এইডস শব্দটি শুনলে সর্বপ্রথম যে কথাটি মানুষের মাথায় আসে তা হল এইডস হলে আর রক্ষা নাই। একেবারে হুট করে প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষকে ধীরে ধীরে অসুস্থ করে, একেবারে নিস্তেজ করে শেষে প্রাণ কেড়ে নেয় এইচআইভি ভাইরাস ঘটিত এইডস। মানব ইতিহাসে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে সুবর্ণ এই সময়টায় এসে এখনো মানুষ এই রোগের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করে আছে।
প্রায় চল্লিশ বছর আগে প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং পরবর্তীতে গোটা বিশ্বে এইচআইভি এইডস রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৭০ মিলিয়নেরও বেশি লোক এই রোগে আক্রান্ত এবং এখন পর্যন্ত ৩৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
এইচআইভি আসলে কী?
হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা সংক্ষেপে এইচআইভি মূলত মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার উপর আঘাতকারী প্রাণঘাতি ভাইরাস। মানব শরীরে রোগ প্রতিরোধকারী হিসেবে দেহের টি সেল বা সিডি-৪ কোষের কথা বহুলভাবে জানা গেছে। এইচআইভি ভাইরাস এই টি সেল কেই ধ্বংস করে।
তিন প্রকার তরলের মাধ্যমে এইচআইভি ভাইরাস ছড়ায়। রক্ত, বীর্য ও দুধ। যৌনঘটিত রোগ হিসেবেই পরিচিতি পাওয়া এই রোগের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত যে মূলত অনিরাপদ যৌন মিলনের দ্বারাই এটি সবচাইতে বেশি ছড়িয়েছে। এ ছাড়া মাদক গ্রহণের সুঁই বা ইনজেকশন এবং আক্রান্ত মা থেকে জন্ম নেওয়া শিশুর এইচআইভি সংক্রমণ হয়ে থাকে। তবে কোনো প্রকার সামাজিক মেলামেশা কিংবা আক্রান্ত ব্যাক্তির সংস্পর্শে আসলেও এইডস এর ঝুকি নেই ।
এইচআইভি ভাইরাস মানবদেহে যা ঘটায়
এইচআইভি ভাইরাস আদতে একই সাথে অনেকগুলো রোগ প্রতিরোধকারী কোষ টি সেলকে মেরে ফেলে। যার কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী সক্রিয় অংশ একেবারে সাধারণ রোগের সাথেই লড়াই করতে পারেনা। এইডসে আক্রান্ত রোগী সাধারণ সর্দিকাশি জ্বরেই কাবু হয়ে পড়ে। দ্রুত কমতে থাকে ওজন। এভাবেই এই ভাইরাস ক্রমান্বয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। দিনশেষে এইডসের ফলাফল একটাই, মৃত্যু!
এই রোগের কোনো চিকিৎসা আজো আবিষ্কৃত না হলেও আশার কথা হচ্ছে যথাযথ শুশ্রুষার ফলে রোগীর আয়ু কিছুটা বাড়িয়ে তোলা সম্ভব। ২০১৯ সালে মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এন্টি ভাইরাল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে সাময়িকভাবে এইচআইভির ছড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব।
কোথা থেকে এলো এইডস?
বিজ্ঞানীরা এইডসের উৎস হিসেবে শিম্পাঞ্জিকে দায়ী করেছে। এছাড়া বিজ্ঞানীরা বানর ও উল্লুকের ভেতরে সিমিয়ান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা এসআইভি (SIV) (যা কিনা এইচআইভি ভাইরাসেরই প্রজাতিভুক্ত) এর সংক্রমণ ও বিস্তার দেখতে পেয়েছেন।
১৯৯৯ সালে গবেষকরা শিম্পাঞ্জির শরীরে এইচআইভি সদৃশ ভাইরাস এসআইভির খোজ পান। তারা দেখতে পান বানরের দুটো ছোট প্রজাতি লালছোপ বানর ও দাগওয়ালা নাকযুক্ত বানর শিকার করে সেগুলো খাওয়ার ফলে শিম্পাঞ্জিতে এসআইভি ভাইরাস অনুপ্রবেশ করে।
খুব সম্ভব এইচআইভি ভাইরাস মানব শরীরে ছড়ায় আফ্রিকার একদল শিকারীর দ্বারা। শিকারীরা শিম্পাঞ্জি শিকার করে এর মাংস খাওয়ার ফলে কিংবা আক্রান্ত শিম্পাঞ্জীর দ্বারা আহত হওয়ার মাধ্যমে এই ভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশ করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ১৯২০ সালে আফ্রিকার কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসয় এই এসআইভি ভাইরাসের পরিবর্তিত রূপ এইচআইভি মানব শরীরে ছড়ায় ও পরবর্তীতে বৈশ্বিক মহামারী ঘটায়।
তখনকার সময়ে কঙ্গো ছিল বেলজিয়ান কলোনি এবং কিনশাস শহরকে মাত্র রাজধানী করা হয়েছে। এই শহর তরুণ তরুণীদের নিকট বেশ আকর্ষণীয় ছিল। বিশেষ করে যৌন কর্মীদের নিকট নিকট ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। গোটা আফ্রিকা থেকেই প্রচুর মানুষ আসতো কিনসাশায়। আর এভাবেই এই ভাইরাস কিনশাসার অভিবাসী ও যৌন বাণিজ্যের অবাধ বিচরণের ফলে গোটা অঞ্চলে ছড়াতে বেশি সময় নেয়নি। সেক্ষেত্রে সড়ক, রেল ও নৌ পথই ছিল বহনকারী মানুষের যাতায়াতের সহলভ্য উপায়। তাই দূরের শহরগুলোতেও অতি সহজেই ছড়ায় ভাইরাস।
ষাটের দশকে এইচআইভি ভাইরাস হাইতিতে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে হাইতি হয়ে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সত্তরের দশকে ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ছাড়িয়ে তা ঘাটি বসায় নিউইয়র্কে শহরে। আর তখনকার সময়ের যৌন স্বাধীনতা ও সমকামিতার জের ধরে ভাইরাস মানুষের মাঝে বাসা বাধতে থাকে।
এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে ভ্রমণের সুলভতা ও সহজলভ্যতার ফলে মানুষের মাধ্যমে ভাইরাসেরও পরিবহনের পথ অনেকটা সহজ হয়ে যায়। এভাবেই সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এইডস।
মহামারীরূপে ছড়ালো যেভাবে
সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এইচআইভির আগমণ ঘটলেও ৮০-র দশকের আগ পর্যন্ত এক প্রকার লোক চক্ষুর অন্তরালেই ছিল ভাইরাসটি। ১৯৮১ সালে আমেরিকার সেন্টার অব ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে পাঁচজন সমকামী ব্যক্তির এক বিশেষ ধরণের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা যায়। এতে দেখা যায় অতি সাধারণ ছত্রাক নিউমোসিস্টিক যাইরোভেসির দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দূর্বলতায় ভুগছেন।
একই বছর নিইয়র্ক টাইমসে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে নতুন এক ধরণের রোগের কথা উল্লেখ করা হয় যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। সে সময় পর্যন্ত অন্তত ৩৩৫ লোকের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া এবং ১৩৬ জন লোক মারা যাওয়ার কথা জানা যায়। অফিশিয়ালভাবে একে সমকামীদের রোগ হিসেবেই প্রচার করা হয়েছিল কারণ বেশিরভাগ আক্রান্ত ব্যক্তিই ছিলেন সমকামী। তাই এর নাম দেওয়া হয় গে রিলেটেড ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি বা গ্রিড।
যদিও পরবর্তীতে সিডিসি নারীদের মাঝেও এই রোগ সংক্রমণের সকল উপায় খুজে পায় এবং ঘোষণা দেয় নারীরাও এতে আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত মানুষ একে কেবল সমকামীদের রোগ বলেই মনে করতো। এমনকি একে অনেকবছর যাবত ‘গে প্লেগ’ নামেও অবহিত করা হয়েছিল।
১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে সিডিসি একে সর্বপ্রথম এইডস নাম দেয়। একই বছরের শেষ দিকে ইউরোপের উল্লেখযোগ্য মানুষের মাঝেও এইডস ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
এইচআইভি টেস্ট এলো যেভাবে
গবেষকরা ১৯৮৪ সালে চূড়ান্তভাবে এইচআইভি ভাইরাস তথা এইডস শনাক্ত করতে সক্ষম হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনস্ট্রেশনকে (এফডিএ) ১৯৮৫ সালে বাণিজ্যিকভাবে রক্ত পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালের প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয় গোটা বিশ্বে প্রতি ২০ হাজার মানুষে অন্তত একজনের এইডস রয়েছে।
বর্তমানে অসংখ্য পরীক্ষার মাধ্যমে এইচআইভি শনাক্ত করা সম্ভব। আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্ত, লালা বা মূত্র পরীক্ষা করেই এইচআইভি শনাক্ত করা সম্ভব তবে আধুনিক সময়ে উচ্চমাত্রার এন্টিবডির সহায়তায় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই সবচেয়ে দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায়।
এজেডটি এর উন্নয়ন
১৯৮৭ সালে এইচআইভি ভাইরাস বিরোধী ঔষধ হিসেবে এজিডোথায়ামিডিন বা সংক্ষেপে এজেডটি বাজারে আসে। বর্তমানে এইচআইভির অসংখ্য ঔষধ সহজলভ্য যেগুলো মূলত এইচআইভি ভাইরাসকে দমিয়ে রাখে অনেকখানি । সংক্ষেপে এদের বলা হয় এআরটি।
প্রচলিত ব্যবস্থায় ভাইরাসের বেড়ে ওঠার পথ দিয়ে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সচল করা কিংবা প্রাকৃতিকভাবেই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে এইচআইভি থেকে পরিত্রাণের পথ খোজা হয়। গর্ভবতী মাকে থেরাপি দেওয়ার মাধ্যমে অনাগত শিশুর এইচ আইভির ঝুকি অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮৮ সালে প্রতিবছর পয়লা ডিসেম্বরকে বিশ্ব এইডস দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং একই বছর আন্তর্জাতিক এইডস সোসাইটি গঠন করা হয় ।
নব্বই থেকে শুণ্য দশকে এইডস
১৯৯১ সাল থেকে এইডস বিষয়ক সচেতনতার চিহ্ন হিসেবে লাল ফিতা বা রিবন ব্যবহার করা হয়ে আসছে। একই বছরে বাস্কেটবল খেলোয়াড় ম্যাজিক জনসন ঘোষণা দেন তার এইডস হয়েছে এবং এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কাজে অংশ নিতে শুরু করেন তিনি। অল্পকিছুদিন পর বিখ্যাত ব্যান্ড কুইনের গায়ক ফ্রেডি মারকারির এইডস ধরা পড়ে। তিনি এর অল্প কিছু দিন পরই মারা যান। এরপর সবকিছু খুব দ্রুত এগোয়। মানুষ সচেতন হয় এইডস নিয়ে।
১৯৯৪ সালে এফডিএ প্রথম রক্ত পরীক্ষা ছাড়াই এইডস টেস্ট করতে সক্ষম হয়। এর দুই বছর পর প্রথমবারের মতো বাড়িতে বসেই এইচআইভি টেস্ট করার জন্য টেস্ট কিট ও ইউরিন কিট বাজারে আসে। এইডস সংক্রান্ত মৃত্যু ও আক্রান্ত ব্যক্তির সেবা প্রদানে ১৯৯৫ সাল থেকে উন্নত দেশগুলো তাদের হাসপাতালগুলোতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে জরুরী সেবা প্রদান করে থাকে। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত গোটা বিশ্বে মানব মৃত্যুর কারণগুলোর তালিকায় চতুর্থ স্থানে ছিল এইডস, যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ছিল আফ্রিকা।
২০০১ সালে বিভিন্ন দেশ তাদের ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানীগুলোর সহায়তায় এইডসের বিভিন্ন ঔষধ স্বল্পমূল্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রেরণ করতে শুরু করে। একই বছর জাতি সংঘের এইডস বিষয়ক এক সম্মেলনে জানানো হয় আফ্রিকান সাব সাহারা অঞ্চলে এইডসের ফলে মৃতের হার সবচেয়ে বেশি।
কয়েক বছর পর গবেষকরা কিছু চমকপ্রদ তথ্য জানান। ২০০৬ সালে গবেষকরা জানান লিঙ্গের অতিরিক্ত চামড়া কেটে ফেলার মাধ্যমে (মুসলিমদের ভাষায় সুন্নতে খৎনা )পুরুষ থেকে নারীতে এইডসের সংক্রমণের হার শতকরা ৬০ ভাগ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। যেসকল উন্নয়নশীল দেশে এইচআইভি ভাইরাসের প্রকোপ বেশি সেসব দেশে এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয় তাদের প্রতিবেদনে ।
সিডিসির মতে, সচেতনতার দ্বারা যৌন মিলনের মাধ্যমে এইচআইভি ছড়ানোর ঝুকি ৯০ শতাংশ কমানো সম্ভব এবং মাদক গ্রহণের ক্ষেত্রে তা ৭০ শতাংশ ঝুকি এড়ানো সম্ভব।
২০১৯ সালে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ৭৫০ জন সমকামী ব্যক্তি ভাইরাস নিরোধক সেবা নেওয়ার ফলে তার সঙ্গীর মাঝে এইচআইভি ছড়িয়ে পড়েনি। ল্যানসেটের প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে , সমকামীদের দ্বারা পায়ুপথে এইচআইভি ভাইরাস ছড়ানোর ঝুকি একদমই নেই।
এইডস এশিয়াতেও ছড়িয়ে গেছে ইতিমধ্যে। থাইল্যান্ডের পর ভারতেও এই রোগাক্রান্ত লোকের সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। বাংলাদেশেও রয়েছে অন্তত হাজারখানেক এইডসের রোগী ।
বিশ্বে প্রতিদিন ৬ জন করে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। যাদের অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে বলা হয়েছে ২০১৯ সাল নাগাদ বিশ্বে পৌনে চার কোটি লোক এইডসে আক্রান্ত এবং এখনো পর্যন্ত প্রায় দশ লাখেরও বেশি লোক এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আর গোটা বিশ্বে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭০ ভাগই আফ্রিকান সাব সাহারা অঞ্চলের বাসিন্দা।
নতুন প্রজন্মকে এই ভাইরাস থেকে বাঁচাতে তাই আমাদের সচেতনতার বিকল্প নেই। মানুষ স্বপ্ন দেখে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই অভূতপূর্ব উন্নতির কালে মানুষ অদূর ভবিষ্যতে আবিষ্কার করে ফেলবে এইডসের ঔষধ।
লেখক- মাহের রাহাত