বিশ্ব

আরব-ইসরায়েল ছয় দিনের যুদ্ধ- প্রথম পর্ব1 min read

জুন ১৮, ২০১৯ 3 min read

author:

আরব-ইসরায়েল ছয় দিনের যুদ্ধ- প্রথম পর্ব1 min read

Reading Time: 3 minutes

মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদীরা একসময় সংঘবদ্ধ হয়ে আলাদা রাষ্ট্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। সে মোতাবেক পশ্চিমা মদদে ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল নামক এক ইহুদী রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু জাতিগত দ্বন্দ্বের কারণে ইসরায়েলকে অন্যান্য আরব দেশগুলো মেনে নিতে পারে নি। মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিনে অনৈতিকভাবে ও জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে ইসরায়েলকে চাপিয়ে দেওয়ার পর থেকে আরব দেশগুলোর সাথে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের যুদ্ধ হয়েছে বেশ কয়েকবার। সেগুলোর মধ্যে ১৯৬৭ সালের জুন মাসের যুদ্ধটি অন্যতম। ইতিহাসে এ যুদ্ধ জুন যুদ্ধ বা তৃতীয় আরব ইসরায়েল যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত মাত্র ছয় দিনের এ যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

এই যুদ্ধের সূত্রপাত সেই ১৯৪৮ সাল থেকে। ইসরায়েল নবগঠিত দেশ হওয়ায় সেনাবাহিনী ততটা শক্তিশালী ছিল না। সেই সময় আইজ্যাক রবিন ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে থাকেন। এ জন্য প্রচুর তরুণ ইসরায়েলিকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়। দেখতে দেখতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দক্ষ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা ১৯৬৭ সাল নাগাদ পরমাণু শক্তি অর্জনের কাছাকাছি চলে যায়। সেনাপ্রধান আইজ্যাক রবিন তখন প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তিনি যেকোন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।

সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাজনৈতিক উত্থান-পতন শুরু হয়। তখন মিশরীয় সেনাবাহিনীর মেজর গামাল আব্দুল নাসেরের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী মিশরের রাজাকে উৎখাত করে। ১৯৫৬ সালে আব্দুল নাসের মিশরের প্রেসিডেন্ট হন। সে বছর তিনি ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের জন্য সুয়েজ খাল বন্ধ করে দেন। কিছুদিন পর মিশর লোহিত সাগরে অবস্থিত আকাবা উপসাগরের তিরান প্রণালিটি বন্ধ করে দেয়। এ পানি পথটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইসরায়েলের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত নতুন বন্দর ‘ই-ইলাত’ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। পূর্বদিকে ইসরায়েলের নৌ যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা ছিল তিরান প্রণালি। এটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ইসরায়েল কার্যত বেশ সমস্যায় পড়ে যায়।

মিশর, সিরিয়া ও জর্ডান মিলে সিনাই উপদ্বীপ, গোলান মালভূমি ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলে হামলা চালানোর জন্য সেনা মোতায়েন করে। ইসরায়েল আন্দাজ করতে পেরেছিল যে আরবের দেশগুলো তাদের আক্রমণ করতে পারে। উভয়পক্ষই আরেকটি যুদ্ধের আভাস পাচ্ছিল। কেননা আরব দেশগুলো ও ইসরায়েলের মধ্যকার বিশ্বাস ও আস্থা কমে গিয়ে ঘৃণার জন্ম নিচ্ছিল। অবিশ্বাস দিনকে দিন চরম রূপ ধারণ করছিল। ১৯৫০-৬০’দশকে ঘটে যাওয়া স্নায়ু যুদ্ধ তাদের সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

যুদ্ধের প্রস্তুতি দুপক্ষই মোটামুটিভাবে নিচ্ছিল। মিশর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে আধুনিক বিমান ব্যবস্থা আনয়ন করে। অন্যদিকে ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা বজায় রেখে আসছিল। ইসরায়েল ১৯৬০’দশকে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের কাছ থেকে যুদ্ধ বিমান ও ট্যাংক কিনে।

কথায় বলে, কিঞ্চিৎ ভুল সাড়াজীবনের আফসোস। মিশর, সিরিয়ার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। মিশর ও সিরিয়া সামরিক শক্তির প্রতি তেমন মনোযোগী ছিল না। তিরান প্রণালি ও সুয়েজ খাল বন্ধ করে গামাল আব্দুল নাসের আরবদের কাছ থেকে যে গৌরব অর্জন করেছিলেন তাতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল কর্তৃক পরাজয়ের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। ইসরায়েল যখন আক্রমণের পূর্ণ পরিকল্পনার ছক আঁকে তখন তিনি প্যান-আরব জাতীয়তাবাদ নিয়ে ব্যস্ত। সেনাবাহিনী তৈরির কথা তাঁর মাথাতেই নেই। এদিকে অভিভাবকহীন সেনাবাহিনী রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। সামরিক অভ্যুত্থানও করে। আরবরা নিজেদের মধ্যে একতার কথা ফলাও করে প্রচার করত। কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের মধ্যে বিভক্তি ছিল স্পষ্ট। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় জর্ডানের বাদশাহ হুসেইন ছিলেন ব্রিটেন ও আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং তাঁর দাদা বাদশাহ আব্দুল্লাহর সাথে ইহুদী গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ যোগাযোগ ছিল।

দুপক্ষের তিক্ততা চরমে গেলে শুরু হয় যুদ্ধ। ১৯৬৭ সালের ১৪ মে ইসরায়েল জানতে পারে মিশরের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। এটা শুনে ইসরায়েলও চুপ করে থাকে নি। তারাও সিনাই উপত্যকা সংলগ্ন তাদের সেনাশক্তি জোরদারের জন্য বেশ কয়েকটি সাঁজোয়া ইউনিট পাঠায়। ইসরায়েল ও মিশরের সীমান্ত তুলনামূলকভাবে অনেকটাই শান্ত ছিল। আসল সংঘাতটি হয়েছিল সিরিয়ার সাথে ইসরায়েলের।

আমেরিকা ইসরায়েলের মিত্রপক্ষ ছিল তাই সবধরণের সহায়তা তারা ইসরায়েলকে দিয়েছিল এবং তারা এটাও জানত যে, আরব একসাথে হলেও ইসরায়েলকে পরাস্ত করতে পারবে না। এদিকে মিশরের বিমানবাহিনী শক্তিশালী হলেও সেনাবাহিনী ছিল দূর্বল।

১৯৬৭ সালের ২ জুন ইসরায়েল আইজ্যাক রবিনের নেতৃত্বে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় এবং তারা রাজনীতিবিদদের আশ্বস্ত করে যে, কোনভাবেই মিশর ইসরায়েলকে পরাস্ত করতে পারবে না। জুন মাসের ৩ তারিখে ইসরায়েলের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মিইর আমিত ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে। সফরের উদ্দেশ্য ছিল যে, ইসরায়েল যদি আরব দেশগুলোতে হামলা চালায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে কোন আপত্তি জানাবে কি না। মার্কিন কর্মকর্তারা মিইর আমিতকে আশ্বস্ত করে জানায় যে, মিশর ইসরায়েলের উপর হামলা করবে এমন তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে তারা এটা জানে যে, যদি যুদ্ধ বাঁধে তবে ইসরায়েল নাসেরের নেতৃত্বাধীন মিসরকে হারাতে সক্ষম হবে। আমেরিকা ইসরায়েলকে যুদ্ধে নামার জন্য সবুজ সংকেত দেয়।

লেখক- নিশাত সুলতানা 

আরও পড়ুন- আরব-ইসরায়েল ছয় দিনের যুদ্ধ – দ্বিতীয় পর্ব

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *