ক্রিপ্টো-মুদ্রা এবং বিটকয়েন এর ভবিষ্যত1 min read
Reading Time: 7 minutesবিটকয়েনেকে কেউ যদি ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ ‘স্টক’ বা ‘শেয়ার’ বলে মনে করেন, যা আজকে আমির কালকে ফকির বানিয়ে দিতে পারে, যার মধ্যে প্রায় পুরোটাই কারসাজি এবং জালিয়াতি, তাহলে তাকে মোটেও দোষ দেওয়া যায় না। যেহেতু সেই রকম ঘটনাই ঘটছে, আবার সে খবরটাই নিয়ত পাওয়া যাচ্ছে এবং লোক মুখে ছড়াচ্ছে। ঝুঁকির ব্যাপারটা ভুলও নয়, আমীর /ফকিরের পাল্টাপাল্টি হওয়ার অনুমানটাও সঠিক। সেটা যারা বিট কয়েনের পক্ষের লোক, তারাও বলছেন। কিন্তু এসব কোনোটাই ‘বিটকয়েন’ নয়, এটা হলো বিট কয়েন নিয়ে যা চলছে। বিট কয়েন একটি অন্যতম আবিষ্কার, ‘ব্লক চেইন’ প্রযুক্তি, তার উপরে ভিত্তি করে তৈরী সর্বপ্রথম ‘ক্রিপ্টো–মুদ্রা’ (cryptocurrency)। বিটকয়েন একটি নিরাপদ সফটওয়্যার। বিশেষজ্ঞরা একমত, বিট কয়েনের মূলে যে ‘ব্লক চেইন’ প্রযুক্তি, তা যুগান্তকারী, অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। ব্যাংক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, তাদেরও ‘ব্লক চেইন’ প্রযুক্তি ব্যাবহার করা উচিৎ।
সম্প্রতি হঠাৎ তার অবিশ্বাস্য মূল্য বিস্ফোরণে সবার টনক নড়েছে। কেউ আর একে হেলাফেলা করতে পারছে না। শিকাগো এক্সচেঞ্জে বিট কয়েনের ফিউচার বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ম্যারিল লিঞ্চ, ব্যাংক অফ আমেরিকা সহ অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান বলছে এটা ‘বুদবুদ’ নয়। এই মূল্য বৃদ্ধির পিছনে কারণ রয়েছে। কারণ অবশ্যই রয়েছে, কারণ অনেক গভীরও বটে। যতটা না অর্থনৈতিক, তার সমান বা বেশি প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক। সমাজ এবং অর্থনীতিকে পাল্টে দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে এই ‘ক্রিপ্টো মুদ্রা’। ইতিমধ্যেই ‘ব্লক–চেইন’ নতুন একটা সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা অবদান রাখতে পারে সে নিয়ে জোর গবেষণা এবং সরব আলোচনা চলছে।
ক্রিপ্টো–মুদ্রা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিলো। ‘সঙ্কেত রীতি বিদ্যা’ (ক্রিপ্টোগ্রাফি) থেকে যে এমন একটি মুদ্রা আবিষ্কার করা সম্ভব, সেটা গবেষকরা জেনেছেন আশির দশকে। কিন্তু কয়েকটি সমস্যা তারা সমাধান করতে ব্যর্থ হন। দু‘হাজার আট সালে একজন অজানা গবেষক সুচারুভাবে সে সমস্ত সমস্যার সমাধান দিয়ে একটি গবেষণা–পত্র ইন্টারনেট ফোরামে পাঠান। বিস্ময়কর ভাবে তার সমাধান কাজে লাগে। তার সমাধানের নাম “ব্লক–চেইন” । সেই ব্লক–চেইনের উপরে ভিত্তি করে প্রথম ‘ক্রিপ্টো–মুদ্রা’ উদ্ভাবন হয়, যার নাম বিটকয়েন। এর গগনচুম্বী দামের কারণে, এবং শনৈ শনৈ ঊর্ধগতির কারণে, একে বর্তমান সময় বেশিরভাগ মানুষ মুদ্রা না ভেবে সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করছে।
তারপর আরো অনেক ক্রিপ্টো–মুদ্রার উদ্ভাবন হয়েছে, যেমন ইথারিয়াম, রিপল, লাইট কয়েন ইত্যাদি। কিন্তু বিটকয়েন সর্ব প্রথম ক্রিপ্টো মুদ্রা হওয়ার কারণে, এবং অনেক গবেষক, বিনিয়োগকারীর মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হওয়ার কারণে অন্যদের থেকে এগিয়ে আছে। তবে অন্য আরেকটি ক্রিপ্টো–মুদ্রা হঠাৎ তরতর করে এগিয়ে বিটকয়েনকে সম্পূর্ণ দেউলিয়া করে দিতে পারে, সেটাই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বড় ঝুঁকির বিষয়। কোনটা এগিয়ে যাবে তাও কেউ বলতে পারে না। এখন আবার বাজারে প্রায় কয়েক শ‘ ক্রিপ্টো–মুদ্রা আছে, এবং অবশ্যই আরও অনেক নতুন মুদ্রার আমদানি হবে। কাজেই বিনিয়োগের ব্যাপারটায় নিঃসন্দেহ হওয়া সহজ নয়। অনেকেই প্রশ্ন করেন, এই মুদ্রা দেখতে কেমন? এই মুদ্রার বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা কম্পিউটারের একটা সফটওয়্যার। অনেক ছবিতে যে স্বর্ণ মুদ্রায় বড় করে ইংরেজি ‘বি’ অক্ষরটি লেখা থাকতে দেখা যায়, সেটা কাল্পনিক। এমনকি সেরকম স্যুভেনিউরও পাওয়া যায়। সেটা বিট কয়েন নয়।
বিট কয়েন বা ক্রিপ্টো মুদ্রার প্রয়োজন কি?
সমাজ এবং জীবন যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে তেমনি অর্থনৈতিক ইনস্ট্রুমেন্ট গুলোর অগ্রগতি ঘটছে। মুদ্রা জিনিসটার অনেক বিবর্তন ঘটেছে। ধাতব মুদ্রা থেকে সেটা কাগুজে মুদ্রায় পরিণত হয়েছে। এর নকল ঠেকানোর জন্যে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। তারপর এলো ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড। তা দিয়ে অর্থনৈতিক বিনিময় আরো ও সহজ হয়ে গেলো। এগুলোকে “ডিজিটাল কারেন্সি” বলা যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে অভাবনীয় অগ্রগতিটি করেছে “ক্রিপ্টো মুদ্রা“। এর কয়েকটি চরিত্র তুলে ধরা যাক।
১. এর কোনো সরকার বা প্রতিষ্ঠান নেই। পৃথিবীময় বিপুল জনগোষ্ঠী একধরনের অতি–নিরাপদ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই মুদ্রার প্রচলন করছে। কেউ নীতিনির্ধারক নয়, সবাই সমান, নেটওয়ার্কের একটি নোড মাত্র। ক্রেতা থেকে বিক্রেতার কাছে সরাসরি, কারো মধ্যস্ততা ছাড়াই, নিরাপদ এবং নিশ্চিত ভাবে এই মুদ্রা চলে যাবে। এই মুদ্রারব্যবস্থার কোনো কেন্দ্রীয় রূপ নেই, এখানে সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। এটাকে সরাসরি “ক্রেতা–বিক্রেতা“র (পিয়ার–টু–পিয়ার) একটা নেটওয়ার্ক বলে।
২. তার ফলে এক মুহূর্তে যে কেউ ঘানা থেকে চায়নায় মুদ্রা পাঠিয়ে কোনো কিছু কিনতে সক্ষম হবে। কোনো ব্যাংকের ব্যাপার নেই, কোনো এক্সচেঞ্জ রেটের ব্যাপার নেই। মধ্যবর্তী কোনো সংস্থাই নেই, সেটাই এই মুদ্রার ডিজাইন।
৩. এই মুদ্রা ত্বরিত গতিতে এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতে পারে। বিট কয়েনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দশ মিনিট লাগছে। কিন্তু অন্য কিছু ‘ক্রিপ্টো মুদ্রা’ আরো কম সময়ে হাত বদল হতে পারে। অথচ বর্তমান ওয়্যার ট্রান্সফারেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে লেগে যায় কয়েকদিন।
৪. এই মুদ্রা এক জনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে পাঠাতে যে ফী লাগে, সেটা নাম মাত্র। এটা আবার পাঠানো অর্থের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল নয়। একটি বিট কয়েন পাঠাতে যা ফী, এক লক্ষ বিট কয়েন পাঠাতে সেই ফী। বর্তমান মানি ট্রান্সফারের ফী এর সঙ্গে তুলনা করলে, এখানেও “ক্রিপ্টো মুদ্রা” সুবিধার দিক থেকে অনেক এগিয়ে থাকে।
৫. ’ক্রিপ্টো–মুদ্রার’ লেন–দেন জাল করা যায় না। একবার ট্রান্সফার হয়ে গেলে ওটাকে কোনো ভাবে ফিরিয়ে নিতে, বা পরিবর্তন করতে পারা যাবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, হাজার হাজার মেশিনে এটা লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই লেন–দেন অপরিবর্তনীয়।
৬. ’ক্রিপ্টো মুদ্রার’ কোনো মুদ্রাস্ফীতি নেই । এই মুদ্রার সংখ্যা পূর্ব নির্ধারিত, তাই টাকার মতো তা আরো ছাপানো যায় না। বিভিন্ন দেশ যেমন প্রকাশ্যে বা গোপনে তাদের মুদ্রা বেশি ছাপিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, এবং যার ফলে ‘মুদ্রা যুদ্ধ’ (কারেন্সি ওয়ার) শুরু হয়ে যাচ্ছে, সেটা ‘ক্রিপ্টো মুদ্রায়’ একেবারেই অসম্ভব। যেমন বিটকয়েনের সর্বোচ্চ সংখ্যায় ২.১ কোটিতে নির্ধারিত করা আছে।
এর এতো মূল্য কেন?
এর মূল্য বাড়ার কারণ গুলো নিম্নরূপ–
১. মনে করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী জুড়ে সবাই ‘ক্রিপ্টো–মুদ্রা’ ব্যাবহার করবে। এটাকে এভাবে বোঝানো যায়, কেউ যদি বিশ বছর আগে বলতো পৃথিবী জুড়ে সবাই মোবাইল ফোন ব্যবহার করবে, সেটা হয়তো তখন খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না। এখানেও ঠিক তেমনটি ঘটছে বলে অনেকেই জোরালো ভাবে মনে করছেন।
২. বিট কয়েনের সংখ্যা সীমিত। তাই একটি বিটকয়েনের দাম অনেক অনেক বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ওই সীমিত বিটকয়েন দিয়ে কিনতে হবে, তাই একেকটির দাম হবে গগনচুম্বী।
বিট কয়েন দিয়ে কি কিছু কেনা যায়?
বিটকয়েন দিয়ে বর্তমানে অনেক কিছুই কেনা যায়। যেমন ওভারস্টক.কম থেকে যে কোন দ্রব্য বিটকয়েনের মাধ্যমে কেনা যাবে। এমন আরো অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বিটকয়েনকে মুদ্রা হিসবে গ্রহণ করে তাদের পণ্য বিক্রি করছে। ধারণা করা হচ্ছে, এখন যেমন টাকার বদলে ক্রেডিট কার্ড ব্যাবহার হচ্ছে, ভবিষ্যতে তেমনি টাকা এবং ক্রেডিট কার্ডের বদলে বিটকয়েন বা অন্য কোনো ‘সাঙ্কেতিক মুদ্রা’ ব্যাবহার হবে।
এর দাম এতো অস্থিতিশীল কেন?
উপর্যুক্ত সকল সম্ভাবনার জন্যে এর দাম বাড়ে। আবার হঠাৎ কোনো জালিয়াতি হলে বা ধরা পড়লে এর দাম কমে। আবার কোন দেশ আগে অবৈধ ঘোষণা করলে, অথবা কোনো দেশ এই মুদ্রার পক্ষে অবস্থান নিলে এর দাম মুহূর্তেই অনেক কমে বা বেড়ে যায়। দাম বাড়া–কমা অনেকটাই মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। তারপর আছে অন্যান্য ‘সাঙ্কেতিক মুদ্রা’র অবস্থান। যদি মনে করা হয় ইথারিয়াম অথবা রিপল প্রকৃতপক্ষে ভবিষ্যতের মুদ্রা, তাহলে ওগুলোর দাম বাড়বে এবং বিটকয়েনের দাম কমবে। এসব নানান কারণে এর দাম হঠাৎ কমে আবার হঠাৎ বাড়ে। এর মধ্যে হয়তো মুনাফালোভী বড় বড় কুমীর–রুপী বিনিয়োগকারীরা আছে, যারা হঠাৎ অনেক বিনিয়োগ করে মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে, আবার হঠাৎ সব টাকা তুলে নিয়ে মূল্য ধরাশায়ী করে ফেলতে পারে। সব মিলিয়ে এর দাম আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে বা কমতে পারে, যার পূর্বাভাস কারো পক্ষেই দেওয়া সম্ভব নয়।
এটা নিয়ে জালিয়াতি কে করছে?
সরাসরি বিটকয়েন বা ক্রিপ্টো–মুদ্রা নিয়ে কেউ জালিয়াতি করছে না। এর ভিত্তি যে ‘ব্লক–চেইন’, সেটা নিরেট এবং সবচেয়ে নিরাপদ বলে বিবেচিত। জালিয়াতি হচ্ছে বিটকয়েন ক্রেতার একাউন্ট নিয়ে। যে মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলি বিটকয়েন কেনা–বেচায় সাহায্য করছে, তাদের মাধ্যমে জালিয়াতি হয়ে থাকে। মানুষ সতর্ক হচ্ছে। আরো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান আসছে। পাসওয়ার্ড এবং পরিচয় পদ্ধতি আরো নিরাপদ হচ্ছে, এবং হতেই হবে। কাজেই, কিছু সংবাদ যে বিটকয়েন বা ক্রিপ্টো মুদ্রাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে বা দেবে তা পুরাপুরি ঠিক নয়। এর ভিত্তি বেশ মজবুত।
বিট কয়েন মাইনিং কি?
বিট কয়েন আহরণ (মাইনিং) অনেকটা খনিজ পদার্থ আহরণের মতোই। সব দিকে মিল আছে, কিন্ত এর কোনো বাস্তব খনি নেই। বাস্তব কোনো খনিজ পদার্থও নেই। তবু এটাকে কম্পিউটার বা তদ্রুপ মেশিন দিয়ে আহরণ করা যায়। মিল গুলো এই জায়গায়, খনিজ পদার্থ আহরণে সময় লাগে, পরিশ্রম লাগে, জ্বালানি লাগে। কখনো অল্প সময়ে বেশি পদাৰ্থ পাওয়া যেতে পারে, কখোনো গলদঘর্ম হয়েও খনি থেকে কিছু পাওয়া গেল না। এটি যত কঠিন এবং দুর্লভ হবে, এবং মানুষের কাছে যত বেশি লোভোনীয় হবে, পদার্থের দাম তত বেশি হবে। যেমন সোনা বা হীরা। এরা দুর্লভ বলে, এবং এদেরকে সবাই চায় বলেই এদের দাম এতো বেশি। বিটকয়েনকে গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে দুর্লভ করা হয়েছে। একে আহরণ করতে অনেক জ্বালানি লাগে, অনেক পরিশ্রম লাগে। তারপরেও হলফ করে বলা যায় না যে একটা বিটকয়েন পাওয়া যাবে। “পরিশ্রম” কথাটা এখানে কম্পিউটারের ‘সি,পি,ইউ’ বা ‘জি,পি,ইউ’ এর ব্যবহারের সঙ্গে মেলানো যায়। জ্বালানিটা মেলানো যায় বিদ্যুৎ খরচের সাথে। বিটকয়েনের এলগোরিদম (‘প্রুফ অফ ওয়ার্ক’) এমন ভাবে করা আছে যে দিনকে দিন এটা ‘আহরণ’ করা কঠিন হবে।
ব্লক চেইন কি?
ব্লক চেইন একটা প্রযুক্তি, যার উপরে ভিত্তি করে মূলতঃ বিটকয়েন এবং অন্যান্য ‘ক্রিপ্টো–মুদ্রা’র আবিষ্কার হয়েছে। প্রতিটি লেনদেন এই ব্লক চেইন এ থাকছে, একে বলে পাবলিক লেজার, বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘উন্মুক্ত খতিয়ান‘। এটি সবার জন্যে উন্মুক্ত। একটি লেনদেন পাকা হয়ে উন্মুক্ত খতিয়ানে যেতে হলে এই ব্লক–চেইন নেটওয়ার্কের সিংহভাগ নোডকে (কম্পিউটার বা বিশেষ ধরণের কম্পিউটার জাতীয় মেশিন) সহমত হতে হবে। এই সহমত হওয়ার একটা এলগোরিদমও (কনসেনসাস এলগোরিদম) রয়েছে।
পরিশেষে জটিল একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয়, যাকে বলে ‘প্রুফ অফ ওয়ার্ক‘। যারা এটা করে তাদেরকে বলে ‘মাইনার‘। প্রথম যে সমাধান করতে পারবে সে বিজয়ী, সে পুরস্কার হিসাবে বিটকয়েন পাবে। আগে এটা ছিল ২৫ টি বিটকয়েন, এখন ১২.৫ টি বিটকয়েন। কিছুদিন পর পর এটা অর্ধেক হয়ে যাবে, সেটাও ব্লক–চেইন প্রযুক্তির একটা প্রটোকল। মাইনাররা আবার সহমত হতে ভোট দিচ্ছে। অসংখ্য ‘মাইনার’ কাজ করে যাচ্ছে। একারণেই ‘ক্রিপ্টো–মুদ্রার’ লেনদেন জালিয়াতি বা ভুল হতে পারে না। পৃথিবীর যে কেউ বিশেষ শক্তি সম্পন্ন নির্ভরযোগ্য কম্পিটার বা মেশিন কিনে এই নেটওয়ার্কে যোগ দিয়ে মাইনার হতে পারে, এমন কি কিছু টাকা পয়সাও উপার্জন করতে পারে। এই ব্লক–চেইন প্রযুক্তির সম্ভাবনা অপিরিসীম। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, বাড়িঘর এবং জমির মালিকানায় যদি ব্লক–চেইন প্রযুক্তি ব্যাবহার করা হয়, তাহলে মালিকানা বা দলিল জাল করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এটা ‘উন্মুক্ত খতিয়ানে’ থাকার কারণে সবাই জানবে কে কোন জায়গার মালিক।.
ক্রিপ্টো–মুদ্রার অভিশাপ
সব যুগান্তকারী আবিষ্কারেরই কিছু অভিশাপ থাকে। ক্রিপ্টো মুদ্রাতেও তা আছে। এখানে যদিও প্রতিটি লেন–দেন ব্লক–চেইনে লিপিবদ্ধ থাকছে, কিন্তু সেখানে মানুষ বা প্রতিষ্ঠানটির নাম–ঠিকানা থাকছে না। শুধুমাত্র একটি সাংকেতিক চাবি (পাবলিক কী) থাকছে, যেটা থেকে কোনোভাবেই সেই মানুষ বা প্রতিষ্ঠানটিকে বের করা সম্ভব নয়। ব্যাপারটা এরকম, একেকজনের পরিচয় একেকটা নাম্বার দিয়ে, কাজেই ১১১ নাম্বারের ওয়ালেটে (ক্রিপ্টো–মুদ্রার একাউন্টকে ওয়ালেট বলা হয়) কোত্থেকে বিট কয়েন এসেছে, সে কোথায় পাঠিয়েছে, সব দেখা যাবে। এটা উন্মুক্ত খতিয়ানে থাকছে , কাজেই যে কেউ দেখতে পাবে, কিন্তু এই ১১১ নাম্বারের পিছনে মানুষটা কে, তা কেউ জানতে পারবে না। তাহলে অপরাধীদের জন্যে বিরাট সুবিধা। তারা পর্দার অন্তরালে থেকে অর্থ লেন–দেন করতে পারবে। তারপর সন্ত্রাসী সংগঠনকে কেউ যদি অর্থ পাঠায় সেটাও ধরার কোনো উপায় থাকছে না। তবে ব্লক–চেইন এর নতুন প্রটোকল প্রনয়ন করা সম্ভব যেখানে পাবলিক কী ছাড়াও পরিচয়টাও জানা যাবে।
সরকার এবং বিটকয়েন
বিটকয়েনকে মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার করা, বা এটিকে অন্যকোনো ভাবে কেনা বা বিক্রয় করাকে বিশ্বের সাতটি দেশ বেআইনি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি দেশ। অন্য দেশ গুলো হচ্ছে, নেপাল, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া এবং কিরঘিস্তান। উবার, লিফ্ট, এবং অন্যান্য নতুন উদ্ভাবনের মতোই এটিও নিয়ম নীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সরকারকে মুশকিলে ফেলে দিয়েছে। তবে এর আয়কর–কাঠামো, উত্তরাধিকার, ইত্যাদি নানান বিষয়ে নীতি প্রণয়নের কাজ জোরেশোরেই চলছে।
কিন্তু সরকারের উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা সত্ত্বেও গণ মানুষের এই নতুন প্রযুক্তিতে উৎসাহের কোনো কমতি নেই। পৃথিবীর দেশে দেশে, বিশেষতঃ আমেরিকা, চায়না, কেনাডা, অস্ট্রেলিয়া, নাইজেরিয়া, ব্রাজিল, ইসরায়েল, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরে বিপুল উৎসাহে মাইনাররা বিটকয়েন নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছে, ব্লক–চেইন প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে নতুন নতুন সম্ভাবনাময় কোম্পানি সেসব দেশে সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাপারটা যেন নজরুলের সেই কবিতার লাইন, “কে রুধিবি এই জোয়ারের জল, গগনে যখন উঠছে চাঁদ“।
এর ভবিষ্যত কী?
মনে করা হচ্ছে ‘ক্রিপ্টো মুদ্রা’ই ভবিষ্যতের মুদ্রা। এর মূলে যে ব্লক–চেইন তা নিয়ে ইতিমধ্যেই তথ্য ও প্রযুক্তির বিশেষজ্ঞরা কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ইন্টারনেট যেভাবে দুনিয়া পাল্টে দিলো, মোবাইল ফোন যেভাবে ঘরে ঘরে, গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে, এটাও তেমনি ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু কোন মুদ্রাটা? বিটকোয়েন? রিপল? লাইটকয়েন? ইথারিয়াম? নাকি ‘মফিজ কয়েন‘? বলা মুশকিল। কেউ জানে না। কিন্তু একটা না একটা ক্রিপ্টো–মুদ্রা আসন গেড়ে বসবে। ডলার ধীরে ধীরে উঠেই যাবে, ইউরো উঠে যাবে, টাকাও একদিন উঠে যাবে। ব্যাঙ্কে মানুষ যাবে না, সবার ‘ক্রিপ্টো মুদ্রা’র ওয়ালেট থাকবে, কম্পিউটারে বা মোবাইলে। অনেকে বলছেন, এই একাউন্টটাকে শুধু ব্যাঙ্ক একাউন্টের সাথে তুলনা করলেই হবে না। এর একেকটা নিজেই একটা ব্যাংক। যেই ব্যাঙ্কের নিয়ম কানুন, ফী, সব ওই মানুষটিই নির্ধারণ করবে। আর এই মুদ্রার তো দেশের গণ্ডী থাকছেই না। তাই দুনিয়াটা নতুন রূপ ধারণ করবে।
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার জন্য এই লেখাটি লিখেছিলেন মোস্তফা তানিম।
বিটকয়েন এবং ক্রিপ্টোমুদ্রা নিয়ে লেখালেখি করা মোস্তফা তানিমের সাথে বাংলা ইনফোটিউবের কথোপকথন-
https://www.youtube.com/watch?v=Ymuwg1l-NDs&t=193s