দশক সেরা দশ কোরিয়ান সিনেমা- পর্ব ২1 min read
Reading Time: 5 minutesউত্তেজনা, আবেগ, কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা- এই তিন শব্দের সাথে ভালোভাবেই অভিজ্ঞ কোরিয়ান সিনেপ্রেমীরা। তবে যাদের কাছে এটি এখনও অচেনা ইন্ডাস্ট্রি তারা নিশ্চিন্তে নেমে পড়তে পারেন বিঞ্জ ওয়াচিংয়ে।
দক্ষিণ কোরিয়ান ম্যাগাজিন Cine 21 জানুয়ারিতে প্রকাশ করে গত দশকের সেরা দশ কোরিয়ান সিনেমার তালিকা। গত পর্বে এর প্রথম পাঁচ নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ সেই লিস্টের অন্তিম পাঁচের কথা চলুন শুনি।
৬। The Yellow Sea(২০১০)
থ্রিলার- অ্যাকশন জনরার সিল বসালে ‘The Yellow Sea’ র মূলভাব প্রকাশ পায় না। এটি যতটা না বিনোদনকেন্দ্রিক তারচেয়েও অনেক বেশি রাজনৈতিক।
কাহিনী সংক্ষেপ: ঘটনার সূত্রপাত চীনের ইয়ানজি শহরের জোসেওনক (Joseonjok- চীনে বসবাসরত কোরিয়ান অধিবাসী) গুন-নামের হাত ধরে। পাওনাদারের তীব্র আনাগোনায় নিয়তই বিরক্ত সে। ওদিকে স্ত্রী চলে গেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়, অতএব সংসারের মাথায়ও ঝুলছে লালবাতি।
গুজব নাকি বাতাসের আগে দৌড়ায়। স্ত্রীর পরকীয়ার গুজবে ক্ষেপে উঠে সে। টাকা জোগাড় করে দ্রুত কোরিয়া যাওয়াই এখন তার একমাত্র লক্ষ্য। স্থানীয় মাফিয়ার জুং-হাকের প্রস্তাব তাই সাদরেই গ্রহণ করে গুন-নাম। এক ব্যবসায়ীকে হত্যার বিনিময়ে রাতারাতি প্রচুর অর্থ চলে আসবে হাতে! কাজে নেমে পড়ে হতশ্রী এই ট্যাক্সি-ড্রাইভার। পরিকল্পনা অনুসারে সপ্তাহের ভেতরই কাজ গুছিয়ে আনে সে।
কিন্তু হত্যাকাণ্ডের রাতেই বাঁধে গণ্ডগোল। পুলিশ, মাফিয়া চক্র আর শ্রমিক পাচারকারী দলের টার্গেটে পরিণত হয় নাম।
কাহিনীর যতটুক বললাম একে স্পয়লার ভাবার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। The Yellow Sea এর প্রচ্ছন্ন বিনোদন এর ধুন্দুমার অ্যাকশন আর ভায়োলেন্সে। যারা গতির সাথে অপরাধ যুগল ভালোবাসেন তাদের জন্য উপাদেয় এই ছবি।
হা জং-উক, কিম ইয়ন সিও অভিনীত ছবিটি মান্দারিন ও কোরিয়ান দুই ভাষায় মুক্তি পায়। এর মোট আয় ছিল ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
৭। House of Hummingbird(২০১৮)
কামিং অফ এজ চলচ্চিত্রের প্রকৃষ্ট ক্লাসিক উদাহরণ হিসেবে বরাবরই তুফোর ‘400 Blows’, পিটার ওয়্যারের ‘The Dead Poets Society’ এর নাম আসে। ২০১৮ সালে এর সাথে যুক্ত হয় ‘House of Hummingbird’ও। হলিউড রিপোর্টার এর মতে, ‘সংবেদনশীল ও স্বতস্ফূর্ত’ ছবিটি লন্ডন, বার্লিন, গ্র্যান্ডবেলসহ বিভিন্ন উৎসবে জয় করে নেয় সমালোচকদের মন।
কাহিনী সংক্ষেপ: চৌদ্দর চৌহদ্দিতে পা পড়তেই ইউন-হি টের পায় তার আশেপাশের মানুষগুলো খুব একটা সহজ নয়। মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভেতরেও কেমন এক দুর্বোধ্য জটিলতা। ভালোবাসার মানুষেরা একেকজন যেন গোলকধাঁধা-কখনো তারা হারায়, কখনো ফিরে আসে, আবার কখনো প্রতীক্ষার যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে ইউনকে।
মানবিক জীবনের জটিলতার ভিড়ে ইউন-হির জন্য শান্তির পরশ আনে নতুন শিক্ষিকা। প্রেম, সংগ্রামের প্রথম দীক্ষা তখনই পায় কিশোরী ইউন। সেটাই হয়তো আজীবনের ভিত্তি গড়ে দেয় জীবনে।
নারী পরিচালক বোরা কিমের প্রথম চলচ্চিত্র এটি। পাঁচ বছর ধরে গল্প ও চিত্রনাট্য গুছিয়ে এক বছরেই শুটিং শেষ করেন কিম। পার্ক জি-হু, কিম সা-বিউক, জুন ইন-গি প্রমুখ অভিনয় করেছেন এতে।
৮। The Unjust(২০১৪)
হিউম্যান বিহেভিয়ার এবং অরগানাইজেশনাল বিহেভিয়ারে মানুষের পক্ষপাতী আচরণ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়েছে। মোটা দাগে আট রকমের পক্ষপাতী বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। Hindsight Bias বা ঘটনা পরবর্তী বোধোদয় সম্পর্কিত পক্ষপাত অন্যতম। অর্থাৎ কোন ঘটনার ঘটে যাবার পরে সেটাকে পূর্ব অনুমান বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতাই হলো Hindsight bias. ‘The Unjust’ দেখবার পর ভাগ্যকে মিলিয়ে নিতে পারেন এই তত্ত্বের সাথে।
কাহিনী সংক্ষেপ: শহরে হুলস্থূল। ভয়ংকর এক ধর্ষক পাঁচ স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে খুন করেছে। পুলিশ ব্যাপক চেষ্টার পরেও প্রকৃত দোষীর সন্ধান পায় না, উল্টো এক ছাত্রীর চাচাকে হত্যা করে বসে। ফুঁসে ওঠে মিডিয়া ও জনতা। প্রবল চাপের মুখে দিশেহারা সরকার পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে তড়িঘড়ি তদন্তের নির্দেশ দেয়।
তদন্তের দায় পড়ে দুঁদে কর্মকর্তা চোই চিওল-গির ঘাড়ে। সাজানো তদন্তের নির্দেশ থাকলেও চোই ও তার দল খুঁজে পায় সন্দেহভাজন লিকে। লির নামে এর আগেও বেশ কটি শিশু নিপীড়নের মামলা ছিল। দাবায় যখন বাজিমাত করে ফেলেছে পুলিশ তখনই বাগড়া বাঁধায় উকিল জু ইয়াং।
এরপরের অংশটায় ক্রমাগত টুইস্টের মুখোমুখি হবেন দর্শক। একের পর এক রুদ্ধশ্বাস ঘটনায় হতভম্ব করতেই যেন রিও সিওং-ওয়ান নির্মাণ করেছেন এটি। হুয়াং জুং-মিন, রিও সিওং-বাম, ইউ হা-জিন প্রমুখ অভিনয় করেছেন এতে।
৯। Two Doors (২০১২)
প্রামাণ্যচিত্রের নাম দেখে বিস্মিত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এই প্রামাণ্যের বদৌলতেই বিশ্বের কাছে পুনরায় ইয়নসাং ট্র্যাজেডি আলোচনায় আসে। পুরো ঘটনা জানতে হলে ফিরে যেতে হয় দশ বছর আগে, ২০০৯ সালে।
২০ জানুয়ারি, ২০০৯। শীতের অন্যদিনগুলোর মতোই ফুরফুরে হতে পারতো তারিখটা। কিন্তু তৎকালীন সরকারি নীতির বিরুদ্ধে ক্রমে জমে উঠছিল ক্ষোভের লাভা। উন্নয়নের নামে বিভিন্ন এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছিল সিউলের অধিবাসীদের। ক্ষতিপূরণ হিসেবে হাতে গুঁজে দেয়া হচ্ছিল নামেমাত্র কিছু অর্থ।
অনুরোধে চিড়ে ভেজেনি প্রশাসনের। বাধ্য হয়েই বিক্ষোভে নামে ইয়ংসানের জনতা। পুলিশের সাথে হাতাহাতিও হয় তাদের। দাঙ্গা হাঙ্গামার মধ্যেই ৪০ জন অধিবাসী আশ্রয় নেয় একটি দালানের ছাদে।
দাঙ্গা পুলিশ নানাভাবে তাদের হেনস্থা করতে থাকে। প্রায় পরিকল্পনাহীন একটি অপারেশনও চালায় তারা। ফলে অগ্নিকান্ড ঘটে ওই ছোট্ট জায়গাতেই। এতে মারা পড়েন পাঁচ বাসিন্দা ও এক পুলিশ। পুলিশের দাবি বাসিন্দাদের ফায়ারবম্বের কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। অথচ তদন্ত ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্পষ্ট বোঝা যায়, পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া একদল দাঙ্গাবাজ পুলিশের তড়িঘড়ি নীতিই এর জন্য দায়ী।
সমালোচনার চাপে তৎকালীন সিউল মেট্রোপলিটন পুলিশ এজেন্সি প্রধান কিম সিওক-কি পদত্যাগ করেন।
ঘটনার দশ বছর পেরুলেও এর সুষ্ঠু তদন্ত ও ক্ষতিপূরণ পায়নি ক্ষতিগ্রস্তরা। এমনকি পুলিশের পক্ষ থেকেও কোন ক্ষমা প্রার্থনাসূচক বার্তা পায়নি নিহতের স্বজনেরা। কিম ইল-রান ও হং জি-ইউ জোড়া পরিচালকের গুণে প্রচুর তথ্য উঠে এসেছে ১০১ মিনিটের ডকুমেন্টরিতে। একই বিষয়ে ‘The Unfair’ নামক একটি চলচ্চিত্রও মুক্তি পায় ২০১৫ সালে।
১০। Train to Busan(২০১৬)
নাটকীয়তা শব্দের সাথে জোম্বি হরর সাধারণত যায় না। একই ধারার স্ক্রিপ্টের কাজ দেখে অনেকেই হয়তো বিরক্ত। তবে ভিন্নতার স্বাদ পুরোদমে এনে দেয় গং উর ‘Train to Busan’.
কাহিনী সংক্ষেপ: কিছুটা ভার ভার মনেই বুসানের পথ ধরেছেন সিওক-উ আর ক্ষুদে কন্যা সু-আন। রেলগাড়ির ঝিকঝিকে সেই ভারি ভাবটা কাটছে না কিছুতেই। পাশে থেকেও অনেকটা দূরে যেন বাবা-মেয়ে।
সেই ট্রেনেই হুট করে উঠে পড়ে নব্য ‘মানুষখেকো’ ভাইরাসে আক্রান্ত এক তরুণী। এক কামড়েই নাস্তানাবুদ হতে পারে যে কেউ! এক থেকে দুই, দুই থেকে দশ… ধীরে ধীরে ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রীই আক্রান্ত হয় ভাইরাসে। পরিণত হয় জোম্বিতে।
ছবি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৯ মিলিয়ন ডলার, যার ফলশ্রুতিতে বক্স অফিসে এর আয় দাঁড়ায় ১০০ মিলিয়নে। এত বিরাট সাফল্যের পেছনের কারণ?
গৎবাঁধা হররের পর্যায়ে না হেঁটে ইয়ন সাং-হো একে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করেছেন। বুসান যাত্রীরা শুধু জীবন বাঁচাতে মরিয়া ছিল না, সাথে ছিল ক্রান্তিকালে একদল মানুষ পরস্পরকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা। ছিল আত্মত্যাগের পরম সাহসিকতা।
‘Train to Busan’, ‘Age of Shadows’ আর ‘Goblin’(টিভি সিরিজ) এর কল্যাণে সেবছরটা গং-উময়ই ছিল। খ্যাতির তুঙ্গে একলাফে উঠে পড়েন একচল্লিশ বছর বয়সী এই সুদর্শন অভিনেতা। ইয়ন সাং-হো পরিচালিত এই ফিল্মের সিকুয়েল ‘Peninsula’ মুক্তি পায় এবছরের ১৫ জুলাই।
নানান সমস্যায় জর্জরিত হলেও দক্ষিণ কোরিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আধিপত্য বিস্তার করছে ক্রমশই। তাদের ফিল্মে কখনো উঠে আসছে রক্ত, জিঘাংসা, সহিংসতার গল্প, কখনো মানবিকতা, স্বপ্ন ও ধ্যান। ফিল্মে এই অবিচ্ছিন্ন সৃষ্টিশীলতাই কোরিয়ানদের স্বকীয় প্রকাশ ।
লেখক- সারাহ তামান্না