সব দেশেই সৈনিকদের কিছু বিশেষ অভিজাত ইউনিট থাকে যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রশিক্ষিত থাকে। অনেকসময় অনেক দক্ষ সৈনিকের পক্ষেও এসব প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাদেরকে শাস্তি ও অত্যাচার সহ্য করা এবং ঠেকানোর কৌশলও রপ্ত করানো হয়। তাদের জীবনযাপন সাধারণ সৈনিকের চেয়ে ভিন্ন হয়। আমরা সাধারণ মানুষ তাদের দেখা পাই না কেননা তারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে চলাফেরা করে। অধিকাংশ সময় তারা লোকচক্ষুর আড়ালে কাজ করে, প্রয়োজন হলে মিশনে নামে। এই আলোচনায় বিশ্বের তেমনি কিছু বিখ্যাত সোলজার ইউনিটের কথা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
এসএসজি
এটি পাকিস্তানভিত্তিক একটি স্পেশাল ফোর্স। পুরো নাম স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ। এসএসজি পাকিস্তানে ‘ব্ল্যাক স্টোর্ক’ নামে পরিচিত। ১৯৫৬ সালে এটি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন ধরণের দ্বন্দ্ব সংঘাতে এসএসজি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সহায়তা করে। পাশাপাশি সন্ত্রাসী হামলায় দেশকে নিরাপদ রাখতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। ফিট থাকার জন্য তাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এই অভিজাত গ্রুপের সদস্য হতে চাইলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে ২ বছরের কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তার সাথে ৯ মাসের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হবে। সবচেয়ে যেটা জরুরি তা হলো, টানা ২৪ ঘন্টায় ৩৬ মাইল (৫৭.৯ কি.মি.) মার্চ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। এসএসজি পাকিস্তান সীমান্তে খুব সজাগ। যেমন তাদের অভিজাত পেশা তেমনি জীবনঝুঁকিও অন্যান্য যেকোন ইউনিটের চেয়ে বেশি।
জিএসজি ৯
জার্মানের এক বিশেষ ধরণের ইউনিট এই জিএসজি ৯। এটি জার্মান পুলিশের একটি স্পেশাল বাহিনী। তাই সীমান্তরক্ষার কাজে না গিয়ে তারা বরং পুলিশি কাজে সহায়তা করে। সন্ত্রাসবাদ, ছিনতাই প্রভৃতি দমনে পুলিশকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে তারা। সর্বশেষ তাদের মিশন ছিল ২০১৬ সালে, মিউনিখ শহরে। তারা খুব পরিশ্রমের প্রশিক্ষণ না নিলেও স্পেশাল বাহিনী হিসেবে তাদেরকে বেশ দক্ষ হতে হয়।
মারকোস-ইন্ডিয়া
ভারতের মেরিন কমান্ডো ফোর্স হলো মারকোস-ইন্ডিয়া। তাদের প্রতিপাদ্য— “স্বল্প হলেও নির্ভীক”। তারা জলসীমার মধ্যে ঘটে যাওয়া যে কোন অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়। তাদের ২-৩ বছরের একটা খুবই কঠিন ট্রেনিং পিরিয়ড থাকে। এই ট্রেনিং এ অধিকাংশ সময় ৮০% সদস্যই ঝরে পড়ে। এ প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকে কম সময়ে লং মার্চ, অনিদ্রা প্রশিক্ষণ, অস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রভৃতি। তারা এই প্রশিক্ষণের নাম দিয়েছে ” ৫ সপ্তাহের নরক”। যারা প্রথম ধাপ পাশ করে তাদের নিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপ— প্যারাসুট ও ডুব প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণের জন্য মারকোস সদস্যরা বিভিন্ন জঙ্গল ও পর্বতে দিনাতিপাত করে।
ডেল্টা ফোর্স
এটি ইউএসভিত্তিক একটি স্পেশাল ফোর্স। তারা বেশিরভাগ সময় জিম্মি মুক্তি ও সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে কাজ করে। এটি মূলত ১৯৭০ সালে একটা সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। খুব ছোট পরিসরে তৈরি করা হয়েছে ডেল্টা ফোর্সকে। মাত্র ১০০০ সৈনিক নিয়ে তৈরি এ ফোর্সের ৩০০ জন সৈন্য সরাসরি আক্রমণের প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। যথেষ্ট অভিজ্ঞ সামরিক সেনাকে ডেল্টা ফোর্সে নেওয়া হয়। যেহেতু এটা খুব গোপনীয় একটি ইউনিট তাই নিয়োগপ্রাপ্তদেরকেও অনেক গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখানে যোগ দেওয়ার জন্য কিছু শারীরিক পরীক্ষা নিরিক্ষা করা হয়। এরপর আরও কিছু ধাপ যেমন— ১৮ কেজি ভার নিয়ে পর্বতারোহণ করা, ২ মাইল (৩.২ কি.মি.) দৌড়ানো, পুরোপুরি কাপড়চোপড় পরে ১০০ মিটার সাঁতার কাটা ইত্যাদি সম্পন্ন করতে হয়।
আলফা গ্রুপ
আলফা গ্রুপকে রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ফোর্স হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেজিবি ১৯৭৪ সালে একে প্রতিষ্ঠা করে। এটি পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও সাহায্য করে। আলফা গ্রুপ দেশ ও দেশের বাইরে সন্ত্রাসবাদ, জিম্মি উদ্ধার, গুপ্ত অপারেশন প্রভৃতি কাজ সফলতার সাথে সম্পন্ন করে।
আলফা গ্রুপের সদস্যদের নিয়োগের শুরুতে ৩ বছরের প্রশিক্ষণ দিতে হয় এবং বয়স অবশ্যই ২২ থেকে ২৭ এর মধ্যে হতে হয়। কর্তৃপক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে যারা বেশি স্মার্ট তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। সবচেয়ে স্মার্ট সেনাসদস্যরাই এখানে কাজের সুযোগ পেয়ে থাকে। আলফা গ্রুপের সদস্যদের কমপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হতে হয়। শুরুতেই আলফা সদস্যদের কতগুলো শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। এরপর ডুব পরীক্ষা, বন্দুক যুদ্ধ, প্যারাসুটিং এবং মার্শাল আর্ট ইত্যাদি টেস্ট করা হয়।
এসবিএস- ইউকে
এসবিএস হলো যুক্তরাজ্যের একটি বিশেষ ধরনের নৌ বাহিনী। এটা এসএএস এর নৌ ভার্সন। দ্বিতীয় বিশযুদ্ধের সময় এটি খুব গোপনীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এরা প্রায়ই ছদ্মবেশে কাজ করে। এর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি অনেকটা এসএএস এর মতই তবে এক্ষেত্রে পানিতে কাজ করার সামর্থ্য থাকতে হবে। যুক্তরাজ্যের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যায় এসবিএস নিজেদেরকে বেশি দক্ষ মনে করে। কারণ সাগরের পরিবেশ স্থলভাগের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং।
সাইয়েরাত মাটকাল
ইসরায়েলের এ সংঘটনের আরেক নাম জেনারেল স্টাফ রিকনাসেন্স ইউনিট ২৬৯। এটি এসএএস এর মতো বেশির ভাগ সময়ই শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য রাখে। তাদের প্রতিপাদ্য হলো, “যার সাহস আছে সে জয়ী”। ১৯৫০ সালে খুবই কম সংখ্যক সদস্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল এ ইউনিট। সাইয়েরাত মাটকাল এর সদস্যরা শুধু শারীরিকভাবেই শক্তিশালী নয়, অন্য সৈনিকদের চেয়ে তাদের আলাদা কিছু অতি মানবীয় বৈশিষ্ট্যও থাকে। এর রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্পে যাওয়া মানে নরকে যাওয়া। প্রার্থীদের খুব নিবিরভাবে শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। ঘুমকে প্রায় হারাম করতে হয়। যদি তারা প্রথম ধাপ অতিক্রম করতে পারে তাহলে তাদেরকে দ্বিতীয় ধাপে ২ বছরের ট্রেনিং দেওয়া হয়। এসময় প্রার্থীদেরকে ছোট বড় আর্মস প্রশিক্ষণ, নেভিগেশন, মার্শাল আর্ট এবং ৭৫ মাইল (১২০ কি.মি.) এর জটিল লং মার্চ করানো হয়। এভাবে বিভিন্ন ট্রেনিং এর সহায়তায় তাদের আস্তে আস্তে পাকাপুক্ত করা হয়।
ইউএস নেভি সিলস
এই ইউনিটে খুব কম সংখ্যক মানুষই চান্স পায়। নিয়োগের সময় পুলে কি হয় তা কেউ আগে থেকে অনুমানও করতে পারে না। গত কয়েক বছর আগে ট্রেনিং এর সময় প্রার্থীর প্রাণ হারানোর মতো ঘটনাও ঘটে। ২০১৩-১৬ সালের মধ্যে ৯ জন প্রশিক্ষণার্থীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও বেশি। প্রশিক্ষণের সময় কারোর মৃত্যু হয়েছে আবার কেউ কেউ প্রশিক্ষণের চাপে মারা যায়। প্রশিক্ষণের একটি অংশ আছে যেখানে বেশির ভাগ মানুষ প্রাণ হারায়, কেননা সেখানে সরাসরি বন্দুক যুদ্ধ হয়।
ব্রিটিশ এসএএস
এসএএস ইউএস নেভি সিলস এর চেয়েও একধাপ এগিয়ে। এসএএস এর প্রশিক্ষণার্থীরা মৃত্যুর সাথে প্রতিটা ধাপে পাঞ্জা লড়ে। এদেরকে মানসিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী করা হয়। শারীরিক কসরতগুলো প্রায় ইউএস নেভির মতই তবে এখানে গভীর জঙ্গলে ও পর্বতারোহণে ভারী ব্যাকপ্যাক অস্ত্র বহন করতে হয়। ব্রিটিশ এসএএস এর সাইকোলজিক্যাল ট্রেনিং সবচেয়ে মারাত্মক। প্রশিক্ষক মাথায় আঘাত করে দাঁড়াতে বলে, তখন অনেকেই উঠে দাঁড়াতে পারে না। ঘুমের কথা চিন্তাও করা যাবে না। ঘুম, খাবার এমনকি পানি ছাড়া ছোট খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয় তাদের। তাদের মূলনীতি হল, “প্রশিক্ষণে যদি বেশি ঘাম ঝরাও তাহলে যুদ্ধে কম রক্ত ঝরবে”। এসএএস একই সাথে এমআই ৫ ও এমআই ৬ এর সাথে কাজ করে ফলে তারা মিলিটারির পাশাপাশি গোয়েন্দা হিসেবেও দক্ষতা অর্জন করে।