Site icon Bangla Info Tube

কাশ্মীর সমস্যা ও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

উরিতে সন্ত্রাসী হামলা; Image source: scroll.in

Reading Time: 5 minutes

পৃথিবীর ভূস্বর্গ বলা হয় কাকে? কাশ্মীরকে। যদিও পর্যটন নগরী হিসেবে কাশ্মীরের অনেক নামডাক আছে, কিন্ত কাশ্মীরের খ্যাতির কারণ কোনটা এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয়। এটা কি তাদের অপার সৌন্দর্যের জন্য নাকি ভারত-পাকিস্তানের বিরোধের জন্য, নিশ্চিত হওয়াটা কঠিন। সেই ১৯৪৭ এ শুরু, আজও চলছে, এবং কবে শেষ হবে তার কোন নিশ্চয়তা নাই। তাই যারা এখনও এ বিরোধের ছিটেফোঁটা জানেন না,তাদের জন্য আজকের লেখা।

ব্রিটিশদের বিদায়

১৮ শতক পর্যন্ত পসতুন দুররানি সাম্রাজ্য ছিল কাশ্মীরে। এরপর ১৮১৯ সালে শিখ শাসক রঞ্জিত সিং কাশ্মীর জয় করে নেন। ১৮৪৬ সালে প্রথম অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধের পর লাহোর চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মীরকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে সমর্পিত করা হয়। পরে অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে গুলাব সিং কোম্পানির কাছে থেকে কাশ্মীর কিনে নেন। গুলাব সিং জম্মু ও কাশ্মিরের মহারাজা উপাধি নিয়ে শাসন শুরু করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চলে যাওয়ার আগপর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মিরের মত প্রিন্সলি স্টেটগুলো মহারাজাদের দ্বারাই শাসিত হয়েছে।

১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান কে ভাগ করা হয়, ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে ৫২৬ টি প্রিন্সলি স্টেটকে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে নিজস্ব পছন্দে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এসকল স্টেটের মাঝে কাশ্মীর সবচেয়ে বড় স্টেট ছিল। কিন্ত তৎকালীন কাশ্মিরের মহারাজা হরি সিং সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীনভাবে থাকার। যেহেতু কাশ্মীর মুসলিম অধ্যুষিত ছিল,তাই কাশ্মীর ভারতের অংশ হলে মুসলিমরা খুশি হতো না, আবার পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হলে কাশ্মীরের হিন্দুরা খুশি হতো না। তাই স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্ত পুচ অঞ্চলের বিদ্রোহ ও পাঠানদের আক্রমন দমন করতে না পারলে মহারাজা হরি সিং ভারতের সাহায্য চান। ভারত সাহায্যের বদলে তাদের সাথে যুক্ত হবার শর্ত জুড়ে দেয়। যা মহারাজা মেনে নেন।

মহারাজ হরি সিং,কাশ্মিরের শেষ মহারাজ; Image Source: wikipedia.com

ভারত-পাকিস্তানের প্রথম যুদ্ধ, সাল ১৯৪৭-৪৮

কাশ্মীর ভারতের কাছে সমর্পিত হয় ১৯৪৭ এর ২৬ অক্টোবর। ভারত শ্রীনগরে নিজের সেনা মোতায়েন করে। পাকিস্তানিরাও নিজেদের সেনা প্রবেশ করাতে চাইলে ব্রিটিশরা অপারগতা জানায়, যেহেতু কাশ্মীর নিজেকে ভারতের সাথে যুক্ত করে ফেলেছিল। পরবর্তীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু জানুয়ারির ১ তারিখে জাতিসংঘের কাছে কাশ্মীর সমস্যা উত্থাপন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগস্ট ১৩,১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহার সঙ্ক্রান্ত সমাধান দেওয়া হয়।

পাকিস্তানের পর ভারত নিজের সৈন্য নিয়ে নিবে তাও বলা হয়েছিল। আরও বলা হয়েছিল যে কাশ্মীরে একটি গণভোট করা হবে যা ঠিক করবে কাশ্মিরীরা কাদের সাথে থাকতে চায়। কিন্ত পাকিস্তান জাতিসংঘের প্রস্তাব উপেক্ষা করে যুদ্ধ করতেই থাকে। অবশেষে ১ জানুয়ারী, ১৯৪৯ এর প্রথম প্রহর থেকে দুই দেশ অস্ত্র-বিরতিতে যায়। আর এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ এর, যদিও তখন এ নামে পরিচিত ছিল না।

১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত সেনাদের যুদ্ধ;

ভারত-পাকিস্তানের দ্বিতীয় যুদ্ধ

১৯৪৭ এর পর পাকিস্তান দ্বিতীয় বারের মত কাশ্মীর দখলের চেষ্টা করে ১৯৬৫ সালে। এবার তারা গেরিলা অপারেশনের পথ ধরে। নাম ছিল, ’অপারেশন জিব্রালটার’ । প্ল্যান অনুযায়ী বিভিন্ন সেচ্ছাসেবক ও মুঝাহিদিনের লোকজন সহ ৩০.০০০ মানুষ পাকিস্তান পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে।  অনুপ্রবেশকারীদের পরিকল্পনা ছিল কাশ্মীরের স্থানীয় মানুষদের মাঝে ঝামেলা তৈরি করা ও তাদের বিদ্রোহে উদবুদ্ধু করা। অন্যদিকে গেরিলারা  ব্রিজ, টানেল, রাস্তা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্থাপনা ইত্যাদি  উড়িয়ে দিবে। অর্থাৎ একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের সৃষ্টি হবে। কিন্ত কাশ্মিরীরা বিদ্রোহ না করে উল্টো অনুপ্রবেশকারীদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তান এসকল অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করে।

১ সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান লাইন অফ কন্ট্রোলের আখনুরে আক্রমণ করে, যেন কাশ্মিরের সাথে ভারতের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। প্রতি উত্তরে ভারত পাকিস্তানের পাঞ্জাবে আক্রমণ করে। এই গোলাগুলি ২৩ সেপ্টেম্বার পর্যন্ত চলে। পরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় উজবেকিস্তানের তাশখন্দে ১০ জানুয়ারি, ১৯৯৬–তে তাশখন্দ চুক্তি করে ও যুদ্ধের অবসান ঘটে।

সিমলা চুক্তি

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুদ্ধের মাঝেই শেষের দিকে পাকিস্তান ভারতের সাথেও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালে ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলায় ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলী ভুট্টো আলোচনায় বসেন। কারণ ভারতের হাতে পাকিস্তানের ৫,১৩৯ বর্গ মাইল এলাকা ছিল ও পাকিস্তানের ৯০,০০০ সৈন্য যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ছিল। ৪-১০ তারিখ পর্যন্ত এ আলোচনা চলেছিল এবং ১০ তারিখে অবশেষে চুক্তি সাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বলা হয় যে দুই দেশ শান্তি বজায় রাখবে, কাশ্মির সংক্রান্ত সমস্যা তারা দুই দেশ মিলেই আলোচনার মাধ্যমে মেটাবে। এর মধ্য দিয়ে লাইন অফ কন্ট্রোল অফিসিয়ালি নিজের নাম পায়।

১৯৮৯ এর বিদ্রোহ

সিমলা চুক্তির পর কিছু বছরের জন্য সব ঠিকঠাক চলছিল কাশ্মীরে। তারপর এলো ১৯৮৯। সে বছরে প্রথম কাশ্মীরে সংগঠিতভাবে সশস্ত্র বিদ্রোহ হয়। আর এ বিদ্রোহ ঘটায় কিছু ধর্মভিত্তিক সন্ত্রাসীরা যারা কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। এ বিদ্রোহের কারণে কাশ্মীর থেকে প্রচুর সংখ্যালঘু হিন্দু পালিয়ে যায়। ১৯৯০ পর্যন্ত তারা কাশ্মির ছাড়তে থাকে। শুধু তারা নয়, মুসলিম বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, আমলারাও কাশ্মির ছাড়তে বাধ্য হয়। ভারত দাবি করে যে এসব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও আফগানিস্তানের ইসলামী সন্ত্রাসি গ্রুপের কাজ, কারন তারা কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করতে চায়। তারা এও বলে যে, পাকিস্তান এদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করে ও অন্যান্য সব ধরনের সাহায্য করে থাকে। যদিও পাকিস্তান বরাবরই এসব অস্বীকার করে এসেছে। পাকিস্তানের ভাষ্যমতে তারা হচ্ছে ‘কাশ্মীরি মুক্তিসেনা’।

কারগিল যুদ্ধ, ১৯৯৯

১৯৯৯ এর মাঝামাঝির দিকে পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মির থেকে বিদ্রোহীরা ও পাকিস্তানি সেনারা লাইন অফ কন্ট্রোলের ভারতীয় অংশে আক্রমণ করে ও কারগিল দখল করে নেয়।

ম্যাপে কারগিলের অবস্থান; Image Source: wikipedia.com

সাধারণত শীতকালে এলওসি’র উচু শৃঙ্গে পাহারা দেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে, আবহাওয়ার জন্য। সেজন্য ভারতীয় সৈন্যরা উচু শৃঙ্গ থেকে নেমে নিম্ন উচ্চতায় অবস্থান নিত, পাকিস্তানি সেনারাও তাই করতো। কিন্ত ১৯৯৯ সালে এটারই সুযোগ নেয় আক্রমণকারীরা। ভারত ও বেশ ভালভাবেই জবাব দেয় এই আক্রমনের। অপারেশন বিজয় নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দেয়। অন্যদিকে ভারতীয় বিমানবাহিনি ও নৌবাহিনীও যুদ্ধে জড়িয়ে যায়।

পারমানবিক পরীক্ষার পর দুই দেশের মাঝে এটাই ছিল প্রথম যুদ্ধ। তাই আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন দ্রুত মধ্যস্থতায় এগিয়ে আসেন এবং পাকিস্তান বাধ্য হয় তাঁর সেনা সরিয়ে নিতে। প্রায় ৩ মাসের এ যুদ্ধে ভারত হারায় ৫২৭ সেনাকে ও পাকিস্তান হারায় ৪৫৩ (মতান্তরে ৭০০) সেনাকে, আহত হয় হাজারে। জুলাই ২৬ এ যুদ্ধের অবসান ঘটে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান এরুপ যুদ্ধে আর জড়ায় নি।

কারগিলের পর সেরকম বড়সড় কোন আর যুদ্ধ বা গোলাগুলির ঘটনা ঘটেনি। কাশ্মীরে মিছিল হয়েছে,উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে কিন্ত ভারত-পাকিস্তান কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। কিন্ত কাশ্মীরে কিছু গণকবরের খোজ পাওয়া যায়, এগুলোর তদন্তের দাবিতে কাশ্মীরে মিছিল করে জনগণ।

উরি ২০১৬ ও পুলওয়ামা ২০১৯

২০১৬ সালে এলওসি-র কাছে উরিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে ভোর ৫.৩০ টায় আক্রমণ করে ৪ জন সন্ত্রাসী। হঠাৎ এ আক্রমণে ১৯ জন সৈন্য মারা যায় ও আরও অনেকে আহত হয়। ধারনা করা হয় যে জইশ-ই-মোহাম্মেদ এ হামলা করিয়েছে। প্রতিউত্তরে এগার দিন পরে ২৯ সেপ্টেম্বরে ভারত পাকিস্তানের কাশ্মীরে সার্জিকাল স্ট্রাইক- এর দাবি করে, এবং কিছু ফুটেজ ও মিডিয়াতে ছাড়ে। যদিও পাকিস্তান তাদের এ দাবি উড়িয়ে দেয়।

উরির পর ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী পুলওয়ামাতে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের ৪০ জন মৃত্যবরণ করেন ও ৭০ জন এর মত আহত হন। এবারো জইশ-ই- মোহাম্মদ এ হামলার দায়স্বীকার করে। এ হামলার ফলে পুনরায় লাইন অফ কন্ট্রোলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এলওসি তে গোলাগুলির কারণে দুই পক্ষেই আহত হয় অনেকেই। এছাড়া ২৬ ফেব্রুয়ারী বালাকোটে এয়ারস্ট্রাইক করে ভারত, যা ১৯৭১ সালের পর প্রথম ঘটল। ভারত এ স্ট্রাইকে একটি সন্ত্রাসী ক্যাম্পে হামলা চালানোর দাবি করে এবং ৩৫০ জনের মত সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে বলে জানায়। কিন্ত পাকিস্তান কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে প্রচার করে।

পুলওয়ামার বোমা হামলা; Image Source: outlookindia.com

২৭ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ভারতীয় কাশ্মীরে এয়ারস্ট্রাইক চালায়। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একে ‘বার্তা পাঠানো’ হিসেবে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে ভারতীয় মিগ-২১ এর পাইলট অভিনন্দন বর্মণ পাকিস্তানের কাছে ধরা পড়েন। কিন্ত শান্তির বার্তা প্রদানের উদ্দেশে পাকিস্তান কোন শর্ত ছাড়াই ছেড়ে দেয় তাঁকে। নতুন ভাবে আর অঘটন ঘটেনি, কিন্ত দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক এখনও ঠিক হয়নি।

ভারত এখন কাশ্মীরের ৪৫% এর অধিকারী, পাকিস্তান ৩৫% ও চায়না ২০% এর অধিকারী। জহ্রুলাল নেহ্রু গণভোট এর কথা বলেছিল কিন্ত হয়নি তা আজও। আর তাই কাশ্মিরীরা আসলেই কি চায় তা এক অর্থে অজানাই বলা যায়। ভারতের অনেক কাশ্মীরির আত্মীয় পাকিস্তানের অংশে থাকে, আবার পাকিস্তানের অনেক আত্মীয় ভারতের অংশে থাকে। কিন্ত দুই দেশের কর্তাদের সিদ্ধান্তের মাঝে পড়ে বলির পাঠা হয় এরা। পাশাপাশি থেকেও দেখা হয় না তাদের। যে ঝামেলা ৭২ বছর ধরে চলছে সেটাকে ১০০ বছর পর্যন্ত টেনে না নেওয়াই উত্তম।

লেখক- Asmaul Husna

Exit mobile version