কোনো মিসাইল, পারমাণবিক বোমা কিংবা বিশ্বযুদ্ধ নয়, সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছে প্রায় অদৃশ্য অণুজীবের একচ্ছত্র আধিপত্যে। কখনো ভাইরাস বা কখনো ব্যাকটেরিয়া অসংখ্যবার নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে মানুষকে । আর সেসবের ফলে পৃথিবী দেখেছে ডজনেরও বেশি মহামারী। সর্বশেষ মহামারী প্লেগের এক শতাব্দী পর বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে আরেকটি মহামারী করোনাভাইরাসের।
বর্তমানে ভাইরাসের ভয়ে দিনাতিপাত করা মানুষ একসময় অতি ক্ষুদ্র অণুজীব ব্যাকটেরিয়ায় প্রাণ খোয়াতো অহরহ। আর সে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগটির নাম কলেরা। মূলত অন্ত্রের রোগ কলেরা। এই রোগে তীব্র বমির সাথে ডায়রিয়া একসময় প্রকট আকার ধারণ করে। সাথে যুক্ত হয় পা কামড়ানো অসহ্য ব্যথা। শরীর থেকে প্রচুর পানি বের করে নিয়ে পানিশূন্যতায় অতি দ্রুত রোগীর মৃত্যু ঘটাত কলেরা।
কয়েক শতাব্দী পূর্বেও কলেরায় মানবজাতি দেখেছিল মৃত্যুর মিছিল। পর পর বেশ কিছু শতকে কলেরা ছড়ালেও ১৯ শতকে এসে বিশ্ব দেখেছিল কলেরার ভয়ানক তান্ডব। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ এবং বাংলা থেকেই ছড়িয়েছিল পানিবাহিত এই রোগ। যার কারণে এর নাম ছিল ‘বেঙ্গল কলেরা প্যান্ডেমিক’। স্থানীয়ভাবে কলেরা ওলা ওঠা বা ওলা বিবির আগমন হিসেবে পরিচিত ছিল।
মানব ইতিহাসে যে সাত রোগের মহামারীর দোর্দন্ড প্রতাপ দেখেছে মানুষ, কলেরা সেগুলোর একটি। বলার অপেক্ষা রাখেনা এই কলেরাই সবচেয়ে বেশিবার ভুগিয়েছে মানুষকে। এখনো প্রতি বছর কলেরা ১৩ থেকে ৪০ লাখ লোককে আক্রান্ত করে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে বছরে এই রোগে মৃতের সংখ্যা ২ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৪৭ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমনকারী রোগ কলেরার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াটি হল ভিব্রিও কলেরা। সচরাচর এই ব্যাকটেরিয়া উপকূলীয় অঞ্চল কিংবা নদীর মোহনায় লবণাক্ত পানিতে বাস করে । অপরিষ্কার পানির যথেচ্ছ পান ও ব্যবহারের ফলেই মানবদেহে প্রবেশের সুযোগ পায় এই অতি ক্ষুদ্র অণুজীব। আর এরই মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে কলেরা যা ডায়রিয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে প্রচুর লবণ ও পানি বের করে দেয়। কলেরা আক্রান্ত রোগীর একেকবার মল ত্যাগের মাধ্যমে এক লক্ষের বেশি জীবাণু পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব এলার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ।
কলেরার লক্ষণ
শতকরা ৮০ ভাগ কলেরা আক্রান্ত ব্যাক্তির ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা কলেরার উপসর্গে ভোগেননি। বাকি ২০ ভাগ ক্রমাগত ডায়রিয়া বমি আর খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়েছেন।
এই লক্ষণগুলোর ফলে পানি শূন্যতা, শ্বাসকষ্ট, অসহ্য গা ব্যথা অনুভুত হয়। আর এসবের ফলে অতি অল্প সময়ে মৃত্যু হতে পারে। ভিব্রিও কলেরার আরো দুই প্রজাতি- নন ০১ ভিব্রিও কলেরা বা নন-১০৩৯ কলেরার মাধ্যমে এই সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা থাকলে ও এগুলো এতটা প্রকট হয়না।
একটা সময় কলেরা মানেই ছিল নিশ্চিত মৃত্যু । চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে বর্তমানে এর ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়েছে এবং এন্টিবায়োটিকের সহজলভ্যতার ফলে কলেরা অনেকটা নির্মূলের পথে।
কবে কোথায় কিভাবে এল?
এটা এখনো স্পষ্ট নয় কবে কোথায় প্রথম কলেরা হয়েছিল। ৫ম শতাব্দীতে ভারতের সুশ্রুতা সমহিতায় এবং প্রাচিন গ্রীসে খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ শতকে হিপোক্রিটাসের লেখায় কলেরার মত রোগের কথা জানা গেছে।
তবে কলেরার প্রথম বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে ১৫ শতকে পর্তুগিজ ইতিহাসবেত্তা গাসপার কোরিয়ার লেখায়। তিনি মহামারী হিসেবে তার ভারতবর্ষের কিংবদন্তি বইতে কলেরার কথা উল্লেখ করেন। তার বইতে কলেরায় সংক্রমণ ঘটে এমন এলাকা হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানের কথা উল্লেখ রয়েছে।
স্থানীয়রা একে ‘মরিক্সি’ নামে ডাকত বলে তিনি উল্লেখ করেন। এই রোগের সংক্রমণের মাত্র ৮ ঘন্টার মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির মারা যাওয়ার নজির পাওয়া গেছে। পরবর্তী শতকের পশ্চিম ভারতীয়দের মাধ্যমে পর্তুগিজ,ডাচ,ফরাসি ও ব্রিটিশদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে।
মহামারীরূপী কলেরা
প্রথমবারের মত মহামারী আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়ার কথা শোনা যায় ১৮১৭ সালে তৎকালীন ভারতবর্ষের যশোরে । অপরিচ্ছন্ন পানিতে চাল সেদ্ধ করতে গিয়ে এর ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে বলে জানা গেছে ।
পরবর্তীতে সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়তে বেশি একটা সময় নেয়নি। এরপর ইউরোপীয় বণিকদের মাধ্যমে বর্তমান মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কাতেও ছড়ায় রোগটি।
১৮২০ সাল নাগাদ কলেরা থাইল্যান্ড,ইন্দোনেশিয়ায় ও ফিলিপাইনে বিস্তার লাভ করে। কেবল ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপেই ১ লক্ষ লোকের মৃত্যুর কারণ ছিল এই কলেরা। একই বছর এই রোগ চীনে অনুপ্রবেশ করে এবং এর দুই বছর পর জাহাজে চড়ে ১৮২২ সালে এটি জাপানেও ছড়িয়ে পড়ে। ১৮২১ সালে ব্রিটিশ বাহিনীর মাধ্যমে পারস্য উপকূলেও পৌছে যায় কলেরা । এভাবে ইউরোপ ছাড়িয়ে বর্তমান তুরস্ক ও সিরিয়া ও দক্ষিণ রাশিয়ায় বিস্তার লাভ করে।
কলেরার করাল গ্রাসে ইউরোপ ও আমেরিকা
দ্বিতীয়বারের মতো মহামারী হিসেবে কলেরা আবির্ভূত হয় ১৮২৯ সালে। আর ছড়ায় এর উৎপত্তিস্থল সেই ভারতবর্ষ থেকেই। মূলত বাণিজ্য ও সামরিক কারণেই তখনকার আমলে কলেরা ছড়ায়। উত্তর ও মধ্য এশিয়া হয়ে ছড়িয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে।
১৮৩০ সালের শুরুতে রাশিয়ার মস্কোতে ছড়ায় কলেরা। কিছুটা ঠান্ডা আবহাওয়া কলেরার গতিপথকে রুদ্ধ করে কিন্তু পরের বছরের বসন্তকালে কলেরা আবারো ভয়ালরূপে আবির্ভূত হয়। ততদিনে এটি ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ডে পৌছে যায়।পরবর্তীতে হাঙ্গেরী ও জার্মানিতে পৌছাতে বেশি সময় নেয়নি এই প্রাণঘাতি।
প্রথমবারের মত ব্রিটেনে এই রোগ পৌছায় সাদারল্যান্ডের বন্দরের মাধ্যমে । তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই জরুরী অবস্থার সামাল দিতে কোয়ারেন্টাইন এবং স্থানীয় পর্যায়ে মেডিকেল সেবা সম্প্রসারণ করার কাজ করে। প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর এই রোগ আবির্ভূত হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে জনগণের মনে এই রোগ নিয়ে ভয় ঢুকে যেতে থাকে এবং প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ পেতে থাকে।
১৮৩২ সালে কলেরা সাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। জুন মাসের মধ্যেই আমেরিকার কুইবেকে অন্তত এক হাজার মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। ক্রমশ সেন্ট লরেন্স নদী এবং এর শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে আরো ছড়িয়ে পড়ে ব্যাকটেরিয়ার বংশপ্রজাতি। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও ফিলাডেলফিয়ায় বিস্তার ঘটায় কলেরা। পরবর্তী কয়েক বছরে পুরো দেশেই এর বিস্তার ঘটে এবং ১৮৩৩ সাল নাগাদ ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পরে।
অন্তত দুই দশক ধরে গোটা বিশ্বকে কাপিয়ে অসংখ্য প্রাণ ঝরিয়ে ১৮৫১ সাল নাগাদ তখনকার মত এই মহামারী তান্ডবলীলা থামায় ।
কিভাবে বিজ্ঞানীরা কলেরাকে দমন করল?
১৮৫২ থেকে ১৯২৩ অব্দি বিশ্ব কলেরার মহামারী আরো বেশ কয়েকবার প্রত্যক্ষ করেছিল। তৃতীয়বারের মত কলেরা তান্ডব চালায় ১৮৫২ থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত। এ সময় কলেরায় এশিয়া, ইউরোপ,উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকায় রীতিমতো মহামারী ঘটায়, আর এই ধ্বংসযজ্ঞে কেবল ব্রিটেনেই ২৩ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।
ইউরোপের চিকিৎসকরা তখন বুঝে উঠতে পারছিলনা ঠিক কি কারণে কলেরা হচ্ছে। এ সময় আধুনিক মহামারী বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ শারীরতাত্ত্বিক জন স্নো কলেরার ভয়াবহ সময়টায় লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে কলেরার উৎসস্থল খুজে বের করার কাজ শুরু করেন। বহু অনুসন্ধান শেষে দূষিত পানির স্থান হিসেবে একটি সাধারণ মানুষের ব্যবহার করা পানির কুয়া চিহ্নিত করেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কতৃপক্ষকে কলেরা নির্মূল করতে কূপটি বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেন।
এরপর চতুর্থ ও পঞ্চম মহামারী হিসেবে কলেরা আসে ১৮৬৩ থেকে ১৮৭৫ ও ১৮৮১ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত।
উল্লেখযোগ্যভাবে অন্যান্য বারের তুলনায় এ সময় কলেরার এতটা প্রকোপ দেখা না গেলেও মৃতের সংখ্যা আগের চাইতে কোনো অংশে কম ছিলনা। কেবল হাঙ্গেরীতেই ১৮৭২-৭৩ সালে ১লক্ষ ৯০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। এবং ১৮৯২ সালে হামবুর্গের মোট জনসংখ্যার প্রায় দেড় শতাংশ লোকের প্রাণ কেড়েছিল।
১৮৮৩ সালে জার্মান অনুজীব বিজ্ঞানী রবার্ট কোঁত যাকে কিনা আধুনিক ব্যাকটেরিওলজির জনক বলা হয় তিনি মিশর ও কলকাতা থেকে নমুনা এই রোগের সংগ্রহ করেন। তিনি পর্যাপ্ত গবেষণা করে দেখতে পান ভিব্রিও কলেরা ব্যাকটেরিয়াই কলেরার জন্য দায়ী। কিন্তু তারও বহু আগে ১৮৫৪ সালে ইতালির অনুজীববিজ্ঞানী ফিলিপ পাচিনো আসল কলেরার জন্য দায়ী অণুজীব ব্যাকটেরিয়াকে শনাক্ত করেন এবং এর নাম দেন কলেরিজেনিক ভিব্রিওস।
১৮৯৯-১৯২৩ সালের দিকে পঞ্চমবারের মতন মহামারী কলেরা হানা দেয়।সে সময় পয়নিষ্কাশনের ও স্যানিটারির উন্নতির সময়কালে কলেরা অতটা মহামারী হিসেবে পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় আসেনি । কিন্তু ভারত রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে এটির করাল গ্রাস দেখা গিয়েছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সে কলেরায় ১৯১৮-১৯১৯ সালে কেবল ভারতেই অন্তত ৫ লাখের বেশি মানুষ মারা গিয়েছে।
১৯২৩ সাল নাগাদ কলেরা ভারতবর্ষ ছাড়া গোটা বিশ্বেই অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। আর এখন সেসব কাহিনী কেবলই ইতিহাসের গল্প।
বর্তমানে বাজার থেকে ওরস্যালাইন কিনে এনে কিংবা এক চিমটি লবণ আর একমুঠো চিনি কিংবা গুড়ের সাথে এক মগ পানি গুলে খেলে আর কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে যে ডায়রিয়ারূপী কলেরা থেকে আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারি আজ থেকে একশ বছর আগেও মানুষ সে কৌশলো জানত না। হয়ত আদূর ভবিষ্যতে বর্তমান মহামারী করোনাকেও অতি সাধারণ কিছু কৌশলে রুখে দেবে মানুষ সে প্রত্যাশা সবার।