করোনা আতঙ্কে বাংলাদেশের সকল সিনেমা হল বন্ধ করা হয়েছে ১৮ মার্চ থেকে। এই মৌসুমে মুক্তির প্রতীক্ষায় ছিল বেশ কিছু চলচ্চিত্র। এমনকি এর ঠিক পরের দুই বৃহৎ উপলক্ষ- বৈশাখ ও ঈদকে ঘিরে সকল আয়োজনও মাঠে মারা গিয়েছে।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বের ছোট বড় সব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অবস্থাই এক। বিশাল ক্ষতির সম্মুখে লড়াই করছে হল মালিক, প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা থেকে আরম্ভ করে কলা কুশলীরা।
মুহূর্তেই ধূলিসাৎ
অর্থনৈতিক মন্দা আসতে আর বেশি দেরি নেই। এর প্রভাব আড়ম্বরেই শুরু হয়েছে খোদ হলিউডে। হলগুলো বন্ধ তো বটেই। এর বাইরেও পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে ১,৭০,০০০ কর্মচারী ছাটাই হয়ে গেছে শেষ দুমাসেই। অন্যদিকে ৫০,০০০ ফ্রিল্যান্সার শিল্পীও ঝরে গেছেন এই দৌড়ে। ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির দেখা পেতে পারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ফিল্মি পীঠস্থান।
মুনাফা হারাচ্ছে প্রযোজকেরা
মার্কিন প্রযোজনা সংস্থা মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ারের ব্যানারে এপ্রিলেই মুক্তি পেতো জেমস বন্ড সিরিজের ‘নো টাইম টু ডাই’। এখন এর মুক্তির তারিখ পিছিয়ে চলে গেছে ১২ নভেম্বর। এজন্য মেয়ার ইতোমধ্যেই গুনে ফেলেছে ৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি। অথচ তাদের উপাত্ত বলছিল, কমপক্ষে ৩০০ মিলিয়ন আয় করবে ছবিটি, বেশি হলে এক বিলিয়ন। অন্যদিকে প্যারামাউন্ট স্টুডিও ৩০ মিলিয়নের ক্ষতির মুখে। ‘আ কোয়াইট প্লেস ২’ এর পরিচালক জন ক্রাসিন্সকি এবং প্রযোজকেরা মাত্র ২৪ ঘণ্টার নোটিশে বন্ধ করেছেন এর প্রচারণা ও মুক্তি সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম।
তবে ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস ৯’ এর মুক্তির তারিখ আগেভাগেই পিছিয়েছে আগামী বছরে নিয়েছেন এর পরিচালক।
শুটিং আটকে যাওয়ার লাইন অতিশয় দীর্ঘ। মারভেলের ‘শাং চি এন্ড দ্য লিজেন্ড অফ দ্য টেন রিংস’ এবং এলভিস প্রিসলির বায়োপিকের কাজ অস্ট্রেলিয়ায় চলছিল। লন্ডনে ছিল ‘লিটল মারমেইড’এর লাইভ একশনের আয়োজন। প্রতি ক্ষেত্রেই দৈনিক ৩ লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ ডলারের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে নির্মাতা দল।
জুন ছিল বছরের সর্বাধিক আকাঙ্ক্ষিত মাস। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের ছায়াতেই মুক্তি পাবার কথা ছিল ‘ ওয়ান্ডার ওম্যান ১৯৮৪’ এবং ‘ইন দ্য হাইটস’এর। পিক্সারের ‘অনওয়ার্ড’ ভালো ব্যবসা করতে পারেনি বৈশ্বিক কারণেই। ডিজনির ‘সোল’ নিয়ে তুলকালাম চললেও মিইয়ে গেছে এর প্রভাব, জুনের আলো থেকে খসে গেছে এটিও। ইউনিভার্সাল স্টুডিওর ‘ক্যান্ডিম্যান’ ও প্যারামাউন্টের ‘টপ গান: ম্যাভেরিক’ এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
লাইট হাউজ সিনেমার প্রধান কার্য নির্বাহী কর্মকর্তা কেলি জেফসের কণ্ঠেও হতাশার সুর। ‘ আমরা সাধারণত স্বাধীন ভাবে নির্মিত সিনেমার পৃষ্ঠপোষকতা করি। দর্শক হয়তো বেশি থাকে না আমাদের; কিন্তু বিভিন্ন উৎসব, স্থানীয় জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বেশ ভূমিকা রাখে এগুলো। তবে এবার বোধয় কিছুই করতে পারবো না আমরা। অধিকাংশ সংস্থা চুক্তি বাতিল করেছে। একদিনে ৯০% আয় কমে এসেছে। সংস্থার ৩০ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম এই ভরাডুবি। কর্মীদের কান্নার কোন উত্তর দিতে পারছি না আমি।‘
ঘরে নেটফ্লিক্স, কিন্তু এর পেছনে?
লন্ডনভিত্তিক ক্র্যাকেন ফিল্মসের কাজ হলো ছবির লোকেশন, কর্মচারী, যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনে দেশের বাইরের কর্মী নিয়োগে সমস্ত আয়োজন করা। এর হর্তাকর্তা জো রে শ্লেষের সাথেই নিজের অবস্থা ব্যক্ত করেন, ‘প্রতিদিন একটা না একটা চুক্তি বাতিল হচ্ছে। সবার পক্ষে ঘরে থেকে কাজ করা সম্ভব হলেও আমাদের জন্য এটা অভিশাপ। আমাদের কাজই লোকেশন ঠিক করা, চুক্তি সম্পাদনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করা।
ঘরে থেকে সবাইকে নেটফ্লিক্স দেখার আহ্বান তো করা হচ্ছে, কিন্তু এর পেছনের কুশীলবেরা? তারা কাজ পাচ্ছে না, বেতন আটকে আছে, ভাড়া চুকাতে পারছে না অনেকে। মনে হচ্ছে, আমরা কোন জোম্বি সিনেমার অংশ।‘
আটকে গেছে বেতন
মাইকেল রেনল্ডস নিয়মিতভাবেই কাজ করেন চলচ্চিত্র, সিরিজ ও বিজ্ঞাপনের কাজে। স্বাধীনভাবে কাজ করলেও হুমকির মধ্যে পড়েছেন তিনিও। এখনো ১২ টি কাজের বেতন পান নি। করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কোম্পানি গুলোর উপর চাপ প্রয়োগও করতে পারছেন না। আইনি সহায়তা পাওয়ার আশাও কম।
চলচ্চিত্রে শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ করেন ব্লেয়ার বার্নেট, সবেই ব্যাংক উপুড় করে স্বামীর চিকিৎসা করিয়েছেন। জানুয়ারি থেকে বেশ কখানা কাজের কথাও হয়েছিল। জীবন নতুন করে শুরুর কথা ভাবছিলেন যখন তখনই ২৮ হাজার পাউন্ডের সব চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। নিজের দুরবস্থা নিয়ে ব্লেয়ার বলেন, ‘এক ঘণ্টার মধ্যে আমার সব আশা শেষ! হাতে টাকাও নেই, বাইরেও যেতে পারছি না। অথচ স্বামীর ওষুধ আনা জরুরি। আমাদের মতো ফ্রিল্যান্সার যারা, তাদের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ।‘
বাংলাদেশেও হাহাকার
দেশজুড়ে একের পর এক হল বন্ধ হওায় এমনিতেই নড়বড়ে অবস্থানে আছে সিনেমা জগত। তবুও ঈদ ও বৈশাখে মুক্তির তালিকায় থাকা ছবির সংখ্যা বেশ লম্বা। সিয়াম-পরিমনির ‘বিশ্বসুন্দরী’, ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’, পূজার ‘জ্বীন’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ-২’, ‘বান্ধব’, ‘নীল মুকুট’, ‘গোর’, ‘মিশন এক্সট্রিম’, ‘শান’, ‘বিদ্রোহী’, ‘মন দেব মন নেব’, ‘আমার মা’, ‘পরাণে’র মুক্তি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পেছানো হয়েছে।
ঈদের সিনেমা মুক্তি নিয়ে আছে আশঙ্কা। এর জন্য তৈরি রয়েছে অনন্ত জলিলের ‘দিন : দ্য ডে’, ‘মিশন এক্সট্রিম-২’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, ‘ইত্তেফাক’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘নদীর বুকে চাঁদ’, ‘সাইকো’, ‘গাঙচিল’, ‘শনিবার বিকেল’, ‘ওস্তাদ’, ‘ক্যাসিনো’, ‘পাপ-পুণ্য’, ‘আগামীকাল’, ‘আদম’, ‘সিক্রেন্ট এজেন্ট’, ‘ডেঞ্জারম্যান’, ‘স্বপ্নবাজী’, ‘ঢাকা ২০৪০’, ‘বিক্ষোভ’, ‘মানুষের বাগান’, ‘পেয়ারার সুবাস’, ‘কমান্ডো’সহ বেশ কিছু সিনেমা।
মামুনের নির্মাণে রিয়েলী-রোশান ও তারিক আনামকে নিয়ে নির্মিত ‘মেকআপ’ সিনেমা মুক্তির প্রস্তুতি থাকলেও করোনা কারণে তা আর সম্ভব নয়। জায়েদ খানকে নিয়ে মালেক আফসারী ‘টেনশন’ ছবির ঘোষণা দেন।
রফিক সিকদারের ‘ওপারে চন্দ্রাবতী’ ও ‘বসন্ত বিকেল’ ছবি দুটি পড়েছে শুটিং জটিলতায়। পপির ‘সাহসী যোদ্ধা’ ছবি প্রস্তুত রয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে রাশিদ পলাশের ‘পদ্মপুরাণ’।
মার্চে শ্যাম বেনেগালের নির্মাণে ‘বঙ্গবন্ধু’ বায়োপিকের শুটিং শুরু করা কথা থাকলেও সেটি পিছিয়ে গেছে । ‘কানামাছি’, ‘মন্ত্র’, ‘কাপ্তান’, ‘আগুন’, ‘কয়লা’সহ বেশ কয়েকটি ছবির শুটিং স্থগিত। পরিচালক সাফিউদ্দিন সাফি শুটিং শেষ করেছেন ‘সিক্রেট এজেন্ট’ ছবির। এদিকে মহরতও হয়েছে ববি-ইমন অভিনীত ‘ব্লাড’-এর।
আবু রায়হান জুয়েল পরিচালিত পরী-সিয়াম অভিনীত ‘অ্যাডভেঞ্জার অব সুন্দরবন’ সিনেমার শুটিং শেষ লকডাউনের আগেই। রিয়াদ ও সালওয়াকে নিয়ে কবরী বন্ধ রেখেছেন ‘এই তুমি সেই তুমি’র শুটিং। অন্যদিকে শুটিং শুরুর কথা ছিল সৈকত নাসিরের ‘আকবর’ ও আলোচিত ‘মাসুদ রানা’ সিনেমার। ঈদের জন্য শাকিব খানকে নিয়ে অনন্য মামুনের ‘নবাব এলএলবি: ব্যাক ফর জাস্টিস’ ছবির শুটিংও পড়েছে করোনার কোপে। ছবির শুটিং শুরুর কথা ছিল ২৮ মার্চ।
সুপারহিরো তত্ত্ব ধরাশায়ী
২০১৯ সালে ‘অ্যাভেঞ্জারস: এন্ডগেম’ এর দুর্দমনীয় সাফল্যের পর ‘স্পাইডারম্যান: ফার ফ্রম হোম’ ও জানান দিয়েছিল বিশ্বজুড়ে ‘সুপারহিরো’র চাহিদা উঠতির দিকেই। মারভেলও ঝুলি ভরে প্রজেক্ট নিয়েছিল।
করোনার কবলে সেই সুপারহিরোরাও ভূপাতিত। ‘ব্ল্যাক উইডো’ মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল এই পহেলা মে তেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় তা পিছিয়ে নেয়া হয়েছে ৬ নভেম্বর। মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের বেলায় সম্ভবত এটাই দীর্ঘতম বিরতি হতে চলেছে। এর আগে ‘দ্য ইনক্রেডিবল হাল্কে’র দুবছর বাদে ‘আয়রন ম্যান ২’ মুক্তি পেয়েছিল।
৯/১১ এর বিপর্যয়ের পর এই ধারণাকে পুঁজি করেই মারভেলের সুপারহিরোরা স্ব স্ব স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। জঙ্গি গোষ্ঠী ও অ্যালিয়েনদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল আয়রন ম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ক্যাপ্টেন মারভেল সহ অন্যেরা। এই ১১ বছরে শুধু মারভেল সিনেমটিক ইউনিভার্সই আয় করেছে ২২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পিছিয়ে ছিল না ডিসিও। ব্যাটম্যান, সুইসাইড স্কোয়াড, ওয়ান্ডার ওম্যানের সুখ্যাতিতে তাদের ব্যবসাও ছিল উঠতির দিকে। তবে বর্তমান করোনা পরিস্থিতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ব্র্যান্ড ইমেজেও ঘাটতি দেখা দেবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কাল্পনিক শত্রুর চাইতে যে বাস্তবিক ভাইরাসই মানবজাতির জন্য আশংকাজনক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাই যে সুপারহিরোর মর্যাদার যোগ্য- এই ধারণাই ভাবাচ্ছে লোককে।
বলিউডে লোকসানের দামামা
বলিউডের খাতা মাত্র খুলেছিল। ‘ছাপাক’, ‘থাপ্পাড়’, ‘পাঙ্গা’র মতো নারী প্রধান ছবি ছিল আলোচনায়। তবে ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য রোহিত শেঠির ‘সূর্যভানসি’-কেই আরাধ্য ধরেছিল এই ইন্ডাস্ট্রি। ২৪ মার্চ মুক্তির প্রতীক্ষায় থাকাকালেই ভারতে জারি হলো ২১ দিনের লকডাউন।
অন্যদিকে ভারতীয় কিংবদন্তী ক্রিকেটার কপিল দেবকে নিয়েও কবির খান নির্মাণ করেছিলেন ‘৮৩’। ১০ এপ্রিল মুক্তির কথা থাকলেও রণবীর সিং-দীপিকা পাড়ুকোনের এই ছবির ভবিষ্যৎ আটকে গেছে। এ প্রসঙ্গে পরিচালক বলেন, ‘ছবি পেছানোটা দুঃখজনক। অনেক লোকসান গুনতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সামলানো তার চেয়ে বেশি জরুরী।‘
রাজনীতিক ও অভিনেত্রী জয়ললিতার বায়োপিক ‘থালাইভি’র শুটিং এ ব্যস্ত ছিলেন কঙ্গনা রানাউত। তামিলনাড়ুতে টানা ৪৫ দিনের কাজ থাকলেও করোনার প্রভাবে মুম্বাইয়ে কাটছে তাঁর সময়।
অদৃশ্য জুজুর প্রভাবে সারাবিশ্বই এখন নাকাল। বিপর্যয় পরবর্তী মন্দা ও অনাস্থা নিয়ে এখনই জল্পনা কল্পনা চলছে। বিনোদনের বৃহৎ মাধ্যম চলচ্চিত্র শিল্পে ধস নামা যে অবশ্যম্ভাবী তা সাধারণ মাত্রই জানে। এখন দেখার বিষয়, দুর্যোগ শেষে সেলুলয়েডের নতুন রূপটা কীভাবে নেয় দর্শক।
লেখক- সারাহ তামান্না