ক্রিকেটের সংজ্ঞা বদলে দেয়া ক্যারি প্যাকার 1 min read
Reading Time: 3 minutes“ক্রিকেটের এমন কোনো ইতিহাস লেখা সম্ভব নয় যেখানে ক্যারি প্যাকার নামটি উহ্য থাকবে।”
টনি গ্রেগের এই কথাটি যদি বিশ্লেষণের খাতায় ফেলা হয় তবে অনেক কিছুই বলা যাবে। ওয়ানডে থেকে টি-টুয়েন্টি ঘুরে ফ্র্যাঞ্চাইজি নির্ভর ক্রিকেট। বনেদি ঘরানার টেস্ট থেকে এই অব্দি আসতে দ্য জেন্টেলম্যানস গেম ক্রিকেটকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেকটা পথ। পথটাকে বলা যেতে পারে ‘দূর্গম গিরি কান্তার মরু’ ধরণের। আর সেই পথটা পাড়ি দিতে ক্রিকেট বিশ্বে দরকার ছিল একজন কান্ডারি। সেই কান্ডারির নাম ‘ক্যারি প্যাকার’। প্যাকারের ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ নামের এক বাহনে চড়ে ক্রিকেট অনুপ্রেরণা পেয়েছে আরো অনেকদূর যাবার।
সময়টা ১৯৭৬। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের মিটিংয়ে একজন টিভি চ্যানেলের মালিক বসে আছেন। তার প্রচন্ড জেদ আর অহংকারের কাঁটা বারবার নাড়িয়ে দিচ্ছেন বোর্ড কর্মকর্তারা। এক পর্যায়ে ক্যারি প্যাকার ছুঁড়ে দেন তার ইতিহাসের বাঁক ঘোরানো উক্তিটি, “There is a little bit of the whore in all of us, gentleman. What is your price?”
হ্যাঁ! ক্যারি প্যাকার কিনে নিতে চেয়েছিলেন পুরো অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডকেই। তাও শুধুমাত্র অ্যাশেজ সম্প্রচারের স্বত্ত্ব না পেয়ে।
ক্যারি প্যাকার অবশ্য কথার কথা বলেন নি। আসলেই তার সেই আর্থিক ক্ষমতা ছিল। মৃত্যুর আগে ক্যারি প্যাকারের বাবা সন্তানের জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার রেখে যান। সেই সময়ের হিসেবে এটি সাত রাজার ধন বলা চলে। ক্যারি প্যাকারই প্রথম ব্যক্তি যিনি ক্রিকেট খেলাকে টিভি পর্দায় এনে রোজগারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার বিখ্যাত চ্যানেল নাইন এখন পর্যন্ত বেশ জনপ্রিয় হয়ে আছে ক্রিকেট ভক্তদের কাছে।
ক্যারি ফ্রান্সিস বুলমোর প্যাকার ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৭ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের সিডনিতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা স্যার ফ্রাঙ্ক প্যাকার অস্ট্রেলীয় এক প্রচারমাধ্যমের স্বত্তাধিকারী ছিলেন। চ্যানেল নাইনের মালিকানা ক্যারি পেয়েছিলেন বাবার হাত থেকেই। ১৯৭৬ সালে বোর্ড কিনতে না পেরে ক্যারি ধরছিলেন অন্য এক পথ। যেই পথ বদলে দিয়েছিল অনেক কিছুই।
১৯৭৭ সালেই রীতিমতো বিদ্রোহ করে বসেন প্যাকার। নিজেই চালু করলেন “ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ”। আর তাতে কাজে লাগালেন ব্যবসায়িক নিপুণতা। দিবারাত্রির ম্যাচ কিংবা ওয়ানডে ক্রিকেটে রঙিন জার্সি! কেউ যা আগে কখনোই ভাবেনি তাই করলেন ক্যারি প্যাকার। তবে মানুষকে একটা বার্তা দিতে এরচেয়ে বেশি কিছুও দরকার ছিল। তাই ডাক পড়লো আরেক অজি কিংবদন্তি রিচি বেনোর। পরবর্তীতে যার নাম হয়ে যায়, ‘দ্য ভয়েস অফ ক্রিকেট’। লাল বলের পরিবর্তে আনা হলো সাদা বল। প্রত্যেকেই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হল। সবাই বুঝতে পারল, ক্রিকেট বিশ্বে এবার নতুন কিছু আসতে চলেছে। তবে চমকের বাকি ছিল আরো অনেকটা।
টনি গ্রেগ তখন ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন। দারুণ ছন্দে ছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে একের পর এক।দলকে মাটিতে নামিয়ে আনছে। পাকিস্তান ক্রিকেটে এসেছে দুই সম্ভাবনাময় তরুণ। ইমরান খান এবং জাভেদ মিঁয়াদাদ। নিজ দেশের দুই কিংবদন্তি ইয়ান চ্যাপেল আর গ্রেগ চ্যাপেলকেও নিলেন প্যাকার। সেই সময় একটি টেস্ট খেলার বিনিময়ে টনি গ্রেগদের মাইনে ছিল মোটে ২১০ পাউন্ড। ক্যারি প্যাকার ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজে সবার আগে নিশ্চিত করলেন ক্রিকেটারদের মাইনে নিরাপত্তা। মৃত্যুর ছয়মাস আগে টনি গ্রেগ জানিয়েছিলেন তার লেখা চিঠির কথা। যেখানে ক্যারি প্যাকারকে তিনি লিখেছিলেন,
“ক্যারি, টাকাটা আমার প্রধান চিন্তার বিষয় না। আমার বয়স এখন ৩১ বছর। হয়তো আর দুই তিনটা টেস্টে ব্যর্থ হলেই আমাকে দল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। এর আগেও টনি লুইস, ব্রায়ান ক্লোজ, কলিন কাউড্রে, রে ইলিংওয়ার্থের মতো অধিনায়ককে এইভাবেই বিদায় নিতে হয়েছে। আমার ক্ষেত্রেও হয়তো কোন ব্যতিক্রম হবে না। দল থেকে বাদ পড়ার পর আমি অকুল পাথারে পড়ে যেতে চাই না। আমি অন্য কিছু করার কোন প্রশিক্ষণও কখনো পাইনি। আমি স্কুল থেকে সরাসরি চলে এসেছিলাম সাসেক্সের হয়ে খেলতে। এখন ক্যারিয়ারের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার পরিবারের চিন্তাই আমাকে বেশি ভাবাচ্ছে। আমার পরিবারের ভবিষ্যত্ই আমার কাছে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তুমি যদি আমাকে তোমার প্রতিষ্ঠানে আজীবন কাজ করার সুযোগ দাও তাহলেই আমি এই ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটে খেলার চুক্তি সাক্ষর করব।”
ক্যারি প্যাকার রাজি হয়েছিলেন টনি গ্রেগের প্রস্তাবে। কথা রেখেছিলেন নিজের সবটা দিয়ে। কিন্তু আইসিসির বিরুদ্ধে যাবার কারণে ওয়ার্ল্ড সিরিজে অংশ নেয়া সব ক্রিকেটার নিষেধাজ্ঞার খপ্পরে পড়ে। কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ পড়ে সবাই। তবে একসময় সব বোর্ডের মন গলেছিল। দেশের জার্সিতে ফিরেছিলেন সবাই। এমনকি বর্ণবাদ বিতর্কে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকান খেলোয়াড়রাও ওয়ার্ল্ড সিরিজ খেলেছিলেন। পরে দেশের জার্সিও চাপিয়েছেন। জাভেদ মিঁয়াদাদ আর ইমরান খান তো জিতেছিলেন ১৯৯২ বিশ্বকাপটাও। কেবল টনি গ্রেগরই আর ইংলিশ দলে ফেরা হয়নি। তবে তার জন্য আক্ষেপেও পুড়তে হয়নি তাকে।
ওয়ার্ল্ড সিরিজ শেষে ১৯৭৯ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫ বছর ক্যারি প্যাকারের চ্যানেল নাইনে কন্ঠ দিয়ে গিয়েছিলেন টনি গ্রেগ।
সেদিন তারা বিদ্রোহী ক্রিকেটারই ছিলেন। অর্থের জন্য হোক বা ভবিষ্যত, ক্যারি প্যাকারের ডাকে সাড়া দিয়ে রীতিমত ঝড় এনেছিলেন সবাই। যেই ঝড় ক্রিকেটকে সাহায্য করেছে দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্বের অন্যতম বড় বাণিজ্যিক খেলায় পরিণত করতে। ক্যারি প্যাকার ছাড়া আর কেইবা পারতো এমন করতে!