১৯৬৭ সালের ৫ জুন ইসরায়েল বিমান হামলার জন্য তৈরি হয়ে যায়। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল আরবদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া। ইসরায়েল আগে থেকে আরবদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গোপন নকশা জোগাড় করেছিল। ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমানের পাইলটদের কাছে মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানের বিমান ঘাঁটির চিত্র সংবলিত বই ছিল।
ইসরায়েলের প্রথম আক্রমণ ছিল মিশরের বিমান ঘাঁটিতে। তখন মিশরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিনাই এর একটি বিমান ঘাঁটিতে বৈঠক করছিলেন। কি ঘটতে চলেছে মিশরের কর্মকর্তারা প্রথমে বুঝতেই পারেন নি। তারা ভেবেছিলেন তাদের নিজেদের কোন গ্রুপ হয়ত বিদ্রোহ করছে। দিনশেষে দেখা গেল জর্ডান ও সিরিয়ার প্রায় অধিকাংশ বিমান ঘাঁটি ধ্বংস করে ইসরায়েল পুরো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। জর্ডান কিছু প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও মিশর প্রথম দিনের পরই বুঝতে পেরেছিল তারা অনেকটাই হেরে গেছে।
ছয় দিনের এ যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের কাছে পরাস্ত হয়। ইসরায়েল মিশরের সিনাই মরুভূমি, গাজা উপত্যকা, সিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। এই প্রথমবারের মতো ইহুদীদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। ইসরায়েলিরা সেখান থেকে বহু ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করে।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুল নাসের পদত্যাগ করেন। কিন্তু প্রবল জনসমর্থনে তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন এবং ১৯৭০ সালে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করেন বিমান বাহিনীর কমান্ডার হাফিজ আল আসাদ। আর জর্ডানের বাদশাহ হুসেইন ক্ষমতায় টিকে ছিলেন ইসরায়েলের সাথে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে জর্ডান ইসরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তি করে।
এ যুদ্ধের পরে আমেরিকা ইসরায়েলকে অন্য দৃষ্টিতে দেখা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে। ইসরায়েলের সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ফরাসী দৈনিক লা মান্ডেকে বলেন যে, নাসের সিনাই পর্বতে যে সেনা মোতায়েন করেছিলেন তা ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ করার জন্য নয়। বরং ইসরায়েলই নিজে থেকে যুদ্ধ করতে চেয়েছিল। ছয় দিনের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দুই সেনা কমান্ডারও এই কথার সত্যতা যাচাই করে বলেন, “সে সময় ইসরায়েল মিশর বা অন্য কোন আরব দেশের পক্ষ থেকে কোন ধরণের হুমকির মুখে ছিল না, বরং ইসরায়েলই ব্যাপক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে যুদ্ধের আয়োজন করছিল।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কাসাগ্রান্ডা রায় মনে করেন, ১৯৬৭ সালের জুন মাসের এ যুদ্ধের ফলে ফিলিস্তিনের অনেক বেশি ভূখণ্ড ইসরায়েলের দখলে চলে যায়। এটা যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদী পরিণাম যা এখনও দুপক্ষের মধ্যকার বৈরিতা বজায় রেখেছে। নাসেরের হামলা চালানো সম্পর্কে তিনি বলেন, “মিশর ইসরায়েলের সঙ্গে কোন যুদ্ধই করতে চায় নি এবং তখন যুদ্ধ করার মতো অবস্থাও তার ছিল না। কারণ, মিশর সে সময় ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আর তিরান প্রণালি বন্ধ করাটা ছিল একটা প্রতীকী পদক্ষেপ মাত্র। কেননা ইসরায়েলের মাত্র দুই শতাংশ বাণিজ্য বিনিময় ঘটতো এই প্রণালি দিয়ে।”
কাসাগ্রান্ডা রায় আরও বলেছেন, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন আব্দুল নাসেরকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি নাসেরকে এই ভরসা দিয়েছিলেন যে, ইসরায়েল হামলার কোন পদক্ষেপ নেবে না। এ কথা শুনে নাসের সীমান্ত থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীবাহিনীকে উঠিয়ে নিতে বলেন। সম্প্রতি মার্কিন সরকার তার গোপন তথ্যাগার থেকে যেসব তথ্য ফাঁস করেছে তা এবং টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসন লাইব্রেরির দলিল-প্রমাণের আলোকে দেখা গেছে, মার্কিন সরকার এটা জানত না যে ইসরায়েল কখন হামলা করবে। তবে হামলা যে করবে এটা ঠিকই জানতো।
১৯৬৭ সালের ৫-১০ জুন যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৪২ নম্বর প্রস্তাবে এই যুদ্ধে অধিকৃত আরব দেশগুলোর সমস্ত অঞ্চলের ওপর দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে ইসরায়েলকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু ইসরায়েল মার্কিন মদদে শুধু এ প্রস্তাবই নয়, তারা এ পর্যন্ত জাতিসংঘের কোন প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করে নি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই জাতিসংঘের এ প্রস্তাব মেনে নিতে ইসরায়েলকে বাধ্য করাতে পারতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থে এটা কখনও করবে না, উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রতি বছর সাড়ে তিন শত কোটি ডলার অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। যদি মার্কিন সরকার এ সাহায্য না দিত তাহলে ইসরায়েলের পক্ষে এ ধরণের আগ্রাসী মনোভাব দেখানো সম্ভব হতো না। যুক্তরাষ্ট্রের এ অনৈতিকতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা মুসলিম বিশ্ব ও অন্যান্য স্বাধীনচেতা ও মুক্তিকামী জনগণের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে।
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি জবরদখল মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত সংকট। মূলত মার্কিন সরকারের অন্ধ সমর্থনের কারণেই ইসরায়েলের দম্ভ ও ঔদ্ধত্য দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একতাই পারে ইসরায়েলের মতো দখলদার দেশকে কোণঠাসা করে রাখা।
লেখক- নিশাত সুলতানা
[তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা ও রেডিও তেহরান]