ক্রাইস্টচার্চ হামলার বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেল। ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে বন্দুকধারীর হামলার পঞ্চাশজন মুসলমান নিহত হয়েছিলেন। এমন অতর্কিত পাশবিক হামলায় শুধু নিউজিল্যান্ডই নয় বরং পুরো বিশ্ববাসী হয়ে গিয়েছিল নির্বাক! এমনকি শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী এই হামলা ফেসবুকে লাইভ অর্থাৎ সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। শ্বেতাঙ্গদের করা এই হামলাকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী হামলা হিসেবে গণনা করা হবে কি না তা জানার জন্য পুরো বিশ্ববাসী উদগ্রীব হয়ে ছিল।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আহডার্ন এই হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিবৃতিতে এই হামলাকে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি হামলা বলে আখ্যায়িত করেন। শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা হওয়া এই হামলাকে জঙ্গি হামলা বলে আখ্যায়িত করায় পুরো বিশ্ববাসী এই প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসার হয়ে উঠে পঞ্চমুখ।
এই প্রশংসা এখানেই থেমে থাকেনি, তিনি যখন মাথায় কালো স্কার্ফ পরিধান করে স্বজন হারা পরিবারদের জড়িয়ে ধরে তাদের সাথে একাত্ম হয়ে শোক প্রকাশ করছিলেন তখন বিশ্ববাসী একমত হয়েছিল যে এই ঘটনা আসলেই প্রশংসার দাবি রাখে। অপরদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদকে বিশ্ব শান্তির ব্যাপারে হুমকি হিসেবে না মানলেও নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এটাকে বৈশ্বিক হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন।
ক্রাইস্টচার্চ হামলা পরবর্তী পদক্ষেপ
অতীতেও মানবিক কাজগুলোতে কখনই পিছপা না হওয়া এই প্রধানমন্ত্রীকে আবারো চিনে নিলো বিশ্ব। শ্বেতাঙ্গ হামলাকারীকে তিনি সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করেন সাথে সাথেই। এছাড়াও তিনি নিউজিল্যান্ডের অস্ত্র আইন পরিবর্তন করার ব্যাপারে ঘোষণা দেন ও দ্রুত এই আইন কার্যকর করার ব্যাপারে কথা দেন।
বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে তিনি আরো ঘোষণা দেন শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের রেডিও এবং টেলিভিশনে আজান দেয়া হবে। স্বজন হারাদের যখন তিনি সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তখন বিশ্ববাসী আবারো অবাক হয়েছিল তার হিজাব পরিধান করা দেখে। এভাবেই তিনি মুসলমানদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা দিয়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। বিশ্ব ইতিহাসে কোন শ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নজিরবিহীন উদাহরণ স্থাপন করলেন।
এই হামলার পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আহডার্ন যখন সংসদে বক্তব্য দেন তখন তিনি প্রথমেই সবাইকে সালাম দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন।
তাঁর সম্পর্কে ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান ছুঁড়ে দিয়েছে অজস্র প্রশংসা। গার্ডিয়ানে লেখা হয়, “সত্যিকারের নেতারা ঐক্য না খুঁজে বরং ঐক্য তৈরি করেন। আহডার্ন এই ঐক্য তৈরি করে বিশ্ববাসীর জন্য উদাহরণস্বরূপ নেতৃত্ব তৈরি করেছেন”।
এবিসি অস্ট্রেলিয়ায় লেখা হয়েছে, “আজ অবধি কোন প্রকার ভুল সিদ্ধান্ত নেননি নেত্রী আহডার্ন”।
পরবর্তীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন নিউজিল্যান্ডকে কোন প্রকার সহায়তা করতে পারবেন কি না সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন তখন আহডার্ন বলেন, “সকল মুসলিমদের জন্য আপনি সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করুন”। তাঁর এই বক্তব্যে মুসলমানরা সহ পুরো বিশ্ববাসী প্রশংসা করে।
মুসলমানদের সাথে জাসিন্ডার একাত্মতা প্রকাশ
আহডার্নের মন্ত্রী পরিষদ এবং নিরাপত্তা কর্মীরা সবাই কালো পোশাক পরিধান করে মুসলমানদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এমনকি নিউজিল্যান্ডের এই প্রধানমন্ত্রী কালো হিজাব পরিধান করে শোক প্রকাশের সাথে সাথে মুসলমানদের সম্মান করেছিলেন।
সেই মসজিদের ইমাম মুসলমানদের জন্য আহডার্নের সম্মান, ভালোবাসা এবং একাত্মতার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, সাধারণ অনেক মানুষ আছে যারা ইসলাম ও মুসলমানদের ভয় পায়। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়ানো বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নজীর সৃষ্টি করল।
কালো হিজাব পরিধান করা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আহডার্ন বলেন, “আমরা সবাই কালো হিজাব পরেছি স্বজন হারাদের জন্য ভালোবাসা এবং একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য। তারা সবাই আমাদেরই একটা অংশ।” প্রধানমন্ত্রীর এমন পদক্ষেপে উৎসাহী হয়ে এই সময়ে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড, উইলিংটনসহ আরো অনেক মসজিদে নিহতের জন্য দোয়া করার সমাবেশে অংশ গ্রহণ করে সাধারণ নিউজিল্যান্ড অধিবাসী। এই সময়ে তারা অনেকেই হিজাব পরিধান করে এসেছিলেন।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এই হামলার পরবর্তীতে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ সহ হ্যাগলি পার্কে আল নূর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতার মাধ্যমে নিহতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী অরডার্ন নিহতদের শেষকৃত্যর ভার নিয়ে নেন এবং সবার বাড়িতে গিয়ে পর্যন্ত সহমর্মিতা ও ভালোবাসা জানান। মৃত মুসলমানদের সম্মানার্থে তিনি হিজাব পরিধান করেন।
এটাই প্রথম নয় এর আগেও তিনি মুসলমানদের সাথে একাত্মতা দেখিয়ে গাজায় ফিলিস্তিনদের মৃত্যুর বিপক্ষে সরব হয়েছিলেন এবং চীনে ইউঘুর মুসলামানদের উপর করা অত্যাচারের বিরুদ্ধেও নিনা জ্ঞাপন করেছিলেন তিনি। কোন শ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী হয়ে এভাবে মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়ানোটা নজিরবিহীন। এমন সাহসী পদক্ষেপ বিশ্ব রাজনীতি এবং মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ব্যাপারে উদাহরণ হিসেবে জ্বলজ্বল করবে সর্বদা।
যেভাবে বেড়ে উঠেছিলেন এই নেত্রী
নিউজিল্যান্ডের মুরুপারা নামক খুব সাধারণ এবং ছোট একটি শহরে ১৯৮০ সালে জন্ম নেন জেসিন্ডা আহডার্ন। সেই শহরের মানুষগুলো খুবই খাদ্য ও বস্ত্র বিষয়ক নিদারুণ দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে সময় পার করছিল। এগুলো থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে, তা ভাবতে ভাবতেই রাজনীতিতে প্রবেশ করার ব্যাপারে উৎসাহী হয়েছিলেন তিনি। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই নিউজিল্যান্ডের লেবার পার্টিতে যোগ দিয়ে তিনি রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েন।
রাজনীতিতে পথচলা
পড়াশোনার স্নাতক অংশ শেষ করেই জাসিন্ডা আহডার্ন লেবার পার্টির একজন সংসদ সদস্যের অধীনে গবেষক হয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি চলে যান ব্রিটেনে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের অফিসে চাকরি করেন। এরপর তিনি সোয়াশালিস্ট ওয়েলথের প্রেসিডেন্ট হয়ে কাজ করেছিলেন আলজেরিয়া, চীন, ভারত, ইসরায়েল, জর্ডান ও নেবাননের মত বেশ কিছু দেশে।
স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে লেবার পার্টির সংসদ হিসেবে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ও হেরে যান। পরবর্তীতে ৩৮ বছর বয়সে তিনি নিজের দলকে বিজয়ী করে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সর্ব কনিষ্ঠ সরকার প্রধান হন এই আহডার্ন।
লেখক- Iqbal Mahmud