বিনোদন

উনিশে সৃজিত1 min read

ডিসেম্বর ২৭, ২০১৯ 5 min read

author:

উনিশে সৃজিত1 min read

Reading Time: 5 minutes

‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি।‘ 

২০১০ সাল। টেলিভিশন বা রেডিও- সবখানেই নতুন এক গায়কের একেবারে ভিন্ন গায়কীর গান ভেসে উঠছে। বারবার শুনেও যেন সাধ মেটাতে পারছেনা শ্রোতার কান। এর সাথে সিনেমার ট্রেলারটাও খাসা। 

সেবছর অক্টোবরে টলিপাড়া সিনেমার এক নতুন জাদুকরের সাথে পরিচিত হলো, শিখলো নতুন এক ভাষা। শিল্প আর বাণিজ্যের দোয়াত মিশিয়ে উত্থান ঘটলো সৃজিত মুখার্জির। ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘হেমলক সোসাইটি’, ‘চতুষ্কোণ’, ‘জাতিস্মর’, ‘রাজকাহিনী’, ‘উমা’, ‘এক যে ছিল রাজা’ প্রভৃতি সফল চলচ্চিত্রের সফল নির্মাতা তিনি। প্রতি বছরের ন্যায় এই উনিশেও তাঁর জয়রথ ছিল অব্যাহত। সাহিত্য, থ্রিলার, ইতিহাস- তিন ঘরানার ছবি দিয়ে এবছরটা মাতিয়েছেন তিনি। চলুন জেনে আসি সেগুলো সম্পর্কে।  

শাহজাহান রিজেন্সি  

কত অজানারে পর শংকরের কলমে খরা ছিল দীর্ঘদিন। সাহিত্যিক সমাজ তো ঘোষণা দিয়েই দিয়েছিল, প্রথম উপন্যাসের পর আর তুমুল করতালি পাবার মতো সৃষ্টি আসবেই না তাঁর হাতে। সেই তাড়নাতে ব্যতিব্যস্ত শংকর বৃষ্টিস্নাত এক রাতে এসপ্ল্যানেডের সামনে এসে দাঁড়ান। সামনে সুবিশাল গ্র্যান্ড হোটেল। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, পরের উপন্যাসটি হবে হোটেলকে ঘিরেই। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৬২ সালে ছাপা হয়চৌরঙ্গী চৌরঙ্গীতে বর্ণিত শাহজাহান হোটেল আর তার অন্দরমহলের হালচালের অবিশ্রান্ত কাহিনীতে মুগ্ধ হয় আপামর বাঙালি পাঠক। 

সেই কাহিনিকে আরও একবার জনতার সামনে তুলে আনেন পরিচালক পিনাকিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তম কুমার, উৎপল দত্ত, সুপ্রিয়া দেবী, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের প্রমুখের মতো কালজয়ী অভিনেতাদের নিয়ে করা৬৮ এর সেই কাজ ভীষণ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল। উনিশ সালে সেই একই গল্প চিত্রায়নের সাহস দেখালেন সৃজিত।

একে তো কালজয়ী উপন্যাস। মানবজীবনের ঘাতপ্রতিঘাত কলমের খোঁচায় যেভাবে উঠে আসে, তার অনুকরণের বেলায় বাড়তি একটা চ্যালেঞ্জ থাকেই। এর উপর উত্তমউৎপলের মতো বাঘা অভিনেতারা পূর্বেই পর্দায় মার্কো পোলো আর স্যাটা বোসের পাট করে গেছেন। এই প্রসঙ্গেই সৃজিত বলেন, ‘ কলকাতা অনেক বদলে গেছে। হোটেল ব্যবসা, লোকের মূল্যবোধ, জীবনযাপন সমস্তটাই এখন ভিন্ন। আগের চাইতে জীবন আরওডার্কহয়েছে। সেদিকটাতেই আমার লক্ষ্য ছিল।‘ 

পোস্টারেও এসেছে অজিত গুপ্তের ‘চৌরঙ্গী’ প্রচ্ছদের আদল; Photo: IMDb

ছবিতে মূল চরিত্র রূপায়নের দায় পড়েছিল আবীর চ্যাটার্জি, পরমব্রত চ্যাটার্জি, স্বস্তিকা মুখার্জি, মমতা শংকর, অঞ্জন দত্ত, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য,রুদ্রনীল ঘোষ, রিত্তিকা সেন প্রমুখের কাঁধে। সুপ্রিয়া দেবীর করবী গুহের আদলে এবারের কমলিনী গুহ ছিলেন আরও বেশি সাহসি আর ক্ষিপ্র। প্রথমে জয়া আহসানকে প্রস্তাব দেয়া হলেও খোলামেলা দৃশ্যে আপত্তি থাকায় স্বস্তিকাই পান সেই চরিত্র। যদিও পরে সৃজিত জানান, ‘কমলিনীকে লেখার সময়ই স্বস্তিকাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। এরপর অবশ্য স্বস্তিকাকমলিনীর বোঝাপড়াটা দারুণ হয়েছিল। আমাকে আর বাড়তিভাবে নির্দেশনা দিতেই হয়নি।

ছবির প্রাণ ছিলেন আবীর চ্যাটার্জি। নিজের চরিত্রের চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এর আগে এই চরিত্রে স্বয়ং উত্তম কুমার অভিনয় করে গেছেন। অতএব বুঝতেই পেরেছি প্রভূত বাঁশ অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য। তবুও নিজের মতো করে রঙিন করবার প্রচেষ্টা ছিল আমার।‘ 

বছরের ১৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। দর্শকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও বোদ্ধারা একে সাহসীসুন্দর পদবিই দিয়েছেন। গৈরিক সরকারের ক্যামেরার নৈপুণ্যে শাহজাহান হোটেলের জৌলুস আর ব্যথাতুরা হৃদয়দুয়ের স্বাদই মিলেছে। অনুপম রায় বরাবরই সৃজিতের সঙ্গী। এতে তিনি সাথে পান ইন্দ্রদীপ দাসগুপ্তকেও। বাঙালির স্মৃতিকাতরতার সাথে সাহিত্যের অদ্ভুত রোমাঞ্চ পেতে দেখে ফেলুন বছরের অন্যতম আলোচিত ছবিশাহজাহান রিজেন্সি  

ভিঞ্চিদা

তুমিও ক্রিমিনাল, আমিও ক্রিমিনাল। আমরা পার্টনারস ইন ক্রাইম।এই সংলাপেই পাঠক বুঝে গেছেন বলছি কোন থ্রিলারের কথা। আর সেই থ্রিলার যদি হয় সৃজিতের তবে তো আড়মোড়া ভেঙেই দাঁড়াতে পারেন। 

ষাটের দশকের উত্তাল সময়। নৈরাশ্য, রাজনৈতিক নোংরামো আর যুবসমাজের বিধ্বস্ত চিত্র উঠে এসেছিল কাগজের পাতায়। সাহিত্যের ভাষায় সমাজের উলঙ্গ চিত্র তুলে এনেছিলহাংরি জেনারশন পরবর্তীতে কোর্ট কাচারির কাছে বলি যায় সেই বিপ্লব। পঞ্চাশ বছর বাদে সেই বিক্ষুব্ধ সময়ের রূপকই সিনেমার পর্দায় তুলেছিলেন সৃজিত, ‘বাইশে শ্রাবণে প্রসেনজিতের ক্যারিয়ারের মোড়টাই ঘুরিয়ে দেয় থ্রিলার জনরার অবিস্মরণীয় সেই ছবি। আর সৃজিতের সৃষ্টিতে নির্ভরতা বাড়ে গোটা টলিউডের।

থ্রিলারে কতটা সিদ্ধহস্ত সৃজিত তা বলাই বাহুল্য। শ্রী ভেংকাটেশ ফিল্মের ব্যানারে পহেলা বৈশাখে এবার মুক্তি পায়ভিঞ্চি দা একজন প্রস্থেটিক মেকাপ আর্টিস্ট এবং অপরাধ প্রবণ এক উকিলের পাল্টাপাল্টি শোধপ্রতিশোধের গল্প এসেছে এতে। মিনিট তিনেকের জন্য ঋদ্ধি সেনকে দেখা গেলেও সেটুকুতেই বাজিমাত করেছেন তিনিও। ঠাণ্ডা মাথার খুনে হিসেবে ঋত্বিক চক্রবর্তীও ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকে। রুদ্রনীল ঘোষ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গুণেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন অপরাধবোধে বিদ্ধ আর্টিস্টের টানাপোড়েনকে। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ববহ হলেও অনির্বাণ ভট্টাচার্য আর সোহিনী সরকার হতাশ করেননি, বরং ময়ূরের পেখমের মতো গল্পের সৌন্দর্য বাড়িয়েছেন কয়েক গুণ।

ছবির গল্প কিন্তু এসেছে অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের হাত থেকেই। টলিপাড়ার জনপ্রিয় মেকাপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডুকে খুব কাছ থেকেই দেখেছেন তিনি বছরের পর বছর। তাঁর কথা মাথায় রেখেই একটা গল্প দাঁড় করান রুদ্রনীল, আর সৃজিতের ছোঁয়ায় ডালপালা মেলে পুরোটার। প্রসঙ্গে রুদ্র বলেন, ‘ ২০১৬ সালে প্রথম এই গল্পটা মাথায় আসে। গল্পটা আমি প্রথমে লিনিয়ার, স্মুথ ওয়েতে গল্পটা নিয়ে গেছিলাম। কিন্তু সৃজিত বরাবরই একটা জাগলারি করতে পছন্দ করে যেটা সিনেমাটিক্যালি করা বেশ কঠিন। সৃজিত তাঁর নিজস্ব মুনশিয়ানা দিয়ে বলল, না একটু ননলিনিয়ার ফরম্যাটে যাবো। তবে এই গল্পটাকে নিয়ে আমরা দুজনেই বেশ আশাবাদী ছিলাম।শুধু তাই নয়, ছবির শেষ দৃশ্যের জন্য টানা তিন ঘণ্টা প্রস্থেটিক মেকাপের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল রুদ্রকে। ঋত্বিকও তাঁর অনুভূতি জানান এভাবে, ‘বাঙালি যে থ্রিলার পছন্দ করে সেটা আমরা গত কয়েক বছরের গ্রাফ দেখলেই বুঝি। আর এই ছবিতে একই সাথে একজন প্রস্থেটিক মেকাপ আর্টিস্ট, একজন ইয়ার আর একটা প্রেমের গল্প একই সাথে চলতে থাকে। আমার মনে হয়না সাম্প্রতিক কোন ছবিতে এমনটা দেখা গেছে। সেদিক দিয়ে প্রচণ্ড এন্টারটেইনিং এইভিঞ্চি দা‘ 

ক্যামেরার পেছনের শ্রমের গল্প ‘ভিঞ্চি দা’; Photo: Times of India

গুমনামি

দেড়শত বৎসর পূর্বে বাঙ্গালী বিদেশীকে ভারতের বক্ষে প্রবেশের পথ দেখিয়েছিল। সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত বিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালীকে করতে হবে। বাঙ্গলার নর-নারীকে ভারতের লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। কি উপায়ে এই কার্য সুসম্পন্ন হতে পারে এটাই বাঙ্গলার সর্বপ্রধান সমস্যা।‘ 

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর ‘দেশের ডাক’ এ এভাবেই বাঙালির ভবিষ্যৎ কর্মের নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষ বোসের ন্যায় তীক্ষ্ণ, প্রজ্ঞাবান এবং বিপ্লবী নেতা অদ্বিতীয়। তাঁর প্রভাব শুধু কলকাতাতেই নয়, গোটা ভারতেই ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মতো। তাঁরই নির্দেশে গড়ে উঠেছিল ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’। ব্রিটিশ শাসকেরা মহাত্মা গান্ধী বা জওহরলাল নেহেরুকে শ্রদ্ধার চোখে দেখলেও নেতাজি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। সেই বিক্রমী নেতার সমাপ্তিটা কিন্তু বাকিদের মতো নয়। যার ক্ষুরধার নেতৃত্বে জেগে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম, সেই মানুষটার মৃত্যু বা সমাপ্তি নিয়ে আজও রহস্য বিদ্যমান। 

নেতাজির মৃত্যু রহস্য উত্থাপিত হয়েছে ‘গুমনামি’তে; Photo: Cinestaan

নেতাজির মৃত্যু নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট জাপানি বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধরে নেয়া হয়। ১৯৫৬ সালের শাহনেওয়াজ কমিশন, ১৯৭০ এর খোসলা কমিশন দুর্ঘটনায় সন্দেহাতীতভাবে নেতাজির মৃত্যুকে স্বীকার করে নিলেও ২০০৫ সালের মুখার্জি কমিশন সব তথ্য প্রমাণকে নাকচ করে দেন। মুখার্জি কমিশন এবং মিশন নেতাজির কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণাপত্র উপস্থাপনের গোটা ঘটনাটাকে ফ্রেমবন্দি করা হয়েছে ‘গুমনামি’তে। নেতাজির প্রস্থান নিয়ে মূল তিনটি থিওরিই ছুঁয়েছেন পরিচালক সৃজিত। একাধারে জাপানি বিমান দুর্ঘটনা, আবার রাশিয়ায় আগমন এবং সর্বশেষ ফায়জাবাদের সন্ন্যাসি ‘গুমনামি বাবা’ – নেতাজি কেন্দ্রিক সকল সন্দেহেরই ভিজ্যুয়াল এনেছেন তিনি। 

ছবিতে সুভাষ বোসের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়। চরিত্রের খাতিরে সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি আর মেকআপে নিরীক্ষা করলেও শুটিঙয়ের দেড় মাস আগেও খুব একটা আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিলেন না প্রসেনজিত। সৃজিতের অনুপ্রেরণা আর মেকাপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডুর সহযোগিতাতেই নিজেকে তৈরি করেন তিনি।শরীরের সত্তর ভাগই প্রস্থেটিক মেকআপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হতো,যা প্রতিবার প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার হ্যাপা ছিল। সাংবাদিক অনুজ ধরের আদলে চন্দ্রচূড় ধরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ‘একবিংশ শতাব্দীর এই সময়টাতে পৃথিবীর সব জায়গা থেকেই নানারকম প্রশ্ন উঠছে। আমি মনে করি, সিনেমার মাধ্যমে যদি সেসব প্রশ্ন তোলা হয়, এরচেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারেনা। আর উনাকে নিয়ে যে এতবড় রিসার্চ হয়েছে তা আমার জানা ছিলনা। আমি মনে করি, অভিনেতা হিসেবে এই জানাটাই আমার বড় প্রাপ্তি।‘ 

১৩৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবিটি মুক্তি পায় ২ অক্টোবর। ব্যবসায়িক সাফল্যের পাশাপাশি নানান বিতর্কের জন্মও দেয় ছবিটি। সুভাষ বসুর ভাইয়ের নাতি এবং ইতিহাসবিদ সুগত বোস সৃজিতের এই ছবিকে পুরোটাই ‘ননসেন্স’ বলে আখ্যা দেন এবং ‘মুখার্জি কমিশনে’র নাম ব্যবহারকে মামলা এড়াবার ফন্দি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এছাড়াও নানান সংস্থা থেকে মামলার হুমকি পান ‘গুমনামি’ দল। ‘ইতিহাসকে জানা বা নাড়াচাড়া দেবার দায়িত্ব সবারই থাকে। সৃজিত সেখান থেকেই ‘গুমনামি’ নির্মাণ করেছেন।‘ আশু বিতর্কের রেশ ধরে এভাবেই বলেন প্রসেনজিত। 

ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রয়াণের পর শোকে আকুল টলিপাড়ার দায়িত্ব অনেকটাই বর্তায় সৃজিতের কাঁধে। কোন এক ধারায় স্থির না থেকে নিত্য নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই দর্শককে ভিন্নমাত্রার স্বাদ দিতে সদা প্রস্তুত এই পরিচালক। তারই প্রমাণ মেলে তাঁর গত দশ বছরের খতিয়ানে। 

লেখক- সারাহ তামান্না 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *