চায়নার উহান শহরে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস রীতিমতো মহামারি আকার ধারণ করেছে। ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী প্রায় আট হাজার মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, ১৭০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। ৩১ জানুয়ারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন।
চায়না সরকার ইতোমধ্যে প্রায় বারোটিরও বেশি শহরকে অবরুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। এই মহামারী কেবল জনজীবনেই আতংক সৃষ্টি করেনি বরং ধারণা করা হচ্ছে চীনের অর্থনৈতিক অবস্থাকেও অনেকাংশে কোণঠাসা করে দিতে যাচ্ছে। যেখানে ধারণা করা হচ্ছিল এই অর্থবছরের শুরুতেই চায়না সম্রাজ্যের অর্থনীতির চাকা আগের চেয়েও বেশি পরিমাণ সচল থাকবে, সেখানেই এই আকস্মিক ধাক্কায় পুরো জাতি দিশেহারা!
অনেকগুলো বিমান ভ্রমণের উপর স্থগিতাদেশ, ভ্রমণ বাতিল ঘোষণা, রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেয়া সহ লাখো মানুষকে নিজেদের শহরে অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকার কারণে জনজীবনে নেমে এসেছে হতাশার কালো ছায়া। উল্লেখ্য যে এই মহামারীর কেন্দ্রবিন্দু উহানেই প্রায় এক কোটিরও বেশি সংখ্যক লোকের বসবাস। চীনের শিকাগো নামে খ্যাত দ্রুত উন্নত হতে থাকা উহানের স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.৮ শতাংশ পরিমাণ হয়ে রেকর্ড করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছিল। সকলের ধারণা ছিল এই শহরটি চায়নার মূল প্রবৃদ্ধিতে বিশাল আকারে প্রভাব বিস্তার করবে। ধারণা করা হচ্ছে এই ভাইরাসের প্রভাবে বিগত ২৯ বছরের মধ্যে সবচাইতে দুর্বলতম অর্থনৈতিক অবস্থার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে চীন!
বিগত ২৭ জানুয়ারিতে চায়না সরকার জানিয়েছে যে ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন ৬০.৩৩ বিলিয়ন ইউয়ান (৮ বিলিয়ন ডলার) সহায়তা বাড়িয়েছে।
উহান শহরটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণঃ
- এই শহরটিতে প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ লোকের বসবাস
- প্রতি বছর চায়নায় উৎপাদিত মূল পণ্যের প্রায় ১.৬ শতাংশ পণ্য উহানে উৎপন্ন হয়
- প্রতি বছর উহানে ৩১৯ মিলিয়ন পর্যটকের সমাগম ঘটে
- অ্যাপল, ওয়ালমার্টের মত প্রায় তিনশটিরও বেশি নামীদামী কোম্পানি উহান শহরে ব্যবসা করে চলেছে
- ২০২০ সালে উহানে দুই লক্ষরও অধিক নতুন কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ছিল
- পারফর্ম্যান্সের ভিত্তিতে উহান শহরটি চায়নার নবম শহর
অনেকগুলো আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা উহান থেকে আসা এবং যাওয়ার জন্য সকল বিমান ফ্লাইট বাতিল ঘোষণা করেছে। বিমান সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ সংস্থা সিরিয়ামের তথ্য অনুসারে, উহান শহরটিতে প্রতি সপ্তাহে প্রায় বিশটিরও বেশি দেশ থেকে মোট ৫৫টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট আসে।
এখন পর্যন্ত চায়নার উপর করোনা ভাইরাসের প্রভাবঃ
- ৭টি চাইনিজ মুভি প্রিমিয়ার বন্ধ রাখা হয়েছে
- চায়নার জনপ্রিয় হট পট নামক কেবল একটি রেস্টুরেন্ট কোম্পানিই তাদের ৪০০টিরও বেশি শাখা বন্ধ রেখেছে।
- চায়নায় বহুল জনপ্রিয় কাপড়ের কোম্পানির প্রায় ১৭টি আউটলেট বন্ধ রাখা হয়েছে
- হংকং এবং সাংহাইতে অবস্থিত দুটি ডিজনি থিম পার্ক আপাতত করোনা ভাইরাসের কারণে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
- চায়না সরকার করোনা ভাইরাসের কারণে অতিরিক্ত তিনদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে।
- জানুয়ারি ২৫ তারিখ থেকে ফেব্রুয়ারি ৪ তারিখ পর্যন্ত প্রায় নয়টি বিলাশ বহুল জাহাজ (প্রমদতরি) ভ্রমণ বন্ধ রাখা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভোক্তাদের ব্যয় করা খরচ চায়না অর্থনীতির মূল প্রবৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এদিকে এই করোনা ভাইরাস নামক সমস্যাটি ভোক্তার খরচের অর্থ ব্যাপক হারে কমিয়ে আনছে, যা কি না চায়নার অর্থনীতিতে একটি নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। এছাড়া ডিজনি থিম পার্কের মত অনেকগুলো বিনোদন কেন্দ্র এবং রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকার কারণে সেটা জাতীয় অর্থনীতিতে বেশ প্রভাব ফেলছে।
চীনের গোটা অর্থ ব্যবস্থার মোট এগারো শতাংশ আসে কেবলমাত্র পর্যটন ব্যবস্থা থেকে। প্রায় তিন কোটি ব্যক্তি চীনের এই পর্যটন ব্যবস্থার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে চীনের এই ভ্রমণ ব্যবস্থার উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে বলেই অনেকে ধারণা করে আসছেন। কেননা, কোন ভাবে যদি চীন আগামী এক দুই মাসের মধ্যে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে নিয়েও আসে তবু পর্যটন ব্যবস্থার স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে আসতে আরো বছর খানেক লেগে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য যে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের কারণে আরো একবার এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল চায়নাকে। আসুন দেখে নেই, সার্স ভাইরাস এর কারণে চীনের উপর কি ধরনের প্রভাব পড়েছিলঃ
- ২০০২ সালের শেষে দিকে চিনে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসের কারণে প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
- সার্স ভাইরাসের কারণে প্রায় চল্লিশ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল।
- সার্স ভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়ার পর মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে প্রায় পাঁচ মাস সময় লেগে গিয়েছিল।
- হোটেল রুমের প্রায় ষাট শতাংশ খালি ছিল
- আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রেও গুনতে হয়েছিল বিশাল ক্ষতি
বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের প্রভাব পড়তে যাচ্ছে?
ওষুধ খাতে এই ভাইরাসের কারণে আসতে যাচ্ছে এক বিশাল প্রভাব। কেননা যে সকল দেশে চীন জরুরী ওষুধ সরবরাহ করে সেই সকল দেশগুলোতে ওষুধ সংকট হুট করে সেই সকল দেশের জাতীয় নিরাপত্তার উপরেও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
চীনের পর্যটন ব্যবস্থার উপরেও অন্যান্য যে দেশগুলো নির্ভর করত সেগুলোর উপরেও নেমে আসছে বেশ বড় প্রভাব। এছাড়াও চায়নায় অবস্থান করা অন্যান্য দেশের নাগরিকরা যেভাবে নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে, তাতে করে জাতীয় রাজস্বের উপরেও একটা প্রভাব আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া অনেকেই মনে করছেন ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস যেভাবে চীনকে আক্রান্ত করেছিল এবার যদি দ্রুত কোন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পুরো বিষয়টিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা না যায় তাহলে আরো ভয়াবহ কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। চীনের অর্থনীতিবিদ শন রোচের অনুমান অনুসারে, “পরিবহণ ব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতা এবং বিনোদন সহ সমস্ত ভোক্তা ব্যয় ১০ শতাংশেরও বেশি কমে গিয়েছে। আর ফলাফল স্বরূপ জাতীয় প্রবৃদ্ধিও প্রায় ১.২ শতাংশ কমে যাবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।”