কান্তজির: প্রাচীন বাংলার এক ঐতিহাসিক মন্দির1 min read
Reading Time: 3 minutesবাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের অন্যতম জেলা দিনাজপুর; এই জেলার সাথে মিশে আছে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা বিষয়। এই জেলাতেই বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কান্তজির মন্দির বা কান্তনগর মন্দির। এই মন্দিরটি পরিদর্শনের জন্য প্রতিদিনই এখানে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক পর্যটক ছুটে আসে। হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক জগত সম্পর্কে এই মন্দিরটি আমাদের ধারণা প্রদান করে।
মন্দিরের অবস্থান ও ইতিহাস
এই মন্দিরটিকে কান্তজীউ বা কান্তজীর আবার কান্তনগর মন্দির নামেও ডাকা হয়। এছাড়াও নবরত্ন মন্দির নামেও এটা অনেকের কাছে পরিচিত; কারণ তিনতলা বিশিষ্ট মন্দিরের নয়টি চূড়া বা রত্ন ছিল। দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে কাহারোল থানার অন্তর্গত কান্তনগর গ্রাম ঢেপা নদীর তীরে কান্তজিউ মন্দির অবস্থিত। জনশ্রুতি আছে, শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহের অধিষ্ঠানের জন্য এ মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরের উত্তর পাশে ভিত্তি–দেবীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা ও জমিদার প্রাণনাথ রায় এই মন্দিরের কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পোষ্যপুত্র ১৭৫২ সালে মন্দিরটি নির্মাণ কাজ শেষ করেন।
মন্দিরের গঠন বিন্যাস ও স্থাপত্যশৈলী
কান্তজির মন্দিরের স্থাপত্য রীতি, গঠন বিন্যাস, শিল্প ও কারুকার্য ইত্যাদির সংমিশ্রণে এটি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত নয়াভিরাম। জমকালো পিরামিড আকৃতির মন্দিরটি তিনটি ধাপে উঠে গিয়েছে এবং তিন ধাপের কোণগুলোর উপরে মোট নয়টি অলংকৃত শিখর বা রত্ন রয়েছে; যা দেখে মনে হতে পারে একটি উচু ভিত্তির উপর প্রকাণ্ড একটি রথ দাঁড়িয়ে আছে।
মন্দিরটি একটি আয়তাকার প্রাঙ্গণের উপর স্থাপিত। এটির চারিদিকে রয়েছে পূজারীদের বসার স্থান। বর্গাকার একটি প্রধান প্রকোষ্ঠকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ ইমারতটি নির্মিত হয়েছে। পাথরের উপর দাঁড়ানো মন্দিরের উচ্চতা ৫০ ফুটের বেশি নয়। মন্দিরের নিচতলায় ৩১টি খিলান, দ্বিতীয় তলায় ৩১টি খিলান এবং তৃতীয় তলায় মাত্র ৩টি খিলান রয়েছে। মন্দিরের দেওয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে তিনটি পৌরাণিক কাহিনীর অনুসরণে মনুষ্য মূর্তি, প্রতিকৃতি, প্রাকৃতিক বিষয়াবলী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মহাভারত রামায়ণ এর নানা বিষয়ের উপস্থিতি এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ের অলঙ্করণে, কৃষ্ণের নানা কাহিনী, সমকালীন সমাজ জীবনের বিভিন্ন ছবি এবং জমিদার ও অভিজাতদের বিনোদন চিত্র আছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের অলংকরণে, বনের মধ্যে শিকার দৃশ্য, হাতি, ঘোড়া ও উট সহ রাজকীয় শোভাযাত্রা, যা সুন্দরভাবে সজ্জিত আছে। এছাড়াও পালকিতে বসে থাকা হুকা হাতে জমিদার, নদীর দৃশ্য, লোকজনে ঠাসা নৌকায় সকলে আনন্দ-উৎসবে মগ্ন এমন দৃশ্যপটও বিদ্যমান। তৃতীয় ধাপের অলংকারে রয়েছে, দানব রাজা কংস কিশোর কৃষ্ণকে বধ করতে উদ্যত, সারস গলার দানব বাকাসুর হত্যা, স্বর্ণ দানব কলিকায়ে দমন, লম্বা সরু নৌকায় কৃষ্ণের আনন্দ ভ্রমণ ইত্যাদি বিষয়।
কান্তজির মন্দিরের দক্ষিণ মুখে রামায়ণের বিভিন্ন কাহিনীচিত্র, পঞ্চবটীর বনে রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষণের বনবাসের চিত্র রুপায়ন করা হয়েছে। এছাড়াও রাবণ কর্তৃক সীতা অপহরণ, অশোকের বনে সীতার বন্দিজীবন ইত্যাদি পোড়ামাটির ফলকগুলোতে ফুটে উঠেছে।
এমনকি এখানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দৃশ্য ও লংকা যুদ্ধের দৃশ্যর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এমন অনেক দৃশ্য ও বিষয় আছে, যা আপনাকে গ্রামবাংলা জীবন-বৈচিত্রকে অনায়াসে মনে করিয়ে দিতে পারে। তেমনি একটি দৃশ্য কৃষ্ণ তার সাথীদের নিয়ে গাছ থেকে নারকেল পারছে এবং অন্য সাথীদের হাতে দিচ্ছে।
কান্তজির মন্দিরে সঙ্গে উড়িষ্যা ও দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের মিল থাকলেও এখানে কামদ দৃশ্যাবলির অনুপস্থিত রয়েছে। আদি ঐতিহাসিক পাহাড়পুর, ভাসুবিহার, সীতাকোট বৌদ্ধ মন্দিরগুলো লতাপাতা ও মূর্তি দিয়ে বড় বড় পোড়ামাটির ফলক দিয়ে সজ্জিত, যা অনেকটা সেকেলে ধরনের গঠন কিন্তু কান্তনগর মন্দিরের গঠন সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে শিল্পীদের উচ্চতর দক্ষতার প্রকাশ পেয়েছে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মন্দিরটি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এতে মন্দিরের উপরের রত্নসমূহ ভেঙ্গে পড়ে।
আচার-অনুষ্ঠান
দৈনন্দিন পূজা-অর্চনার পাশাপাশি মন্দিরকে ঘিরে একটি বিশেষ সময়ে মেলা ও উৎসব আয়োজন করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের অনেকগুলো লীলার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম লীলা হল রাসলীলা। কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ তার গোপীদের নিয়ে বৃন্দাবনে রাস উৎসবে মেতে ওঠেন। সেই ধারাবাহিকতায় মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাম উৎসব ও মাসব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এই উৎসবে যোগ দেয় এবং ভারত থেকেও অনেক দর্শনার্থী এই মেলায় যোগ দেওয়ার জন্য এখানে আসেন।
আচার–অনুষ্ঠান, অলংকার ও বিভিন্ন দৃশ্যপটের সংমিশ্রণে কান্তজির মন্দির একদিকে যেমন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তেমনি তৈরি হয়েছে একটি দর্শনীয় পর্যটন স্পটে।