বিনোদন

ঊনপঞ্চাশ বাতাস: অসমাপ্ত নিঃশ্বাসের কথন1 min read

অক্টোবর ৩০, ২০২০ 5 min read

author:

ঊনপঞ্চাশ বাতাস: অসমাপ্ত নিঃশ্বাসের কথন1 min read

Reading Time: 5 minutes

আমি অর্ধেকটা দম নেই, বাকিটা একসাথে নেবো বলে।

অজস্র প্রতীক্ষার ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস।‘ বাগধারার অর্থ মেলাতে গেলে ধরা পড়ে পাগলামি। সিনেমাপ্রেমিরা যেন সে টানেই ছুটে গেলেন হলের মুখে। মার্চেই হলের পর্দায় শোভা পাবার কথা, সেটা গড়িয়ে দাঁড়ালো অক্টোবরে।

পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের কাছে এটি এক অন্বেষণের গল্প। জীবনের তীব্র কাঙ্ক্ষিত, অমূল্যকে যেকোনো উপায়ে ফিরে পাবার বাসনার এক প্রচ্ছন্ন প্রকাশ ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের এই বায়োস্কোপ।

পাগলামির ছোঁয়া আছে ছবিতে, আছে চরিত্রের গহীনে, তাদের স্বপ্নে-মননে। উদ্দাম প্রেমের সাথে মানবিকতার সংমিশ্রণে ছবিটি ইতোমধ্যেই নন্দিত হয়েছে। তবুও এই লেখায় এর উত্তম, অনুত্তম দিক নিয়ে স্বল্প আলোচনাতে আসা।

কাহিনী সংক্ষেপ

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মায়াবতী নীরা। চঞ্চল, শহর চষে বেড়ানো এই তরুণী অবলীলায় প্রেমে পড়ে যায় অয়নের। অয়ন কে? সে সামান্য মেডিক্যাল সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। তবে নীরার কাছে সে ‘বিস্ময় মানব’ যে অন্যের দুঃখে বিলিয়ে দেয় নিজেকে। ‘সোনার তরী’ উজাড় করে দেয়াতেই যার চরম সার্থকতা।

সেই দুজন মানুষের পরিচয় ঘটে ব্যস্ত দিবালোকে, ভিক্টোরিয়া পার্কের ডান কোণে। নীরা এগিয়ে দেয় বিস্কুট আর চা, অয়নের প্রত্যাখ্যান। সেই প্রত্যাখান টেনে নিয়ে যায় আকর্ষণে। ভালোবাসোতে শেখায় সমস্ত পৃথিবীকে, সকালের ঝরে যাওয়া শিউলিতে, লঞ্চের ভেঁপুর তরঙ্গে।

আটপৌরে ভাবেই প্রেম চলছিল। হোটেলের ডাল-রুটি, এক থোকা শিউলি কিংবা বারান্দায় শুকোতে দেয়া কাপড়ের পরতে ছিল দুই স্বপ্নবাজের প্রেম। প্রয়োজনে এসেছিল বিচ্ছেদ, মিলন ঘটেছিল আরও তীক্ষ্ণ জৌলুসে।

শার্লিনের মিঠে দুরন্তপনার প্রেমে পড়া বারণ নয়; Photo: Facebook

শেষমেশ মলিন চেনা সমাপ্তিতে গড়াতে পারতো গল্পটা। কিন্তু দেয় না নীরার অবাধ প্রেম। বহু বছর কেটে গেলেও অয়নের প্রতীক্ষায় জমাতে থাকে প্রতি বিন্দু নিঃশ্বাস। উদ্দাম-উদ্বেল ভালোবাসার পরিণতি গড়ায় শান্ত-সুনিবিড় পাগলামিতে।

আপন আলোয় আলোকিত

নিরীক্ষা ধর্মী কাজের বদৌলতে স্বকীয় অবস্থান গড়েছেন মাসুদ হাসান উজ্জ্বল। তাঁর ‘যে জীবন ফড়িংয়ের’, ‘ ছায়াফেরি’- এখনও টাইমলাইনে আশ্রয় গড়ে প্রতিদিন। নিজের ভাষায় গল্প বলতে জানা পরিচালকের অভাবটাই এখন তীব্র। সেদিকে নামের মতোই জাজ্বল্যমান তিনি।

প্রশ্ন করুক দর্শক, রহস্য হোক তাই চান পরিচালক। তাই ট্রেইলার দেখে যাদের চোখ কপালে উঠেছিল তাদের কাছে সাসপেন্স ভাঙ্গেননি। ছবির নামকরণ প্রশ্নে উত্তর দেন এভাবে,

‘আমাদের প্রচলিত একটা বাগধারা আছে ‘ঊনপঞ্চাশ বায়ু’। এর আভিধানিক অর্থ হলো ‘পাগলামী’। ঋগবেদে এর নিদর্শন আছে।  এটা অদম্য ব্যাপার। প্রেম জিনিসটাও এমনই।‘

রেড অক্টোবর ফিল্মসের প্রযোজনার এই ছবিতে পরিচালনা, সংলাপ ও গল্পে নিজেকে সব্যসাচী প্রমাণ করেছেন তিনি। নিজ কণ্ঠে গেয়েছেন ‘মেঘমালা’ গানটিও।

চলচ্চিত্রের অন্যতম মনোমোহিনী বিষয় ছিল এর দৃশ্যায়নে। হৃদয় সরকারের ক্যামেরায় পাখির চোখের ড্রোন শট, মিডিয়াম শটে ‘ভটভটি’ বা উড়ুক্কু পলিথিনের একাকীত্ব- সমস্তটাই গল্পের খাতিরে হয়ে উঠেছে একেকটা চরিত্র। চোখের আরামের পাশাপাশি বাস্তবিক প্রকাশ ছিল পোশাকেও।

দুই প্রধান চরিত্রের প্রথম দেখা, ক্ষীর হতে থাকা প্রেম থেকে বিরহ-সমস্তের আবহে ছিল নির্মেদ সুর। বাড়াবাড়ির বদলে কানে অমৃতের স্বাদই দিয়েছে এর গানগুলো। সুদীর্ঘ সময় সঙ্গীতের পাড়া মাড়াননি বেজবাবা সুমন। ‘প্রথম’ গানটিই অনেকখানি প্রথম প্রেমের মাধুর্য তুলে এনেছে সুরের স্পর্শে। বাকি গানগুলো গেয়েছেন সৌরিন, ভারতের সিধু ও সোমলতা।

নতুন করে মুক্তির তারিখ, হলের শিডিউল মেলাতে গিয়ে ক্লান্তিও ভর করেছিল নির্মাতার। তবুও স্বপ্নের প্রথম কিস্তি বলে কথা। শিল্পী সমাজের বহুল পরিচিত এক নাম, তাই প্রত্যাশার চাপও ছিল প্রচুর।

মুক্তির উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন এভাবে,

‘একটা সুস্থ–স্বাভাবিক পৃথিবীর প্রত্যাশায় আমরা ১৩ মার্চ ‘‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’’ সিনেমার মুক্তি স্থগিত করেছিলাম। এর মধ্যে চলে গেল ঘরবন্দী দীর্ঘ সাতটি মাস। এখন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেই কথা বিবেচনা করে ২৩ অক্টোবর মুক্তি পেলো ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস।‘

বিচিত্র পদচারণা

‘আমার স্নায়ুর সকল ইচ্ছা দিয়ে

তোমাকে চাইছি হৃদয়ের কাছে পেতে।

তোমাকে চাইছি মানবিক স্নেহে, প্রেমে

মানবিক মোহে, শরীরে ও পিপাসায়।‘

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর এমন আকুতির মতোই আবেদন খুঁজে পাবেন দর্শক। পরতে পরতে যেমন বৈচিত্র্যের সমাহার ছিল, তেমনি দ্যুতি ছড়িয়েছেন দুই প্রধান কুশীলব- ইমতিয়াজ বর্ষণ ও শার্লিন ফারজানা। দুজনেরই প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি এটি। এছাড়াও মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলোরা গওহর, এনামুল হক, সেওথি, নেভিল ফেরদৌস, খায়রুল বাশার, লামিয়া প্রমুখ অভিনয় করেন এতে।

টানা তিন বছর শ্রম দিয়েছেন ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ দল; Photo: BD News twenty

ছবির জন্য টানা ছয় মাস মহড়া দিয়েছেন বর্ষণ- শার্লিন। তাই বোঝাপড়াটাও ছিল দুর্দান্ত। এ প্রসঙ্গে ইমতিয়াজ জানান,

‘সদরঘাটের মতো এলাকায় শুট করা কঠিন ছিল। অনেক সময় ‘অ্যাকশন’ পর্যন্ত বলতে পারেননি উজ্জ্বল ভাই। সেসময় আমাদের বোঝাপড়াটাই ছিল মূলশক্তি, চোখের ইশারাতেই অনেক কাজ করেছি।‘

বৃষ্টিস্নাত শহরে প্রেমিকার দু’হাতভর্তি খাবার নিয়ে আসা, ঘনিষ্ঠতার বিহ্বল মুহূর্ত, ঘাসের গালিচায় আলগোছে হাত স্পর্শ কিংবা নিশ্বাস বোতল ভর্তি করে তাদের বিয়ে দেয়া- প্রেমানুভূতির চলন্ত কাব্যই যেন ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’।

শুটিং লোকেশনে ছিল বাস্তবতার নিখাদ সম্মিলন। ফার্মগেট, শাহবাগ, পিজি, মিটফোর্ড, ঢাকা মেডিক্যাল, ধানমন্ডি ২৭, কার্জন হল, বাংলাবাজার আর সদর ঘাটের প্রিয় চেনা স্থানে নিজেকে মেলাতে একটুও কষ্ট হয় না দর্শকের। এজন্যই বারবার মনে হতে থাকে, আমি-আপনি নীরা, আপনাতে আমাতেই অয়ন।

ইমরান ছিলেন মেকআপে; দীর্ঘদিন একসাথে কাজের সুবাদে জানেন নির্মাতার প্রয়োজন। সেজন্য চটুল কোন সাজসজ্জাই চোখে পড়েনি। হালকা ক্রিম-কাজল- ঠোঁট রাঙার ছোঁয়াতেই লাবণ্যময়ী হয়ে উঠেছিলেন শার্লিন। ইমতিয়াজের দৈনিক সাজ ও ভগ্ন দেহের পরিবর্তন ছিল বিশ্বাসযোগ্য।

‘প্রেমের তাওয়া গরম থাকতে থাকতে রুটি সেঁকে ফেলতে হয়’ এহেন সংলাপে কৌতুক যেমন তৈরি হয়েছে তেমনি স্থূলতার আভাসও ছিল খানিকটা। সেদিক থেকে সমসাময়িক অবস্থাকে কেন্দ্র করে ‘লোকজন ভাঁড়ামি করেই হিরো হয়ে যাচ্ছে… দু’একটা মিউজিক ভিডিও করেই হিরো হয়ে যাচ্ছে’ , ‘সবকিছু নিয়ে নিউজ করতে নেই।’ ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে প্রচুর। অয়নের লাশ নিয়ে যাবার পূর্ব মুহূর্তে নীরার আকুতি দৃশ্যে অশ্রু সজল হতে বাধ্য দর্শক।

দর্শকদের ভালোবাসায় সিক্ত নির্মাতাও। মুক্তির পর থেকেই প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। নিজের আশঙ্কার কথা জানিয়ে নির্মাতা বলেন,

‘শুক্রবার বৃষ্টি উপেক্ষা করে দর্শক যে ভালোবাসা দেখিয়েছে, আমি সত্যিই আপ্লুত। ভিন্ন ধরনের গল্পের ছবির প্রতি দর্শকের আগ্রহ এখন আছে। ছবিটি মুক্তির প্রথম দিন একটু ভয় পেয়েছিলাম। কারণ সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। দর্শকের উপস্থিতিতে সেই ভয় কেটে গেছে।‘

ছবির ক্লাইম্যাক্স অনাকাঙ্ক্ষিত। বহুদিন বঙ্গদেশি দর্শকের এমন স্বাদ পাওয়া হয়নি। সেজন্য বাহবার দাবিদার গোটা দল। পরাবাস্তবতা-চিকিৎসা-বিজ্ঞানের মিশেল টানলেও এর মূল শক্তি ছিল মানবিকতা। জীবনানন্দের কামরাঙ্গা লাল-মেঘের বিমর্ষতা ছিল দ্বিতীয় অর্ধেকে।

একটুকরো মন্দ

ভালয়-মন্দে মানুষ। সে হিসেবের ভেতর পড়ে তার শিল্পও। সুর, সংলাপ আর সিনেমাটোগ্রাফিতে হৃদয় জয় করলেও বেশ কিছু প্লট আকর্ষণের চেয়ে বিকর্ষণই করে।

এই যেমন- অয়নের পেছনে নীরার ঘুরে বেড়াবার বিষয়টাই ধরুন। গত চার দশকে বাংলা ও বলিউডি সিনেমায় নায়িকার পিছু নেয়াকে প্রেমেরই নামান্তর ধরা হতো। কিন্তু আদতেই কি তা প্রেম? এর সামাজিক কুপ্রভাব সম্পর্কে অবিদিত নন কেউই। তবুও কেন ভালোবাসার মোড়কে পিছু নেয়া? জেন্ডার ভূমিকা বদলালেও গ্রহণযোগ্য নয়।

নীরার চরিত্রকে বয়সের তুলনায় বেশ অপরিপক্বই মনে হয়েছে। চতুর্থ বর্ষ পড়ুয়ার জীবনে এত ফুরসত এবং বাস্তব জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বিস্ময় জাগায়। অধিকাংশ সময়েই মনে হয়েছে হিমুর রূপা হবার প্রচেষ্টায় মূল চরিত্র থেকে সরে যাচ্ছেন নায়িকা। চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যেতেও যেখানে বাধা ছিল না, সেখানে কবরের আধ খেঁচড়া রূপ ভীষণ দৃষ্টিকটু।

ময়ূর পালকের মতো সুকোমল রোমান্সের স্বাদ পেয়েছে দর্শক; Photo: Facebook

ভিএফএক্স, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার মতো বিষয়গুলো হাস্যকর ঠেকেছে একেক সময়। কিছু প্লটের সাথে দর্শক Black Mirror সিরিজের সিজন ২ এর Be Right Back এর সাদৃশ্যও খুঁজে পাবেন। পরাবাস্তব-হরর প্রভাব আনার বেলাতেও দশ আনা বিফল। অসমিয়ার মতো ছোট ইন্ডাস্ট্রির ‘কথানদী তে কবরের দৃশ্যও বিচিত্র ভাবনার অবতারণায় সফল ছিল। এক্ষেত্রে সুর আর টেকনিক্যাল কারণেই জমেনি।

ভিড়ের ভাঁজে প্রেম- নীরা অয়নের গল্পে এটুকুই ছিল নতুনত্ব। ক্লাইম্যাক্সের আকুতিটা জমে উঠবার আগেই সমাপ্ত। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নীরার বাবা-মার ভূমিকা, অয়নের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক-সবকিছুই যুক্তিকে খাটো করেছে। লিনিয়ার গল্পের বদলে নন-লিনিয়ার রাস্তা ধরলে সম্ভবত গল্পের সুবাস ছড়াতো আরও বেশি। বেশ কিছু দৃশ্যে প্লটহোল থাকায় মায়ার চেয়ে বিরক্তিই এসেছে। ডিটেইলিংয়ে সুযোগ পেলেও বড় পর্দার দাবি মেটাতে একটু খামতি ছিল।

ওর কবরে একটা ছোট্ট দরজা আছে, টোকা মেরে দেখেন। প্রেমের জোর থাকলে সাড়া মিলতেও পারে।‘ 

তুমুল নন্দিত নাটক ‘যে জীবন ফড়িঙয়ে’র অন্তে ছিল সেই টোকা দেবার বিখ্যাত দৃশ্য। এখানেও ব্যতিক্রম নয়। নীরার আবেগে ক্লান্তি ভর করে না, খণ্ড খণ্ড অয়নকে খুঁজে ফেরে সে বহু মানুষের ভেতরে। ছুটে যায় এক চোখে আলো পাওয়া কিশোরের জীবনে অথবা সেই স্পেশাল চাইল্ডের কাছে-যার হৃদয় অয়নের উত্তাপে রঞ্জিত। পুরনো বোতলে পুরনো গল্পের বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে এমন অনন্য-বিষণ্ণতার ভীষণ দরকার ছিল, ‘হ্যাপি এন্ডিং’ এর বাইরেও পরিণতির প্রবল প্রতাপ এতেই মেলে।

নিঃশ্বাস হল প্রতিশ্রুতির মতো। সেই প্রতিশ্রুতি হতে পারে সৃষ্টির প্রতি, বিনাশের বিরুদ্ধে আর গড্ডলিকা প্রবাহে দেহ ভাসিয়ে দেবার বাইরে বাংলা চলচ্চিত্রকে দাঁড় করাবার। নির্মাতার হাতে এখন সাতটি চিত্রনাট্য আছে, সময়-সহায়তা বুঝে সেগুলো নিয়েই ‘উন্মাদনা’য় মত্ত হতে চান। উপহার দিতে চান বুক ভরা স্বস্তির সুবাতাস।

লেখক- সারাহ তামান্না

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *