উত্তর কোরিয়ায় কিম জং উনের উত্তরসূরি কে?1 min read
Reading Time: 4 minutesগত ১২ এপ্রিলের পর থেকে উত্তর কোরিয়ার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কিম জং উন জনসম্মুখে আসেন নি। কিম সাধারণত এত দীর্ঘ সময় সংবাদ মাধ্যমে অনুপস্থিত থাকেন না। কিমের চরিত্রের বিচিত্রতা ও রহস্যময়তার কারণে পৃথিবীব্যাপী সাধারণ আমজনতার কাছে কিম সম্পর্কিত সংবাদের আলাদা একটি আবেদন রয়েছে। সংবাদের চাহিদার কথা ভেবেই হোক কিংবা প্রকৃত তথ্য প্রকাশের দায় থেকেই হোক বিভিন্ন বড় বড় সংবাদ মাধ্যম কিমের মৃত্যুকে ঘিরে নানা রকম ফিসফাস শুরু করে।
হংকং এর এইচকেএস টিভির দাবী করে ৩৬ বছর বয়সী উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উন হৃদরোগে ভুগে মারা গেছেন। ডেইলি মেইলের দাবী ছিল হৃদপিন্ডে জরুরী অস্ত্রোপচার শেষে কোমায় আছেন এই নেতা। প্রায় একইরকম দাবী করেছে জাপানের ম্যাগাজিন শুকান গেংদেই। তবে উত্তর কোরিয়াকে বন্ধু রাষ্ট্র বলা চীনের দাবী ছিল কিম সম্পূর্ণ সুস্থ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের জানিয়েছিল, চীন থেকে কিমের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল গিয়েছিল সত্য, তবে এখনি মারা যাননি কিম জং উন।
কদিন ধরে চাপা গুঞ্জনে অবশেষে ছাই পড়েছে। ২০ দিন পরে জনসম্মুখে এসে একটি সার কারখানার প্ল্যান্টের উদ্বোধন করেছেন কিম। কোরিয়ান সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সির (কেসিএনএ) বরাত দিয়ে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
কিন্তু গুঞ্জন যদি সত্য হতো তবে উত্তর কোরিয়া কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতো? সেদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কে ভোগ করতেন? চলুন এই উত্তরটি খোঁজার চেষ্টা করি।
“এমন প্রশ্ন জেগে ওঠা খুবই যুক্তিসঙ্গত। তিনি একজন তরুণ নেতা যার স্বাস্থ্য খুবই দূর্বল এবং তার সত্যিকার অর্থে কোন উত্তরাধিকারী নেই।“ সম্প্রতি ইনসাইড এডিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন সাংবাদিক বারবারা ডেমিক।
কিমকে ঘিরে মূলত এই জল্পনা কল্পনার শুরু হয় তার হৃদপিন্ডে অস্ত্রোপচারের পর থেকেই। তিনি অস্ত্রোপচার শেষে মাউন্ট কুমগাং অঞ্চলে বিশ্রামে ছিলেন। একসময় জায়গাটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হলেও পরে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। গুঞ্জন আরো জোরালো হতে শুরু করে যখন তিনি তার দাদা কিম ইল সাং এর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অংশ নেননি। এতে করে সবাই ধারণার করেন পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন তরুণ এই নেতা।
কিম জং উনের স্বাস্থ্য অনেকদিন ধরেই অস্থিতীশীল অবস্থায় রয়েছে। বারবারা ডেমিক যেমনটি বলেন, ”এই মানুষটি নিশ্চিতভাবেই শারিরীকভাবে ভালো অবস্থায় নেই। তিনি প্রচুর ধূমপান এবং মদ্যপান করেন।“ এছাড়াও কিমের ওজনেও রয়েছে অস্বাভাবিকতা। মাত্র ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির মানুষ হলেও তার ওজন প্রায় ৩০০ পাউন্ডের কাছাকাছি।
এছাড়া বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯ এর প্রকোপে আক্রান্ত হবার বিষয়টিও ঠিক উড়িয়ে দেয়া মত না। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার মৃত্যু হলে আসলেই বেশ কিছু বড় পরিবর্তন দেখবে বিশ্ব।
এখন পর্যন্ত কিম জং উনের সন্তানেরা শিশু। তাদেরকে এখন পর্যন্ত উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেননি কিম। উত্তর কোরিয়া তার জন্মলগ্ন থেকে দুবার উত্তরাধিকারী দেখেছে। কিমের দাদার পরবর্তীতে তার বাবা এবং তার বাবার পর তিনি নিজে ক্ষমতা দখল করেছেন। তাই এখনি উত্তরাধিকারের হালচাল বোঝা বেশ মুশকিল। তবে কিম ইল সাং ১৯৯৪ সালে কিম জং ইলকে ক্ষমতা প্রদানের বেশ আগেই তাকে জনসম্মুখে নিয়ে আসেন। একইভাবে কিম জং ইলও উত্তরাধিকারী হিসেবে বেশ কয়েকবছর আগেই কিম জং উনকে পরিচিত করে তোলেন।
আর বর্তমানে কিম জং উন তার রাষ্ট্রীয় কাজে যাকে সবচেয়ে বেশি সামনে নিয়ে এসেছেন তিনি তার বোন, কিম ইয়ো জং। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কিম ইয়ো জংকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দেখা গিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে তিনি উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি উপস্থিত ছিলেন হ্যানয়ে অনুষ্ঠিত উত্তর কোরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বৈঠকেও। একারণেই কিমের মৃত্যু নিয়ে জল্পনা কল্পনার শুরু হলে তার নামই সবচেয়ে বেশি উঠে আসে উত্তরাধিকারী হিসেবে।
কিন্তু উত্তর কোরিয়া কি তৈরি একজন নারী নেতৃত্ব মেনে নিতে?
উত্তরটা দেয়া বেশ কঠিন। কারণ উত্তর কোরিয়া চরম মাত্রায় লিঙ্গ বৈষম্য এবং কনফুসীয় দর্শনে বিশ্বাসী একটি রাষ্ট্র। কিম ইয়ো জং হয়ত খুব দ্রুতই নিজেকে শক্ত একটি অবস্থানে নিয়ে এসেছেন কিন্তু তাতে করে আসলেই প্রমাণ হয়না যে তিনিই পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসতে চলেছেন।
বারবারা ডেমিকের মতে, “উত্তর কোরিয়া সম্ভবত নারী ক্ষমতায়নের দিক থেকে এশিয়ার সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্র। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আপনি কিম ইয়ো জংকে পাচ্ছেন। তিনি বেশ ভাল ভূমিকা পালন করছেন। তিনিই কিমের ব্যক্তিগত জিনিস বহন করছেন কিংবা ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন। বলা চলে একেবারেই পরিচারিকার কাজ করছেন।“
কিন্তু কিমের বাদ বাকি ভাইয়েরা কি ক্ষমতায় আসতে পারেনা? কিমের ভাই কিং জং চোল এক্ষেত্রে বেশ বিতর্কিত। বিভিন্ন সময়ে তাকে ‘মেয়েলি’ চরিত্রের বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কিম পরিবারের সাবেক বাবুর্চির মতে তিনি ছিলে “মেয়েদের মত কোমল হৃদয়ের আধিকারী।“ ডেমিকের ভাষ্য অনুযায়ী, “তিনি সবসময়ই উত্তরাধিকারী হিসেবের বাইরে ছিলেন।“ তিনি মূলত রকস্টার এরিক ক্ল্যাপটনের বেশ বড় একজন ভক্ত। নিজেও বেশ ভাল গিটারবাদক। ২০১৫ সালে লন্ডনে তিনি ক্ল্যাপটনের সাথে একই মঞ্চে পারফর্ম করেছিলেন।
বড় ভাই কিম জং ন্যাম, যাকে ইলের উত্তরসূরি ভাবা হয়েছিল তাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এক আততায়ী হামলায় নিহত হন তিনি। বেশির ভাগের ধারণা ক্ষমতা সুসংহত করতে কিম জং উন তার ভাইকে হত্যা করেন।
তবে উত্তর কোরিয়ায় সেনা শাসনের সম্ভাবনা সব সময়ই বেশ জোরালো। কিম জং ইল সেনাবাহিনীর প্রতি অনেকটা নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু কিম জং উন তার দাদার আদর্শে দীক্ষিত, যিনি সেনাবাহিনীর চাইতে জনগণকেই বেশি কাছে রাখতে আগ্রহী। কিমের মৃত্যু হলে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া খুব বেশি অসম্ভব না।
সবশেষে যে প্রশ্নটি আসে, কিম জং উনের মৃত্যু হলে উত্তর কোরিয়ার কি পতন ঘটবে?
বারবারা ডেমিকের কথা থেকেই বরং শোনা যাক, “উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে কিছু কিছু জিনিস বাইরে থেকে একেবারেই বুঝতে পারা যায় না। উত্তর কোরিয়া ২০১১ সালে কিম জং ইলের ইলের মৃত্যু পরবর্তী অবস্থার তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। উত্তরপূর্ব এশিয়ার বাদ বাকি দেশের তুলনায় একেবারে বন্দী হলেও উত্তর কোরিয়া যথেষ্ট উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে।“
সত্যিকার অর্থেই উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি ধীরে ধীরে নতুন পথে হাঁটছে। সে দেশে মোবাইল ফোনের প্রচলন রয়েছে। বিপনী বিতানের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। এমনকি চীন থেকে স্বল্প মাত্রায় পণ্য আমদানিও করছে উত্তর কোরিয়া। বারবারা ডেমিকের কথা অনুযায়ী, আগামী নেতার অধীনে উত্তর কোরিয়া যে পৃথিবীর সাথে আরও বেশি সংযুক্ত হবে তাতে খুব বেশি সন্দেহ করা চলে না। সে চিন্তা করলে বড় পরিবর্তন আসবে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে। সামরিক দিক থেকে পরমাণু অস্ত্র নিয়েও বেশ সাবধানী হতে হবে তাদের। আর অদেখা উত্তর কোরিয়া হতে পারে আরেকটি পর্যটন কেন্দ্র।
তবে সে এখনো দূরের পথ। কিম জং উনের মৃত্যু যেহেতু নিছকই গুঞ্জন এবং কিম ইয়ো জং নিজেও তার ভাইয়ের আদর্শে চলছেন, তাই সহসাই মুক্ত পৃথিবীর সাথে সখ্যতা হচ্ছেনা উত্তর কোরিয়ার।
লেখক- জুবায়ের আহম্মেদ