ঘটনার শুরু ২০১৪ সালে। রাজধানীর হাজারীবাগ থানা এলাকার বাসিন্দা আজম তার ছেলে আবু সাঈদকে দুই দিন ধরে খুঁজে না পেয়ে অত্র এলাকায় মাইকিং করার পাশাপাশি হাজারীবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। আজম জানায়, সাঈদ হাজারীবাগের বড় মসজিদ মাতৃপিঠ স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে আর বাসায় ফেরেনি। ঘটনার ২০-১৫ দিন পর ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে তার কাছে ফোন আসে।
এরপর ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল আজম অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হাজারীবাগ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপহরণ মামলা করেন। হাজারীবাগ থানা পুলিশ অপরহণ মামলাটি তদন্ত করে ২০১৪ সালের ২২ জুলাই আজগর আলী ও মিলন নামের দুই আসামীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার আদালতে হাজির করে। পরে এই মামলাটির দায়িত্ব পান ডিবির উপপরিদর্শক রুহুল আমিন। তিনি বরিশালের সোনিয়া আক্তার, সোনিয়া আক্তারের ভাই আফজাল হোসেন, ভগ্নিপতি শাহীন ও প্রতিবেশী সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেন।
২০১৫ সালের ১৫ জুন তদন্ত কর্মকর্তা রুহুল আমিন তাদের ৪জনের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় আদালতে একটি অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল কিশোর আবু সাঈদকে এমভি নামের একটি লঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হয়। এরপর আফজাল সাঈদকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আফজালের সাথে সাইফুলও হত্যার কথা স্বীকার করেন।
চার বছর ধরে চলা এই মামলার বিচার কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ মোট নয় জন আদালতে সাক্ষ্য দেন। এমনকি আদালত দুই দফা এই রায়ের জন্য দিন ধার্য করেছিলেন। কিন্তু এমন সময়ে এসে জানা গেল আবু সাঈদ বেঁচে আছে।
এই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আফজাল হোসেন গত ২৯ আগস্ট রাজধানীর পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি(জিডি) করলে মামলার জট খুলতে থাকে। আফজাল জিডিতে বলেন, আবু সাঈদ নামের যে ছেলেটিকে হত্যা করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে, সে বেঁচে আছে। আবু সাঈদ তার বাবা আজমকে নিয়ে অবস্থান করছেন বিহঙ্গ পরিবহণের মালিক নাসির উদ্দিন খোকনের বাসায়।
পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেয়া নাসির উদ্দিন খোকনের বক্তব্য থেকে জানা যায়, এই মামলার আসামিরা বরিশালে তার এলাকার লোক। এই মিথ্যা মামলার ব্যাপারে আসামিদের থেকে সব শুনে এই মামলার খোঁজ খবর তিনি নিয়মিতই রাখছিলেন। দুই বছর আগে সাঈদের বাবা আজম খলিল নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে আসামিপক্ষের কাছে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে আপস করার প্রস্তাব দেন। শেষ পর্যন্ত নাসির উদ্দিনের থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে আজম আপস করার আশ্বাস দেন। এরমধ্যে দীর্ঘ বিরতির পর এই হত্যা মামলার পরবর্তী শুনানি ৫ সেপ্টেম্বর এগিয়ে আসলে নাসির উদ্দিন নিজে থেকে আজমের সাথে যোগাযোগ করেন। আবার নগদ অর্থকড়ি ও পান দোকান করে দেয়ার লোভ দেখিয়ে তিনি আজমকে অনুরোধ করেন ৫ সেপ্টেম্বর আদালতে গিয়ে কিছু একটা বলতে যেন আসামীদের শাস্তি একটু কম হয়। এর কিছু দিন পরে আজম নিজে থেকে নাসির উদ্দিনকে ফোন দিয়ে তার ছেলে সাঈদের ফিরে আসার কথা জানান। নাসির উদ্দিন কিছু লোভ দেখিয়ে ছেলেসহ আজমকে তার বাসায় আসতে বলেন। গত ২৯ আগস্ট আজম ছেলেসহ নাসির উদ্দিনের বাসায় আসলে নাসির পল্লবী থানার ওসিকে ফোন করে খবর দেন। পরে সেখান থেকে আবু সাঈদসহ তাঁর মা–বাবাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পল্লবী থানার পুলিশ।
চার আসামির একজন সোনিয়া পরেন দিন ৩০ আগস্ট তাঁর সাবেক স্বামী মিরাজ হোসেনকে এক নম্বর আসামি করে সাঈদের মা-বাবাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ থানায় প্রতারণার মামলা করেছেন। এই ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যেখানে কোন রকম হত্যাই হয়নি সেখানে কিভাবে ডিবি উপপরিদর্শক রুহুল আমিন হত্যার অভিযোগে ৩০২ ধারায় আলাদলতে অভিযোগপত্র দিলেন?
কথিত এই হত্যা মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেয়া দুই আসামি সাইফুল ও আফজাল বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে, ডিবি অফিসে এসআই রুহুল আমিন তাদের ওপর কি ভয়াবহ অত্যাচার ও নির্যাতন করেছিল তার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। সাইফুল জানান, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেছিলেন, সাঈদকে খুন করার কথা স্বীকার না করলে তাঁকে খুন করে ফেলা হবে। মৃত্যুভয়ে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। নির্যাতন থেকে বাদ পরেনি সোনিয়া, এমনকি তার বাবাও। সোনিয়া জানান ৯ দিন তাদের ডিবি অফিসে নির্যাতন করে মিথ্যা বলতে বাধ্য করা হয়।
কিন্তু এসআই রুহুল আমিন নির্যাতনের সব অভিযোগ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, তাদের কোন ধরণের নির্যাতন করা হয়নি। সোনিয়া, আফজাল ও সাইফুল স্বেচ্ছায় আদালতে স্বীকার করেছিলেন যে তারা সাঈদকে লঞ্চ থেকে ফেলে হত্যা করেছেন।
কে সত্য বলছে আর কে মিথ্যা বলছে এটা নিশ্চয়ই একজন পাগলও বুঝবে। এখন পর্যন্ত এই মিথ্যা মামলায় আফজাল ৩৩ মাস, সাইফুল ২৪ মাস এবং সোনিয়া ৬ মাস কারাভোগ করেছেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী ৫ সেপ্টেম্বর আদালতকে জানান, এই অপহরণ ও খুনের ঘটনা সাজানোর মূলে আছেন সোনিয়া আক্তারের স্বামী মিরাজ হোসেন। মিরাজ হোসেন আবু সাঈদের বাবা আজমের আত্মীয়। পুলিশ সোনিয়াদের ডিবি অফিসে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে।