ওইজা বোর্ডে কি সত্যিই আত্মা আসে?1 min read
Reading Time: 4 minutesহুমায়ূন আহমেদের ‘ওইজা বোর্ড’ নাটকের কথা মনে আছে? কিশোরী শিলা আহমেদ প্রতি রাতে স্রেফ কৌতূহলের বশের ওইজা বোর্ড নিয়ে বসতো। ক্রমে সেই কৌতূহলই প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। সত্যি সত্যিই এক আত্মা এসে ঘাটি বাঁধে বাড়িতে।
প্ল্যানচেটের প্রণালী সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন। কাঠের তৈরি একটি বোর্ডের দুই দিকে লেখা থাকে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। এছাড়াও ইংরেজি বর্ণমালার ২৬টি অক্ষর থাকে এতে। দল বেঁধে বা একান্তভাবে এই বোর্ডকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কোন মৃতের আত্মাকে ডাকা হয়। কোনো একজনের উপর আত্মা ভর করলে সেই ব্যক্তির হাত বোর্ডের উপর চলতে থাকে। দলের বাকিরা প্রশ্ন করলে সে বোর্ডের অক্ষরগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে উত্তর দিতে থাকে।
ওইজা চর্চার শুরু
১৯ শতক থেকেই ইউরোপ ও আমেরিকায় ক্রমে আধ্যাত্মিকতা বাড়তে থাকে। ১৮৩৭–১৯০১ অর্থাৎ ভিক্টোরিয়ান সময়কাল ছিল এই আত্মা অনুসন্ধান ও অলীক বিশ্বাসের ভিত। মৃত ব্যক্তির আত্মার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব– এই আত্মিকবাদের গোড়াপত্তন করে মূলত আমেরিকানরাই।
এর মাঝে ১৮৬২ সালে ঘটে যাওয়া ভয়ানক গৃহযুদ্ধের আবেগ কাজে লাগে এতে। অসংখ্য তরুণ সৈনিক মারা গেলে তাঁদের পিতা মাতা প্রমুখের আবেগকে পুঁজি করে বাজারে আসে ওইজা বোর্ড। যদিও প্রথম কে এটা আবিষ্কার করে তার স্পষ্ট কোন উত্তর নেই। ১৮৪৮ সালে আমেরিকার বসবাস করা দুই বোন জানায় ,কাঠের দেয়ালের মধ্য দিয়ে মৃতেরা তাদের বার্তা পাঠায়। এই গুজবের ভিত্তিতেই তৈরি হয় ওইজা বোর্ড।
কেনার্ড নভেলটি কোম্পানিই প্রথম ওইজাকে বাজারজাত করেন। তবে এর পেছনে এর মালিক চার্লস কেনার্ডের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রও ছিল। যেই ব্যক্তিটি প্রথম ওইজা বোর্ড তৈরি করেন এবং এর দেখাশোনা করতেন তাঁকে অন্যায়ভাবে কোম্পানি থেকে বাদ দেন কেনার্ড। শেষমেশ সত্ত্ব বেচে সমস্ত অর্থই পকেটে পুরেন তিনি। আমেরিকান ব্যবসায়ী ও আবিষ্কারক উইলিয়াম ফুল্ড ১৮৯২ সালে কেনার্ডের কোম্পানি কিনে নাম দেন ‘ওইজা নভেলটি কোম্পানি’।
নামকরণের সূত্র
অনেকেই মনে করেন, ফ্রেঞ্চ oui এবং জার্মান ja –এই দুই শব্দের সমন্বয়ে উৎপত্তি হয়েছে ওইজা শব্দটি। এই দুই শব্দের অর্থই কিন্তু ‘হ্যাঁ’। বিখ্যাত ‘ওইজা বোর্ড’ বিশেষজ্ঞ এবং ইতিহাসবিদ রবার্ট মার্চ তা নাকচ করে দেন।
মূলত এই বোর্ড ব্যবসার বিনিয়োগকারী এলিজাহ বন্ড, কেনার্ড ও হেলেন পিটারস তিনজন মিলে যখন নয়া এই বোর্ডের নাম দিয়ে উঠতে পারছিলেন না, তখন নাকি এই বোর্ডই তাদের বুদ্ধি দেয় ওইজা নামের। মিশরীয় ভাষার এই শব্দের অর্থ ‘Good Luck’ বা ‘শুভ কামনা’।
অদ্ভুতুড়ে যত কান্ড
তখন ১৯১৩ সাল। ব্রিটিশ গৃহিণী পার্ল কুরান মোটামুটি তাক লাগিয়ে দেন সকলকে। ১৯১৩–১৭ এই পাঁচ বছরে চার মিলিয়ন শব্দের সাহিত্য রচনা করেন তিনি। সাত খানা বই, অজস্র কবিতা, ছোটগল্প আর নাটক লিখে ফেলেন এই নারী।অথচ তাঁর শিক্ষা ছিল সামান্যই। বহুবিধ বিষয়ে জ্ঞান, অভিনব লেখনী, উঁচুদরের সাহিত্যিক ভাষা– সবই অবাক করে তৎকালীন পণ্ডিতদের। কিন্তু এর পেছনে ছিল অন্য রহস্য। কুরান দাবি করেন, এই ওইজা বোর্ডের মাধ্যমে তাঁর সাথে ষোল শতকের এক লেখকের ভাব আদানপ্রদানেরই ফসল এই সাহিত্যকর্ম। সেই সাহিত্যিক আমেরিকায় এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। কিন্তু এক দাঙ্গায় নিহত হন তিনি। কুরান সেই লেখকের নাম দেন ‘পেশেন্ট ওর্থ’। কুরানের সাথে নাকি সেই আত্মা বেশ অনেক স্থানে ঘুরেও বেড়িয়েছে! সত্যি হোক অথবা মিথ্যে– কুরানের হাত দিয়ে পেশেন্স যা লিখে গেছেন সেসব সত্যিই অনন্য।
সাহিত্যকেন্দ্রিক আরও ঘটনা আছে এর সাথে। ১৯৭৬ সালে আমেরিকার অন্যতম আধুনিক কবি জেমস মেরিল ৫৬০ পৃষ্ঠার অনন্য কবিতা ‘The Changing Light at Sandover’ প্রকাশ করেন। এই কবিতার মূল বস্তু ছিল ওইজা বোর্ডের রোমান বিচারালয়ের কর্মী এফ্রেইমের সাথে আলাপন। নিউক্লিয়ার যুদ্ধ, মানবিক বিপর্যয় নানান বিষয় উঠে আসে এতে। ১৯৮৩ সালে মেরিলের এই কবিতা ‘ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল এ্যাওয়ার্ড’ পায়।
২০১৪ সালে তিন আমেরিকান তরুণ দাবি করে, ওইজা বোর্ড ব্যবহারের পর থেকে তারা ক্রমাগত বিষণ্ণতা, অসুস্থতা ও হ্যালুসিনেশনের শিকার হচ্ছে। তারা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত ছিল যে প্রথামিকভাবে হাসপাতালে নেয়াই অসম্ভব মনে হচ্ছিল। ২০১৫ সালেও পেরুর এক তরুণী দাবি করে, স্মার্টফোনের ওইজা বোর্ড এপ ব্যবহারের পর থেকে তার ভেতরে বাসা বেধেছে আত্মা। চিকিৎসকেরা জানান, একেক সময় তরুণীর কণ্ঠস্বর বদলে যেতো, গায়ে ভর করতো অসীম শক্তি, মুখ দিয়ে ক্রমাগত লালা ঝরত। তবে পরবর্তীতে তরুণী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
পরিক্রমায় বদল
ওইজা বোর্ডকে বেশ সমীহের চোখেই দেখতো লোকে। তবে ১৯৭৩ সালে ‘ দ্য এক্সরসিস্ট’ ছবিটি মুক্তির পরেই বদলে যায় দৃষ্টিভঙ্গি। ওইজা বোর্ডের সাথে শয়তানের যোগাযোগ আছে– এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে।
তবে এর আগে একেবারে ভিন্নভাবে দেখা হতো একে। ‘আই লাভ লুসি’ নামক এক টেলিভিশন শোতে এর উপস্থাপন ছিল হাস্যরস যুক্ত। এছাড়াও পারিবারিক খেলার দারুণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
সত্য তবে কী?
মনোবিদদের মতে, ওইজা স্রেফ মানসিক বিনোদনের অংশ। সাইকোলজি টুডে তাদের গবেষণা থেকে জানায়, যেসব তরুণেরা ওইজার সাথে ক্ষতিকর কিছুর সংযুক্তি পেয়েছেন সেটা সম্পূর্ণই সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, বিষণ্ণতা ও পারিপার্শ্বিক চাপের ফল। আদতে এই বোর্ড শুধু কয়েক ধাপ কাঠ আর কালির খেলনা।
তবে লোকের বিশ্বাসের সাথে কৌশলও যুক্ত আছে। ভাবুন, দশজন লোক যদি কোন ভুল তথ্যকেও সত্যি হিসেবে দাবি করে; তখন আপনি একলাও হয়তো সেটাকেই মেনে নিতে বাধ্য হবেন। ওইজাতে এই বুদ্ধিই থাকে আসলে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস ফ্রেঞ্চ বলেন, ‘ ওইজা টেবিলে যদি ৫ জন থাকে, আপনি প্রত্যেকের অঙ্গভঙ্গি গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই বুঝবেন এদের যেকোনো একজন প্ল্যানচেট চালাচ্ছে। কোন আত্মা নয়।‘ আরথাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরাও জানান একই কথা। ‘ ধরুন, একজন ওইজা বোর্ড নিয়ে বসে আছেন। এখন তাকে যদি একটি শব্দের বানান জিজ্ঞেস করেন দেখবেন অন্য দিকে তাকিয়েও সে বোর্ডে হাত নেড়েই চলেছে।আরও ভালোমতো খেয়াল করুন, সে ওই শব্দটাই লিখছে বোর্ডে।‘
প্ল্যানচেটে সত্যিই আত্মা আসে কিনা এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে এর জনপ্রিয়তা আজও অটুট। বন্ধুর দলে একবার হলেও প্ল্যানচেটের আসর বসে, ভৌতিক অথবা মজাদার অভিজ্ঞতাও হয় অনেকের। আপনারও আছে নাকি এমন কোন অভিজ্ঞতা?