তিনি চিরন্তন শিল্পের প্রতিনিধি। বাংলাদেশের তরুণদের একটা বড় অংশকে সাহিত্যমুখী করেছেন তিনিই। শুধু তাই নয়, বর্তমানে উদীয়মান যত লেখক ও শিল্পানুরাগী– তাদের অধিকাংশেরই হাতেখড়ি হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়ে বা নাটক দেখে।
শুধু সাহিত্যিক হিসেবে হুমায়ূনকে পরিচিত করতে গেলে বেশ অবিচারই হবে। তাঁর মতো এত বিপুল প্রতিভা, সাহিত্য–চলচ্চিত্র–নাটক প্রতিক্ষেত্রে সফল পদচারণ– অত্যন্ত বিরল। বাংলা সাহিত্য তথা শিল্পের আঙিনায় হুমায়ুনহীন সপ্তম বছর পার করছি আমরা। আমাদের আজকের লেখনীর বিষয় তাই হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত সেরা ৫ টি চলচ্চিত্র।
আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সংখ্যা অগণিত নয়। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে , এই মহান যুদ্ধের বীরত্ব গাঁথা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচায়ক। সে সাহসটাই দেখিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্রের বিষয় ছিল একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সংগ্রাম।
হুমায়ূন আহমেদের নিজ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, শিলা আহমেদ, দিলারা জামান প্রমুখ। সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্রটি ১৯ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে জয় করে নেয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আরও আট বিভাগে সেরার তকমা।
শ্রাবণ মেঘের দিন (১৯৯৯)
‘একটা ছিল সোনার কন্যা, মেঘবরণ কেশ।‘ সুবীর নন্দীর সুললিত কণ্ঠের এই গানটি শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া ভার। এই গানের সুবাদেই প্রধানত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ পরিচিতি পায়। এছাড়াও বারী সিদ্দিকির গাওয়া ‘সুয়াচান পাখি’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানগুলোও মুখে মুখে ফিরতে থাকে।
গ্রামীণ পটভূমিকায় মতি–কুসুম–সুরুজের ত্রিভুজ প্রেম এবং এর বিয়োগান্তক পরিণতিই ছবির মূল কাহিনী। তবে প্রেমের বাইরেও সরল গ্রাম্য জীবন, জমিদারের কর্কশ শাসন, বিরহ, নদীর সাথে মানবজীবনের নিবিড় সম্পর্ক– সব মিলিয়েই অনন্য এক চিত্র উঠে এসেছে এতে।ছবিটিতে গোলাম মোস্তফা,আনোয়ারা, সালেহ আহমেদ, মুক্তি, মেহের আফরোজ শাওন, জাহিদ হাসান,মাহফুজ আহমেদ অভিনয় করেছেন। এটি ছয়খানা জাতীয় পুরস্কার জয়ের পাশাপাশি আটটি বাচসাস পুরস্কারও পায়।
শ্যামল ছায়া (২০০৫)
কলমের খোঁচায় যেমন পারঙ্গম ছিলেম হুমায়ূন আহমেদ, তেমনি সেলুলয়েডের ফিতেতেও ছিলেন সাবলীল। এরই প্রমাণ মেলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেক চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’র মাধ্যমে । ২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বিজয় দিবসে মুক্তি পায় ছবিটি।
মুক্তিযুদ্ধের তুমুল সময়ে একদল বাঙালি একটি নৌকাকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকার প্রয়াসই এই ছবির মূল চরিত্র। শ্রেষ্ঠাংশে আছেন হুমায়ূন ফরিদী, আহমেদ রুবেল, মনির খান শিমুল, চ্যালেঞ্জার, রিয়াজ, মেহের আফরোজ শাওন, তানিয়া আহমেদ, স্বাধীন খসরুসহ আরও অনেকে।
ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২)
হুমায়ূন আহমেদের পরিচালক জীবনের সর্বশেষ কাজ এটি।
‘প্রায় দেড়শ বছর আগে হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামের এক বৈষ্ণব আখড়ায় ঘাটুগান নামে নতুন সংগীত ধারা সৃষ্টি হয়েছিল। মেয়ের পোশাক পরে কিছু রূপবান কিশোর নাচ–গান করত। এদের নাম ঘেটু। গান হতো প্রচলিত সুরে, যেখানে উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রভাব ছিল স্পষ্ট। অতি জনপ্রিয় এ সংগীতধারায় নারীবেশী কিশোরদের উপস্থিতির কারণেই এই মধ্যে অশ্লীলতা ঢুকে পড়ে। বিত্তবানেরা এসব কিশোরকে যৌনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য লালায়িত হতে শুরু করেন। একসময় সামাজিকভাবে বিষয়টি স্বীকৃতি পায়।‘
প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট প্লটে এর ইতিহাস সম্পর্কে লেখেন পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর শেষ ছবির কাহিনীও আবর্তিত হয়েছে সোলায়মান ওরফে কমলা নামের এক কিশোর ঘেটুকে নিয়ে। ঘেটু সংস্কৃতির অন্ধকারতম দিকের এক সফল চিত্রায়ন ঘটেছে এই ছবিতে।
ছবিটি জাতীয় পুরস্কার, মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি দর্শক– সমালোচকের কাছেও পায় অকুণ্ঠ প্রশংসা। এতে কমলার চরিত্রে অভিনয় করেন আব্দুল্লাহ রানা, এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে আছেন– জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, তারিক আনাম, তমালিকা কর্মকার, মুনমুন আহমেদ, আগুন, শামীমা নাজনীন, প্রাণ রায়।
চন্দ্রকথা (২০০৩)
হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ গল্প ও উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে মানবমনের জটিল ব্যাপারগুলোর সহজ প্রকাশের মাধ্যমে। এর ব্যত্যয় ঘটেনি ‘চন্দ্রকথা’র বেলায়ও। ভগ্নপ্রায় ক্ষমতার অধিকারী জমিদার সরকারের দুঃশাসন এবং জহির–চন্দ্রের প্রেমের করুণ পরিণতি মিলেমিশে একাকার হয়েছে এই ছবিতে। এতে অভিনয় করেছেন শাওন, ফেরদৌস, আহমেদ রুবেল, আসাদুজ্জামান নূর, চম্পা, স্বাধীন খসরু, মুনিরা মিঠু প্রমুখ। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য শাওন এবং আহমেদ রুবেল সেবছর ‘মেরিল–প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কার’ লাভ করেন।
এগুলোর বাইরেও ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘দুই দুয়ারী’,’ আমার আছে জল’ নির্মাণ করেন তিনি। তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস নিয়েও কম ছবি তৈরি হয়নি। ‘দূরত্ব’, ‘নিরন্তর, ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘নন্দিত নরকে’, ‘দেবী’,’দারুচিনি দ্বীপ’ ইত্যাদি নির্মাণ করেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন এর কলাকুশলীরা।
অল্প সময়কালে অল্প কিছু ছবি উপহার দিয়েছেন হুমায়ূন। কিন্তু প্রতিটি গল্পের প্রকাশভঙ্গী ও মমত্ব কঠিন দর্শনকেও সর্বস্তরের জনতার কাছে করেছে সহজবোধ্য। তাই হয়তো বিদায়ের সাত বছর পরেও আমাদের জীবনে, রচনায় তাঁর প্রভাব এত গাঢ়, এত প্রেমময়।
লেখক- সারাহ তামান্না
আরও পড়ুন- গল্পগুলো হুমায়ূনের