বিংশ শতকের প্রাক্কালে ইরানে এলোপাথাড়ি রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে ইরানের স্বৈরাচারী শাসক রেজা শাহ পাহলভীর ক্ষমতা কিছুটা দূর্বল হয়ে আসে, পাশাপাশি মজলিশ বা সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালী হতে থাকে। ইরানের সংসদ, বাম নেতা মোসাদ্দেককে ১৯৫১ সালের ২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে। ব্যক্তি হিসেবে পণ্ডিত, বাগ্মী, লেখক, আইনজীবী ও সফল মোসাদ্দেক ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। তিনি ইরানে বেশ কিছু সমাজকল্যাণমূলক কাজ করেন, যেমন— ভূমি সংস্কার, দাস-শ্রমিক প্রথা নিষিদ্ধকরণ, দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ভাতার ব্যবস্থা প্রভৃতি। তবে তিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে দুটি কাজ করেছেন তা হলো রেজা শাহের ক্ষমতা খর্ব করা এবং ইরানের তেল সম্পদের জাতীয়করণ।
তেল সম্পদ জাতীয়করণ করার মাধ্যমে মোসাদ্দেক মধ্যপ্রাচ্য তথা গোটা এশিয়ার সর্ববৃহৎ ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের ঈর্ষানলে পড়ে যান। কারণ ১৯৩৩ সালে ব্রিটেন ইরানের নেতা শাহের সাথে নামমাত্র মূল্যের বিনিময়ে একটি চুক্তির মাধ্যমে ষাট বছরের জন্য ইরানের বিশাল তেল-ভাণ্ডার নিজেদের কব্জায় নিয়েছিল। কিন্তু তেল কোম্পানির জাতীয়করণে ব্রিটেনের স্বার্থ হাসিলে ব্যাঘাত ঘটে। তাই ইরানকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ব্রিটেন ইরান থেকে সকল প্রযুক্তিবিদকে প্রত্যাহার করে এবং ইরানের বিরূদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তোলে। ফলে ইরান ব্যপকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একই সাথে ব্রিটেন মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য শাহকে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। উপরন্তু মোসাদ্দেক ব্রিটেনের সাথে ইরানের কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
কোন উপায়ান্তর না দেখে ব্রিটেন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেককে সরিয়ে শাহকে ক্ষমতায় আসীন করানোর জন্য অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চায়। যুক্তরাষ্ট্রের ততকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান এ প্রস্তাব নাখচ করেন। ব্রিটেনও অত সহজে ইরানের তেলের লোভ সামলাতে রাজি নয়। তাই ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের কাছে পুনরায় একই প্রস্তাব নিয়ে যায়। এবার পরিকল্পনায় ব্রিটেন খানিকটা পরিবর্তন আনে। তারা আইজেনহাওয়ারকে ইরানে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার ভয় দেখায়। আমেরিকা এতে স্বভাবতই ভয় পেয়ে যায়। কেননা ইরানে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ফলে অচিরেই আমেরিকা ইরানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে রাজি হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে শুরু হয়ে যায় মোসাদ্দেককে সরানোর নীল নকশা। ২০১৩ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র এক গোপন নথি প্রকাশিত হলে সেখান থেকে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর বিস্তারিত পরিকল্পনা জানা যায়। দেখা গেছে, মার্কিন কর্তৃপক্ষ এ অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য দশ লক্ষ মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছিল শুধুমাত্র মোসাদ্দেক বিরোধী ও শাহ-পন্থী নেতাকর্মীদের ঘুষ দেওয়ায় জন্য। মোসাদ্দেক সরকারের পদত্যাগকৃত মন্ত্রী জেনারেল ফাজলুল্লাহ জাহেদিকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাছাই করে তারা। তেহরানের কুখ্যাত ডাকাত শাবান জাফেরিকেও তার দলবল নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ করার জন্য ঘুষ প্রদান করা হয়।
১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে সাইপ্রাসের নিকোশিয়াতে বসে একটি নিখুঁত পরিকল্পনা করা হয়। CIA ও MI-6 পরিকল্পনার নথিপত্র অনুমোদনের জন্য ১৯৫৩ সালের ১০ জুন দুই দেশের কাছে পাঠায়। অনুমোদন পাওয়ার পর গোটা পরিকল্পনার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় সিআইএ এর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের নাতি কারমিট রুজভেল্টের উপর। পরিকল্পনার একটি জরুরি অংশ ছিল শাহকে দিয়ে দুটি ফরমান সই করানো। একটি হলো মোসাদ্দেককে বরখাস্ত করা এবং আরেকটি জেনারেল জাহেদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ প্রদান। কিন্তু শাহ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। তাকে রাজি করানোর জন্য ইউরোপ থেকে তার বোন রাজকুমারী আশরাফ পাহলভীকে তেহরানে আনা হয়। তাতে কাজ না হওয়ায় অবশেষে রুজভেল্ট নিজে শাহের সাথে কথা বলতে যান। তখন শাহ ১৫ আগস্ট ফরমান দুটিতে সই করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৬ আগস্ট শাহ-পন্থী কিছু সেনা মোসাদ্দেককে অপহরণ করবে এবং জেনারেল জাহেদি শাহের অনুমতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করবেন। কিন্তু মোসাদ্দেক সরকার আগে থেকে পরিকল্পনার কিছুটা আঁচ পেয়ে শহরে সেনা মোতায়েন করে। এদিকে মার্কিন ও ব্রিটিশরা ভাবে মোসাদ্দেক বোধ হয় তাদের পরিকল্পিত ছক ধরে ফেলেছেন। তাই শাহ দেশ ছেড়ে বাগদাদে পাড়ি জমান আর সিআইএ জেনারেল জাহেদিকে গোপন আস্তানায় লুকিয়ে রাখে। এদিকে পরিস্থিতি শান্ত দেখে সরকার শহর থেকে সেনাবাহিনী তুলে নেয়। এই সুযোগে রুজভেল্ট ও তার বাহিনী ১৯ তারিখ থেকে আবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে। ভাড়াটে গুণ্ডারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে। সিআইএ জেনারেল জাহেদিকে প্রকাশ্যে এনে প্রধানমন্ত্রী বানায় আর শাহ-পন্থী নেতকর্মীদের সাহায্যে মোসাদ্দেকের বাসভবন জ্বালিয়ে দেয়। তার অনুগামীদের গ্রেপ্তার করা হয়। সেসময় জাহেদিকে গোপনে সিআইএ ৫০ লক্ষ ডলার দেয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিয়ে খুশি রাখার জন্য। সে বছর আমেরিকা ইরানকে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করে। এভাবে পুনরায় আমেরিকা ও ব্রিটেনের সহায়তায় ইরান শাহের কুক্ষিগত হয়।
লেখক- নিশাত সুলতানা
আরও পড়ুন- ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের বৈরি সম্পর্কের ইতিহাস
আরও পড়ুন- সৌদি-মার্কিন বন্ধুত্বের একাল সেকাল
আরও পড়ুন- আমেরিকা-কিউবার সরল গরল সম্পর্ক