এরিয়া ৫১ : রহস্যঘেরা সামরিক ঘাঁটি1 min read
Reading Time: 6 minutesমানবজাতি স্বভাবতই নিজের আত্মঃপ্রচার করতে বা প্রাধান্য দিতে পছন্দ করে। সে যে করেই হোক। মার্কিনরা এমন এক জাতি তারা চায় বিশ্বের বাকি সবাই যেন তাদের গুরুত্ব দেয়, তাদের নিয়ে চিন্তা করে। এর জন্য বহুবার তারা অনেক অদ্ভুত বা রহস্যময় কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে। ‘এরিয়া ৫১’ তেমনি এক রহস্যঘেরা নাম। এটি এমন এক জায়গা যার সম্পর্কে মানুষের কাছে সঠিক কোন ধারণা নেই। তাই একে নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহলেরও শেষ নেই।
‘এরিয়া ৫১’ কোন প্রাকৃতিক রহস্যময় স্থান নয়। এটা মানবসৃষ্ট অতি গোপনীয় একটি সামরিক ঘাঁটি। এই ঘাঁটির আসল কাজ কি তার জবাব আমেরিকান কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে কখনো ঠিকঠাক উত্তর মেলেনি।
‘এরিয়া ৫১‘ এর গোপনীয়তার কারণ
দুর্ভেদ্য বেষ্টনীতে ঘেরাও করা এলাকাটির মূল ফটকে বড় করে লেখা আছে, “সংরক্ষিত এলাকার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলেই গুলি করা হবে।” এমন কড়াকড়ি নিয়ম যেখানে আছে তাকে নিয়ে তাবৎ দুনিয়া মাতামাতি করবে তাই তো স্বাভাবিক। উৎসাহীদের মনে একই প্রশ্ন, কী আছে এর ভেতরে? কিইবা এমন কাজ এর ভেতরে করা হয় যার জন্য শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত কর্মী ছাড়া আর কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না?
এরিয়ার কর্মকর্তারা মোটামুটিভাবে এটা সম্পর্কে যা বলেছেন তা হল, ‘এরিয়া ৫১’ একটি সামরিক ঘাঁটি যেখানে পরীক্ষামূলক বিমান তৈরি, অস্ত্রের সিস্টেম পরীক্ষাকরণ এবং উন্নতি সাধন করা হয়। এটি সাধারণ বিমানঘাঁটি থেকে আলাদা। ‘এরিয়া ৫১’ এর ব্লুপ্রিন্টটি মার্কিন বিমানবাহিনীর একটি বিশাল প্রশিক্ষণকেন্দ্র। অস্থায়ীভাবে একে বলা হয় নেইলস এয়ার ফোর্স রেঞ্জ (NAFR)। ‘এরিয়া ৫১’ এর আকাশ নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত অন্য সবার জন্য নিষিদ্ধ। এ সীমা R-4808N হিসেবে পরিচিত। পাইলটরা এই আকাশসীমাকে ‘দ্য বক্স’ বা ‘দ্য কন্টেইনার’ নামে চেনে।
‘এরিয়া ৫১’ নিয়ে কিছু রহস্যময় তথ্য
কিন্তু স্থানীয় এলাকাবাসী সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য জানান। তারা বলেন, এরিয়া ৫১ এর আশেপাশে ফ্লাইং সসারের মতো কিছু উড়তে দেখেছেন তারা। অনেকেই আবার এমন দ্রুতগতির বিমান উড়তে দেখেছেন যার গতি সাধারণ কোন বিমান বা যুদ্ধবিমানের মতো নয়। এরই সাথে রহস্যকে আরও চাঙ্গা করে তুলতে এরিয়া ৫১- এ কর্মরত পদার্থবিজ্ঞানী বব লেজার এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সেখানে নাকি ‘রেটিকুলাম ৪’ নামক এক জ্যোতিষ্ক থেকে আসা এলিয়েন ও ফ্লাইং সসার রয়েছে। ভিনগ্রহের এ প্রাণীটির উচ্চতা সাড়ে ৩ ফুট, যার দেহ লোমহীন এবং চোখগুলো কালো ও স্বাভাবিক চোখের চেয়ে অনেক বড়। এলিয়েনটির দেহ ব্যবচ্ছেদ করে অন্যান্য স্বাভাবিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বদলে এক বিশাল পতঙ্গ পাওয়া গিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ঐ এলাকা থেকে বেতার তরঙ্গের সাহায্যে ভিনগ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে নাকি যোগাযোগও করা হয়েছে। এরিয়া ৫১ এ নাকি এমন কিছু মৌলিক পদার্থ নিয়ে গবেষণা করা হয় যা এখনও আবিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয় নি। তিনি আরও যোগ করেন, সুপারনোভা বা বাইনারি স্টার থেকে এমন একটি মৌলিক পদার্থ সংগ্রহ করা হয়েছে যার মাত্র ২.২ পাউন্ড দিয়ে ৪৭টি ১০ মেগাটন হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করা যাবে। সেখানে নাকি একটি টাইম মেশিন আছে। তাতে ঐ মৌলটি রাখা হলে সেটা নাকি সময়কে স্থির করে রাখতে পারে। বিজ্ঞানীরা নাকি সময় স্থির করে রাখার পরীক্ষা চালিয়ে সফলও হয়েছেন।
শুধু রহস্যের গল্পই নয়, একে নিয়ে চলমান কিছু বিতর্কও আছে। সবচেয়ে বড় বিতর্ক হলো মানুষের চাঁদে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক। অনেক সন্দেহপ্রবন লোকই মনে করে মার্কিনরা সর্বপ্রথম চাঁদে পা রাখে নি। তাদের দাবি আমেরিকা চাঁদে যাওয়ার পুরো নাটকটি সাজিয়েছে এরিয়া ৫১ এর ভিতর। তবে যা-ই হোক, পত্র-পত্রিকায় যতই মুখরোচক ও রহস্যময় খবর প্রচারিত হোক না কেন, আমেরিকা বরাবরই তা এড়িয়ে গেছে।
‘এরিয়া ৫১’ এর অবস্থান
‘এরিয়া ৫১’- এর আয়তন ২৬,০০০ বর্গকিলোমিটার। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে এবং লাস ভেগাস থেকে ১৫০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে রেকেল গ্রামের কাছে মোজাভে নামক এক মরুভূমিতে অবস্থিত।
সাধারণত আমরা একে ‘এরিয়া ৫১’ হিসেবে জানলেও এর আরও কিছু বিশেষ নাম আছে। যেমন— ড্রিম ল্যান্ড (Dream Land), ওয়াটারটাউন স্ট্রিপ (Watertown Strip), হোম বেস (Home Base), প্যারাডাইস রেঞ্চ (Paradise Ranch), গ্রুম লেক (Groom Lake) ইত্যাদি। এছাড়াও কয়েকদিন আগে ওর আরেকটি নাম দেওয়া হয়। আর তা হলো হোমি এয়ারপোর্ট (Homey Airport)।
‘এরিয়া ৫১’ এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা
এরিয়া ৫১- এ ঢোকার জন্য কোন পাকা রাস্তা নেই। মূল গেট ঘাঁটি থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে অবস্থিত। এখানে যারা কর্মরত, তাদের নাম-পরিচয় বাইরের কেউ জানে না। সমগ্র এলাকাজুড়ে রয়েছে সিসি ক্যমেরা, মোশন ডিটেক্টর, লেজার ডিটেক্টর, সাউন্ড ডিটেক্টরের মতো অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি।
এখানেই শেষ নয়, নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য আরও ব্যবস্থা আছে। আকাশ পথ দেখার জন্য আছে দুটি রাডার। একটি স্থাপন করা হয়েছে আনুমানিক ১৫৫ মাইল উত্তর ও উত্তর-পূর্বকোণে ৯,৪০০ ফুট উঁচু ‘বেলডে’ নামক একটি পাহাড়ের চূড়ায়। আরেকটি স্থাপন করা হয়েছে গ্রুম লেকের উত্তর দিকে প্রায় ৪,৩০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়। এ ধরণের রাডার শুধুমাত্র মার্কিন বিমান বাহিনী ব্যবহার করে। স্বয়ংক্রিয় এসব রাডারের সাহায্যে একসাথে অনেকগুলো গুলি করা যায়।
ঘ্রাণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আশেপাশে থাকা মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীর অস্তিত্ব পর্যবেক্ষণ করা হয়। কেউ যদি ডেরার ভেতর প্রবেশ করেই ফেলে তারপরও তার রেহাই নেই, সাথে সাথে সেন্সরে ধরা পরবে। চোখের পলক পড়ার আগেই পাকরাও করে ফেলবে সশস্ত্র বাহিনী। তাই সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে ঢুকতেই মৃত্যু অবধারিত। প্রবেশ করার অপরাধে আদালতে কোন বিচার হয় না। মাঠেই বিচার এবং শাস্তি।
এখানে মানবাধিকারের কোন বিষয় আমলে নেওয়া হয় না। এখানে নিরাপত্তার জন্য রয়েছে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনী। এতসব বাঁধাকে অতিক্রম করে, এত প্রযুক্তির চোখ ফাঁকি দিয়ে কেউ যদি ঢুকেও পড়ে, সে বেচারা সেখানে এমনিতেই মারা যাবে। কেননা সেখানকার প্রকৃতি এতটাই বিরূপ যে সেখানে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া কোনভাবেই খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়।
‘এরিয়া ৫১’ এর মূল আস্তানায় যাওয়ার জন্য পাড়ি দিতে হয় শুকিয়ে যাওয়া গ্রুম লেক। প্রচন্ড গরমে এখানে যদি আপনি অবস্থান করতে চান তাহলে আপনাকে দিনে ৪ গ্যালন পানি পান করতে হবে। তা না হলে আপনি ৪ দিনের বেশি টিকতে পারবেন না। আর রাতের বেলা সম্মুখীন হতে হবে হাড় কাঁপানো শীতের। তাই বলা যেতে পারে, মরুভূমিতে নির্মিত এরিয়া ৫১ এর ঘাঁটিটি প্রাকৃতিকভাবেও অনেক সুরক্ষিত।
মার্কিন সরকার কর্তৃক ‘এরিয়া ৫১’ এর অস্তিত্ব স্বীকার
অতীতে কেউ যদি মার্কিন বিমান বাহিনীর কাছে এরিয়া ৫১ এর কথা জানতে চেয়ে চিঠি পাঠাতো তাহলে তাদেরকেও পাল্টা জবাব চিঠির সাহায্যে পাঠানো হতো। কিন্তু সঠিক কোন উত্তর মিলত না। কোনভাবেই তারা ‘এরিয়া ৫১’ এর অস্তিত্ব স্বীকার করতে চাইত না।
২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণমাধ্যমে স্বীকার করে নেয় যে, এরিয়া ৫১ এর অস্তিত্ব আছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ- এর এক নথি থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওয়াশিংটন ডিসির জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক দফতর থেকে ঐ নথি অনলাইনে প্রকাশিত হয়। নথিতে বলা হয়, মার্কিন গোয়েন্দা বিমানের পরীক্ষামূলক উউড্ডয়ন করা হয়েছিল এরিয়া ৫১ নামক এক গোপনীয় স্থান থেকে।
‘এরিয়া ৫১’ এ যা যা আছে
মার্কিন সরকারের অবাধ তথ্য অধিকারের সুযোগ নিয়ে ১৯৬০ সালে মার্কিন গোয়েন্দা উপগ্রহ ‘করোনা’ এর সাহায্যে ‘এরিয়া ৫১’ এর ছবি তোলা হয়। সেই ছবিতে ‘এরিয়া ৫১’ এর ভিতরকার সবকিছু প্রকাশিত হয়ে যায়। সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেসব ছবি মুছে ফেলে। একইভাবে ‘টেরা’ উপগ্রহ অনুরূপ ছবি তোলে। এটাও মার্কিন কর্তৃপক্ষ ২০০৪ সালে মুছে ফেলে। পরবর্তীতে নাসার ‘ল্যান্ডসেট ৭’ উপগ্রহের সাহায্যে ‘এরিয়া ৫১’ এর ছবি তোলা হয়।
এতকিছুর পরেও শেষ রক্ষা হয় নি। কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। রাশিয়ার উপগ্রহ ‘ইকনস’ আমেরিকা ও রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই ‘এরিয়া ৫১’ এর ভিতরে কি হচ্ছে তা জানার জন্য উচ্চ রেজুলেশনের ছবি তোলে। এ ছবি তোলার পর এরিয়া ৫১ এর অভ্যন্তরীণ সমস্ত চিত্র প্রকাশিত হয়ে যায়। বর্তমানে ইন্টারনেটে অহরহ ছবি পাওয়া যাচ্ছে।
এসব ছবিতে দেখা যায়, ‘এরিয়া ৫১’ এর ভেতরে সাতটি রানওয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে রানওয়ে 14R/32L লম্বায় ২৩,৩০০ ফুট (৭,১০০ মি.)। অন্য রানওয়েগুলো পিচের তৈরি। এছাড়াও আছে বিশাল এক হ্যালিপ্যাড। ছবিতে আরও দেখা যায় বড় বড় গুদাম ঘর, আবাসিক এলাকা, ফায়ার স্টেশন, বিশাল আকারের জলের ট্যাংক, বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রনের জন্য টাওয়ার, খেলার মাঠ, বেসবল ও টেনিস কোর্ট। আরও আছে যোগাযোগের জন্য বেশ কয়েকটি স্যাটেলাইট ডিশ।
‘এরিয়া ৫১‘ এর অভ্যন্তরে যা যা করা হয়
১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের দিকে অক্সকার্ট নামক একটি প্রকল্পের আওতায় এরিয়া ৫১ এর অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছিল A12 নামের এক বিশেষ ধরনের বিমান। এর বিশেষত্ব ছিল, এটি রাডারে ধরা না দিয়ে ঘন্টায় ৩,৫৪০ কি.মি. বেগে উড়তে পারত। ৯০,০০০ হাজার ফুট উপর থেকে ক্যামেরার সাহায্যে মাটিতে থাকা মাত্র ১ ফুট দৈর্ঘ্যের বস্তুর নিখুঁত ছবি তোলার ক্ষমতা ছিল বিমানটির। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র একে আরও উন্নত করতে গিয়ে এক ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। কিন্তু এটা এরিয়া ৫১ এর ভিতরে হয়েছিল বলে পুরোটাই ধামাচাপা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৬৬ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে এরিয়া ৫১- এ আরেকটি বিমান তৈরি করা হয়েছিল যা A12 থেকে আরও উন্নত। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্ল্যাকবার্ড’। এটি মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি স্পাই বিমান হিসেবে কাজ করত। ব্ল্যাকবার্ড বিমানটি A12 এর চেয়ে আকারে বড়, তেল ধারণ ক্ষমতা বেশি ও ধারগুলো আরো তীক্ষ্ণ হবার কারনে এটি বেশি স্থিতিশীল ও দ্রুত নিজেকে লুকাতে পারে। এ বিমান দিয়ে লস এঞ্জেলস থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে যেতে সময় লাগে মাত্র ৬৪ মিনিট।
এত তর্ক-বিতর্কের পরও এরিয়া ৫১ কিন্তু থেমে নেই। আরও আধুনিক প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র তৈরির গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা হয়ত তা জানতেও পারব অদূর ভবিষ্যতে। আসলে এই রহস্যেঘেরা স্থান নিয়ে আমাদের যতটা জানানো হয়, আমারা ঠিক ততটাই জানি। চাইলেও এর বেশি জানা সম্ভব নয়।