Site icon Bangla Info Tube

করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক ধাক্কা কীভাবে সামলাবে চীন?

Investors look at a screen showing stock market movements at a securities company in Hangzhou in China's eastern Zhejiang province on February 3, 2020. - Chinese stocks crashed on February 3 with some major shares quickly falling by the maximum daily limit as the country's investors got their first chance in more than a week to react to the spiralling coronavirus outbreak. (Photo by STR / AFP) / China OUT (Photo by STR/AFP via Getty Images)

Reading Time: 3 minutes

“আমরা আপনাকে চাকরি থেকে বের করে দিচ্ছি না, তবে আমরা আপনাকে বেতনও দিতে পারব না”  

হ্যাঁ! বর্তমানে চায়নার প্রায় ২০০ লোকবল সমৃদ্ধ একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা তার কোম্পানির বেশ কয়েকজন বেতন ভুক্ত কর্মচারীদের ঠিক এমন কথাই বলেছেন। উল্লেখ্য যে, উক্ত কোম্পানিটি চায়নায় বেশ কিছু জনপ্রিয় অ্যাপস তৈরি করেছিল। আমরা হয়তোবা শুধুমাত্র একটি কোম্পানির কথাই বলছি, তবে বর্তমান চায়নার বেশীরভাগ কোম্পানির প্রতিচ্ছবি ঠিক যেন একই রকম। অর্থনৈতিকভাবে হতাশাজনক এই সময়ে চায়না সরকার কোম্পানিদেরকে উৎসাহ দিয়ে চলছে, যাতে করে তারা কর্মচারীদের ছাঁটাই না করে দেয়।

গুয়াংজোতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য চায়না সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোর কারণে বেশ কিছু কোম্পানির মাসিক আয়ের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে ১০ শতাংশের মতো কমে গিয়েছে। এমতাবস্থায় বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাদের বক্তব্য প্রায় একই রকম, তাদের মতে বর্তমানে যেভাবে চাকরির ছাঁটাই প্রসঙ্গে আলাপ আলোচনা চলছে, এর দায়ভার কোন কোম্পানিকে দেয়া যাবে না। এর পাশাপাশি অনেক কোম্পানির অবস্থা এমনও হয়ে যাচ্ছে যে, তারা লোকজনকে ছাঁটাই করতে চাচ্ছে না আবার তাদের বেতনও প্রদান করতে অপারগ!

কম্যুনিস্ট পার্টি চালিত চায়না সরকারের প্রধান উদ্বেগ হল, বেকারত্বের হার যদি আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পায়, তাহলে এইসব অসন্তুষ্ট শ্রমিকরা চাকরীচ্যুত হওয়ার কারণে আন্দোলন শুরু করে দিতে পারে। চায়না বিগত ৩০ বছর ধরে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছিল তার উপর এমন কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বেশ জোরালো আঘাত হানবে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

১৯৯০ দশকের প্রায় শেষের দিকে প্রিমিয়ার জু রঙজি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলির (এসওই) উপর ব্যাপক সংস্কার চালিয়েছিলেন। যার ফলাফলস্বরূপ তৎকালীন সময়ে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ চাকরীচ্যুত হয়েছিলেন। আর এই চাকরি হারা শ্রমিকেরা তখন দেশজুড়ে ব্যাপক এক আন্দোলন শুরু করেছিলেন।

বর্তমানে কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ হল এই ছাঁটাই প্রক্রিয়া চীনের জনগণের মধ্যে অসন্তোষকে আরো জোরালো করে তুলতে পারে। কেননা ইতোমধ্যেই চায়নার সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ তীব্র গুঞ্জন উঠছে যে, সরকার হয়তো ভাইরাসের প্রভাব এবং সংক্রমণের পরিসংখ্যানকে কারসাজীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছে।

একটি পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে চায়নায় নাগরিক বেকারত্বের হার বিগত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ৬.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। হংকংয়ের আইএনজি ব্যাংক এনভি-র প্রধান অর্থনীতিবিদ আইরিস পাং আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, ২০২০ সালে যেহেতু রেকর্ড সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক বের হয়েছে, তারা যখন কর্মসংস্থানে যোগ দেয়া শুরু করবে তখন এই হার প্রায় ১০ শতাংশ অথবা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে এবং ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট সহ পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক ধাক্কার সময় চায়না সরকার জনসাধারণের কাজে বিনিয়োগ বাড়িয়ে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোকে ছাঁটাই হতে বিরত থাকতে এবং ব্যাংকগুলোকে বেশি করে ঋণ প্রদানের নির্দেশ দিয়ে তৎকালীন বেকারত্বের হাত বৃদ্ধি খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিল। এমনকি বিগত বছর তারা আমেরিকার সাথে অঘোষিত এক বাণিজ্যিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েও নিজেদের বেকারত্বের হারকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল।

তবে এবার বিগত অবস্থাগুলো থেকেও হয়ত খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। চীনের বিভিন্ন শহরগুলো লক ডাউন, ভ্রমণ নিষিদ্ধকরণ এবং ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নেয়া অন্যান্য পদক্ষেপগুলো চীনের অর্থনীতির বহমান ধারাকে অনেকাংশেই বন্ধ করে দিয়েছে।

এমতাবস্থায়, চীনের প্রথম পদক্ষেপ হল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরায় নিজস্ব অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর তাই সরকার সুদের হারকে কমিয়ে এনেছে, ঋণ প্রদান বৃদ্ধি করেছে এবং কোম্পানিগুলোর থেমে থাকা কার্যক্রম পুনরায় চালু করার জন্য বিভিন্ন অনুমোদন প্রদানের গতি বৃদ্ধি করেছে।

তবুও বেশীরভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য হল তারা আসন্ন সময়ের বেতন প্রদান করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের যোগান পাচ্ছে না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগগুলোর উপর করা চীনের মার্চেন্টস ব্যাংকের একটি জরিপে উঠে এসেছে যে, প্রায় বিশ হাজারেরও বেশি উদ্যোগ নগদ অর্থ মজুদের অভাবের কারণে বন্ধ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যেই রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের অর্ডার কমে আসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে বেশীরভাগ কোম্পানিগুলো হয়তো খুব দ্রুত কর্মচারীদের ছাঁটাই প্রক্রিয়া শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবুও উত্তর-পূর্বের হিলংজিয়াং প্রদেশের মতো জায়গায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোকে ছাঁটাই সীমাবদ্ধ রাখার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে চীনের বেশ কিছু প্রদেশে “সোশ্যাল সিকিউরিটি পেমেন্ট” জনগণকে ফেরত দেয়া হচ্ছে, যাতে করে তারা অর্থনৈতিক ভাবে সচল থাকতে পারে।

চীনে বিগত অনেক বছর ধরেই ধীরে ধীরে রাষ্ট্র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মসংস্থানের অবস্থা সংকুচিত হচ্ছে, অর্থাৎ বলা চলে যে দেশের কর্মজীবীদের একটি বড় অংশ বেসরকারি খাতে নিযুক্ত রয়েছে। ভাইস প্রিমিয়ার লিউ হি এর মতে, বেসরকারি সংস্থাগুলি নগর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অবদান রাখে। তবে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাঁটাই না করে কর্মচারীদের বেকার বসিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তেমন একটা ইচ্ছুক নয়।

এদিকে ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশায় ভোগা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষার্থীরা টুইটারের মতো আরেকটি সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেদের হতাশা ব্যক্ত করছে। বর্তমানে প্রায়শই একটি গুঞ্জন উঠছে যে, “স্নাতক পাশ করেছেন তো বেকার হয়েছে”। অর্থাৎ স্নাতক পাশ করার পর শিক্ষার্থীরা কর্মসংস্থান পাচ্ছে না। যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়তই নতুন স্নাতক পাশ করা শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান তৈরি করার ব্যাপারে সদা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

কিন্তু সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় এক তৃতীয়াংশ কোম্পানি নতুন করে আর কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে। একটি জরিপে উঠে এসেছে, প্রায় নয় হাজার কোম্পানির মধ্যে কেবল মাত্র ২০ শতাংশ কোম্পানি আগের মতই কর্মচারী নিয়োগ করে যাচ্ছে, আর বাকি ৩৭ শতাংশ এখন দ্বিধায় ভুগছে।

তবে দেশের সার্বিক অর্থনীতি যদি খুব সহসাই পূর্বের অবস্থানে ফেরত যায়, তবুও আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মালিকেরা তাদের কোম্পানিগুলোর কোন সহসা উন্নতি আশা করছে না।

 লেখক- ইকবাল মাহমুদ ইকু 

Exit mobile version