বিশ্ব

উইঘুর মুসলিম: নিজগৃহে পরবাসী          1 min read

জুন ১২, ২০১৯ 5 min read

author:

উইঘুর মুসলিম: নিজগৃহে পরবাসী          1 min read

Reading Time: 5 minutes

চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের উপর দশকের পর দশক ধরে নিপীড়ন চলছে। চীন সরকার তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার কেড়ে নিয়েছে। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে অনেকগুলো বন্দি শিবিরে খুব শোচনীয় অবস্থায় ২০ লাখেরও বেশি উইঘুর ও অন্যান্য তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলমানদের আটকে রাখা হয়েছে।  তৃতীয় বছরের মতো এবারও পুরো রমযান মাস জুড়ে রোযা পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২ বছরে প্রায় ৩১টি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে সেখানে। এছাড়াও বন্দি শিবিরগুলোতে বন্দীদের ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয় পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। রাজি না হলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এর মধ্যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শ্লোগান মুখস্থ করানো, শূকরের মাংস খাওয়ানো এবং মদ পান করানোর মতো অভিযোগ রয়েছে।

জিনজিয়াং চীনের সীমান্তবর্তী বৃহত্তম অঞ্চল। এর আয়তন ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৮৯৭ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ১ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার। এর রাজধানীর নাম উরুমচি। সরকারি ভাষা ম্যান্ডারিন ও উইঘুর। কেবলমাত্র আয়তনের দিক থেকেই নয়, জিনজিয়াং খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদেও ভরপুর। পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি, সবুজ প্রান্তর সবই আছে এই ভূখণ্ডে। সমৃদ্ধ কৃষি সম্পদের পাশাপাশি এ অঞ্চলে রয়েছে পশুপালনের জন্য বিশাল চারণভূমি। শুধু তাই নয়, আরও আছে সোনা, ইউরেনিয়াম, তেল ও গ্যাসের মতো মূল্যবান খনি। তাই খুব যুক্তিসংগত কারণেই কমিউনিস্ট চীনের কাছে জিনজিয়াং প্রদেশ ভীষণ লোভনীয়।

জিনজিয়াং এ সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। তবে এ নগরীর শিল্প কারখানা ও ব্যবসা বাণিজ্যে মুসলমানদের সংখ্যা একেবারেই নগন্য। সরকারি নীতির কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জিনজিয়াং প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে কাশগড়, হুতান, খিজিনন্সু, আকসু এবং পূর্বাঞ্চলের তূরপানে উইঘুরদের সংখ্যা বেশি। অন্যদিকে জিনজিয়াং এর পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলে হানদের সংখ্যা বেশি। অনেক আগে থেকেই চীন সরকার দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে হানদের এনে জিনজিয়াং প্রদেশে পুনর্বাসিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মূল কারণ জিনজিয়াং প্রদেশের অফুরান সম্পদ। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে ভরপুর এ সমস্ত সম্পত্তি হাতানোর জন্য চাই আস্থাবান নিজস্ব লোক। অন্যদিকে স্থানীয় উইঘুর মুসলিমদের সাথে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান আকাশ-পাতাল। তাই খুব ঠান্ডা মাথায় জিনজিয়াং এ উইঘুরদেরকে সরিয়ে হানদেরকে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ অঞ্চলে হানদের প্রাধান্য সৃষ্টি করা।

উইঘুরদের আদি পরিচয় অবাক করার মতো। উইঘুর হচ্ছে তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলমানদের একটি গ্রুপ। পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এদের বসবাস। উইঘুর মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার। এদের মধ্যে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশেই বাস করে ৮৫ লাখের মতো। উনানসহ অন্যান্য প্রদেশে ও চীনের রাজধানী বেইজিংসহ অন্যান্য নগরীতে অল্পসংখ্যক উইঘুর বাস করে। এরা সুন্নী মুসলমান এবং অনেকেই সুফিবাদ চর্চা করে। প্রাচীনকালে আলতাই পর্বতমালার পাদদেশে তুর্কি বংশোদ্ভূত কিছু গোত্র বা উপজাতি বাস করত। এদের মধ্যে নয়টি উপজাতি নিয়ে উইঘুর সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। একসময় তারই অববাহিকা থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত উইঘুর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। যুদ্ধ বিগ্রহ, বন্যা খরাসহ নানা কারণে এ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে মঙ্গোলিয়ার উইঘুররা তারই অববাহিকায় চলে গিয়ে সেখানে ছোট ছোট কয়েকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এসময়ই বর্তমান জিনজিয়াং এলাকাটি কখনও উইঘুরস্থান আবার কখনও বা পূর্ব তুর্কিস্তান নামে উইঘুর মুসলমানদের শাসনে ছিল।

বর্তমান চীনের উত্তর পূর্বাঞ্চলে মাঞ্চু শাসকরা ১৬৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করে কিং সাম্রাজ্য। তারা মঙ্গোলিয়ার অধিকাংশ এলাকা, পূর্ব তুর্কীস্তান ও তিব্বত দখল করে। দু’শ বছর পর্যন্ত এই এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রনে ছিল। এই সময়কালে কিং সম্রাটদের বিরুদ্ধে উইঘুররা অন্তত ৪২ বার বিদ্রোহ করেছে। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৪ সালে উইঘুররা পূর্ব তুর্কীস্তান থেকে কিং শাসকদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় এবং কাশহগড়কেন্দ্রিক এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।

রাশিয়ার জার পূর্ব তুর্কীস্তান দখল করে নিতে পারে এমন আশঙ্কায় মাঞ্চু শাসকরা ১৮৭৬ সালে হামলা করে পূর্ব তুর্কীস্তানে। জেনারেল জু ঝং তানের নেতৃত্বে ঐ বাহিনীর হামলার প্রতি সমর্থন জানায় ব্রিটেন। দখলের পর ১৮৮৪ সালের ৮ নভেম্বর পূর্ব তুর্কিস্তানের নাম পাল্টে রাখা হয় জিনজিয়াং বা সিংকিয়াং যার অর্থ নতুন ভূখণ্ড। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব এখনও এ এলাকাকে মঙ্গোলিস্তান বা তুর্কিস্তানের পূর্ব অংশ হিসেবেই জানে।

জিনজিয়াং নামকরণের আগে এই ভূখণ্ড মাঞ্চু চীনাদের কাছে হইজিয়াং বা মুসলমানদের ভূখণ্ড হিসেবে পরিচিত ছিল। গত শতকের চল্লিশের দশকে উইঘুররা কিঞ্চিৎ স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করেছিল। ১৯৪৯ সালে তারা পূর্ব তুর্কীস্তান নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু স্বপ্নের দেশ বেশিদিন টেকে নি। ঐ বছরই চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসার পর উইঘুর মুসলিমরা পুনরায় পরাধীন হয়ে যায়। নামে স্বায়ত্তশাসন তৈরি করে কিন্তু সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে চীন সরকারের হাতে। নাম দেয় ‘জিনজিয়াং উইঘুর অটোনমাস রিজিয়ন’।

কমিউনিস্ট সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জিনজিয়াং এর সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করা। তাই তারা ঐ এলাকার উন্নতির জন্য ব্যপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যদিও এসবের কোন সুবিধাই সেখানকার মুসলিমরা ভোগ করতে পারে না। চীনের রাষ্ট্রীয় পত্রিকা চায়না ডেইলির মতে, ২০১৮ সালে জিনজিয়াং এর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চীন সরকার সাত হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

চীনের নিয়ন্ত্রণে আসার পর উইঘুরদের জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ যা এখনও পর্যন্ত চলছে। জিনজিয়াং প্রদেশটির আয়তন চীনের মোট আয়তনের ৬ ভাগের ১ ভাগ হলেও এর জনসংখ্যা চীনের জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ। চীনের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি ও অগ্রগতির ধারা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে উইঘুররা। জিনজিয়াং এর উত্তরাঞ্চলের হানরা ক্রমেই সম্পদশালী হয়ে উঠছে। কিন্তু প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উইঘুররা আগের মতোই দারিদ্র্যে জর্জরিত। উইঘুররা চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশ হিসেবে নিজেদের ভাবতে পারছে না। দিনের পর দিন তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে ক্ষোভ। বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার কিছুটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।

অবিবাহিত উইঘুর মেয়েদের নাম তালিকাভূক্ত করে তাদের দূরবর্তী প্রদেশের কারখানায় পাঠাতে অনেকসময় বাধ্য করা হয়ে থাকে। কোন অভিভাবক এতে রাজি না হলে তাকে, মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হয়। ফলে জরিমানা দেওয়ার ভয়ে উইঘুর অভিভাবকরা তাদের অবিবাহিত মেয়েদের চাকরির জন্য শত শত মাইল দূরের কারখানায় পাঠাতে বাধ্য হন। হান জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দুরবর্তী কোন প্রদেশে চাকরি করে আসা কোন উইঘুর মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয় না উইঘুর যুবকরা। কারণ তাদের কুমারীত্ব বা সতীত্ব নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। ফলে উইঘুর নারীদের নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক সমস্যা।

সাত দশক আগে কমিনিস্ট চীনের সৈন্যরা জিনজিয়াং এ আসার পর থেকে এই ভূখণ্ডের মুসলমানরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অধিকার হারিয়েছে। নানা আইন কানুন ও বিধিবিধান করে সরকার উইঘুরদের ধর্মীয় নিয়ম কানুন সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে চীন সরকার বিভিন্ন মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি বাড়িঘরেও উইঘুরদের উপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করে থাকে। সন্দেহ হলে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বন্দি শিবিরে।

মসজিদের বাইরে সবসময় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন রাখা হয়। সরকারিভাবে মসজিদে ইমাম নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ইমামদের প্রতি নজর রাখা হয়। নামাজের সময় আযান দেওয়া যায় না। জিনজিয়াংকে উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বলা হলেও স্বায়ত্তশাসনের কোন চিহ্নই এখানে নেই। চীন সরকার তাদের ইতিহাস ও কাশগড় নগরীর প্রাচীন ভবনগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। উইঘুর শিশুরা স্কুলে তাদের নিজস্ব  ভাষা ও ধর্ম চর্চা করতে পারে না। স্কুলে কেবল চীনা ভাষাতেই শিক্ষা দেওয়া হয়। হানরা তাদেরকে আবর্জনার মতো গণ্য করে।

জিনজিয়াং এ চীন সরকার অনুসৃত কঠোর নিয়ম নীতির কারণে খুব সামান্য সংখ্যক উইঘুর মুসলমানই হজ্বে যাওয়ার সুযোগ পান। রমযান মাসে উইঘুর সরকারি কর্মচারীরা রোযা রাখতে পারেন না কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কারণে। জুমুআর নামাযের খুতবায় কী বলা হবে সেটাও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আগে থেকে ঠিক করে দেন। ঈদের উৎসব পালন কোরবানির নাম করলেই সর্বনাশ। হাতকড়া পরিয়ে সোজা কারাগারে। এমন পোশাক-পরিচ্ছদ বা সাজসজ্জা করা যাবে না যাতে মুসলিম ঐতিহ্য ফুটে উঠে।

উইঘুরদের প্রাচীন সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত কাশগড় নগরীর অনেক মসজিদ ও ভবন ভেঙে ফেলে সেখানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। নগরীর অনেক এলাকার মুসলমানদের উচ্ছেদ করে কাশগড় থেকে শত মাইল দূরে নির্মিত আবাসিক কমপ্লেক্সে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের কোন অনুমতি নেওয়া কিংবা জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করে নি চীন সরকার।

চীন সরকার এমনভাবে পরিকল্পনা করে এগুচ্ছে যেন তারা কোন অপরাধই করছে না। বিশ্বের কাছে নিজেদেরকে কোনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ রাখছে না। তারা মায়ানমারের মতো সেনা অভিযান করে মুসলিমদের বিতাড়িত করছে না ঠিকই। কিন্তু এমনভাবে চাপ প্রয়োগ করছে যেন নিজেরাই দেশান্তরে বাধ্য হয়। হয়ত এমনদিন শীগ্রই আসবে যেদিন উইঘুররা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে ঘুরে বেড়াবে যাযাবরের মতো এক দেশ থেকে অন্য দেশে।

লেখক- নিশাত সুলতানা 

আরও দেখুন – উইঘুর মুসলিম ও চায়নার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ নিয়ে বাংলা ইনফোটিউবের আলোচনা।   

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *