চাঁদের বুকে কী রহস্য লুকিয়ে আছে তা নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। চাঁদকে জানার এই কৌতুহল থেকেই একটি সময়ে কয়েকটি দেশ চাঁদের বুকে মানুষ পাঠানোর চেষ্টা করে। এই চেষ্টা সফলতাও পায়। যুক্তরাষ্ট্রের নীল আর্মস্ট্রং সর্বপ্রথম চন্দ্রপৃষ্ঠে পা রাখেন। এরপর তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মানুষবিহীন চন্দ্রযান চাঁদের বুকে পাঠানোর জন্য নিরলস প্রচেষ্টা, গবেষণা ও বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে।
ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীন সফলতার সাথে চন্দ্রে অভিযান পরিচালনায় সক্ষম হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতও চন্দ্র অভিযানে সফল হওয়ার দিকে হাঁটতে থাকে এবং চন্দ্রযান-২ সফলভাবে উৎক্ষেপণে সক্ষম হয়, কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবে যায় ভারতের। শেষ মুহূর্তে চাঁদে অবতরণ করতে ব্যর্থ হয় চন্দ্রযান-২।
২০০৮ সালে ভারত প্রথম চন্দ্রযান-১ পাঠায় চাঁদের বুকে, কিন্তু এটি চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেনি। রাডারের সাহায্যে চাঁদে পানির অনুসন্ধান চালিয়েছিল চন্দ্রযান-১। তারপর ভারত চাঁদে খনিজ সম্পদ, মাটি এবং বিভিন্ন ছবি পাওয়ার উদ্দেশ্যে চন্দ্রযান–২ এর কার্যক্রম হাতে নেয়। ২০১৯ সালের ১৫ই জুলাই চন্দ্রযান-২ উৎক্ষেপণের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের ঠিক ৫৬ মিনিট আগে চন্দ্রযান-২ এর উৎক্ষেপণ স্থগিত করে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা(ইসরো)।
তারপর সেই যান্ত্রিক ত্রুটি কাটিয়ে ২২ই জুলাই সোমবার অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা মহাকাশ স্টেশন থেকে স্থানীয় সময় বেলা ২টা ৪৩ মিনিটে চন্দ্রযান-২ সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। চন্দ্রযান–২ যে রকেট থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় তার ওজন ছিল প্রায় ৬৪০ টন। এ রকেটটি খুবই অল্প সময়ের মধ্যেই চন্দ্রযান–২–কে পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপন করতেও সক্ষম হয়।
প্রায় এক হাজার কোটি রুপি বাজেটের চন্দ্রযান–২–তে ছিল তিনটি পৃথক অংশ; যেগুলো হলো– অরবিটার, ল্যান্ডার ও রোভার। এই তিনটি অংশের কার্যক্রমও ভিন্ন ভিন্ন। ল্যান্ডারের নাম হলো “বিক্রম“; যা চাঁদে মাটির খোঁজ করবে। চন্দ্রপৃষ্ঠে ছবি তোলার কাজে নিয়োজিত থাকবে অরবিটার। আর বিশ্লেষণের জন্য চাঁদের ছবি ও তথ্য পাঠানোর কাজ পরিচালনা করবে “প্রজ্ঞান“ নামে রোভারটি। এই পুরো কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা(ISRO)।
উৎক্ষেপণের পরে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ৭ই সেপ্টেম্বর রাত ১টা ৫৩মিনিটে চন্দ্রযান-২ চাঁদের মাটিতে পা রাখবে। এছাড়া আরও বলা হয় যে, চন্দ্রযান–২ চন্দ্রপৃষ্ঠের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে। ইতিপূর্বে যে তিনটি দেশ চাঁদে অভিযান পরিচালনা করেছে তাদের চন্দ্রযান চন্দ্রপৃষ্ঠের উত্তর মেরুতে অবতরণ করেছিল।
ল্যান্ডার বিক্রম চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করার মুহূর্ত উদযাপনের জন্য ভারতের সমস্ত জনগণ যখন উন্মুখ হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে; ঠিক শেষ সময়ে এসে সকল জল্পনা কল্পনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে চন্দ্রযান–২ ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। শীর্ষস্থানীয় সংবাদ সংস্থাগুলোর তথ্য থেকে জানা যায়, বিক্রম চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের ২.১ কিলোমিটার আগে পর্যন্ত যোগাযোগ স্বাভাবিকই ছিল কিন্তু তারপরেই ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সঙ্গে চন্দ্রযান–২ এর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। চন্দ্রযানটি এমনভাবে প্রোগ্রাম করা ছিল, যাতে ল্যান্ডার বিক্রমের অনুভূমিক গতিবেগ অবতরণের সময় শূন্যে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। আর সে লক্ষ্যেই গতিবেগ কমিয়ে আনার কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয়। এইজন্য অবতরণের হার্ড-ব্রেকিং করা হয় ও এটি সফলও হয়। কিন্তু যখনই ফাইন ব্রেকিং পর্ব শুরু হয়, তার অল্পক্ষণের মধ্যেই দেখা দেয় বিপর্যয়, মুহূর্তেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ইসরোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে।
ভারতের চন্দ্রযান–২ যদি দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করতো, তাহলে ভারত হতো চন্দ্রপৃষ্ঠের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান প্রেরণকারী প্রথম দেশ এবং চাঁদে সফলভাবে অভিযান পরিচালনাকারী চতুর্থ দেশ।