আব্রাহাম লিংকন। পৃথিবীর ইতিহাসে কালজয়ী এক ব্যক্তিত্বের নাম। পৃথিবীতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করেছেন তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আমেরিকার ১৬ তম প্রেসিডেন্ট। ব্যক্তি হিসেবে আব্রাহাম লিংকন ছিলেন একজন জনদরদি ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ও মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি। ছিলেন একজন সুবক্তা ও স্বশিক্ষিত আইন ব্যবসায়ী। তিনিই আমেরিকায় দাসত্বপ্রথা বন্ধ করে দাসদের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু অদৃষ্টের এমন নির্মম পরিহাস যে, সেই আব্রাহাম লিংকন একটি থিয়েটার হলে এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি রাজ্যের হার্ডিন কাউন্টির দক্ষিণ পূর্বে ছোট্ট একটি বাড়িতে ১৮০৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি আব্রাহাম লিংকন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম অঞ্চল থেকে আসা প্রথম প্রেসিডেন্ট। তাঁর বাবা থমাস লিংকন ও মা ন্যান্সি হ্যাঙ্কস পেশায় কৃষক ছিলেন। ১৮৬০ সালে লিংকন রিপাবলিকান দল থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন এবং ১৮৬১ সালে বিপুল ভোটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিলে আব্রাহাম লিংকন ওয়াশিংটনের ফোর্ডস থিয়েটারে ‘আওয়ার আমেরিকান কাজিন’ নামক নাটকের অভিনয় দেখছিলেন। সেখানে অভিনয় করছিলেন জন উইলকিস বুথ নামের একজন অভিনেতা। রাত ১০টা ১৫ মিনিটে হঠাৎই উইলকিস প্রেসিডেন্ট বক্সে ঢুকে আব্রাহাম লিংকনের মাথার পেছনে পিস্তল দিয়ে গুলি করেন। প্রেসিডেন্টকে বাঁচাতে গিয়ে সেনা কর্মকর্তা রাথবন ছুরিকাঘাতের শিকার হন। রাথবনকে ছুরিকাঘাত করে উইলকিস লাফ দিয়ে মঞ্চে ওঠে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরের দিন অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল সকাল ৭ টা ২২ মিনিটে কালজয়ী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। ইলিয়নের স্প্রিংফিল্ডে তাঁকে দাফন করা হয়।
প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়ার পর আব্রাহাম লিংকন প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হলো দাসদের মুক্তি। আর এটা মার্কিন শ্বেতাঙ্গরা সহজভাবে নিতে পারে নি। কারণ তারা চেয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গরা সাড়া জীবন তাদের দাস হয়ে বেঁচে থাকবে। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম অঞ্চলের নাগরিক হয়ে লিংকনের এত বড় সিদ্ধান্ত পূর্ব ও দক্ষিণের মার্কিন নাগরিকরা মেনে নিতে পারেনি। তাই দক্ষিণাঞ্চলীয় ৭টি প্রদেশ মিলে যুক্তরাষ্ট্র ইউনিয়ন ত্যাগ করে ‘কনফেডারেট স্টেট অব আমেরিকা’ গঠন করে। আর এর থেকেই সূত্রপাত ঘটে চরম এক গৃহযুদ্ধের। যুক্তরাষ্ট্র ইউনিয়নের নৌবহরে কনফেডারেটররা আক্রমণ করে।
কিন্তু দক্ষ সামরিক কুশলী লিংকন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কনফেডারেটরদের পরাজিত করেন এবং এর মধ্য দিয়ে ১১ এপ্রিল ১৮৬৮ সালে দীর্ঘ চার বছর যাবত চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলেও বিপদ আর হিংস্র আক্রোশ আব্রাহাম লিংকনের পিছু ছাড়েনি। যুদ্ধ সমাপ্তির ঠিক ৩ দিন পর আততায়ীর হাতে নিহত হন তিনি।
হত্যাকারী বুথের সাথে সেদিন আরো তিনজন সহচর ছিলেন। এর মধ্যে লিউইস পাওয়াল ও ডেভিড হেরোল্ডের দায়িত্ব ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিউয়ার্ডকে হত্যা করা। আর জর্জ এডজার্ডের দায়িত্ব ছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জনসনকে হত্যা করা। তবে তাদের হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
কে ছিলেন এই উইলকিস বুথ? অনেকের মনে হয়ত এই প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে। জন্মগতভাবে উইলকিস দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্রের হলেও তিনি ছিলেন উত্তরের বাসিন্দা। তিনি ছিলেন কনফেডারেটরের একজন কট্টর সমর্থক আর দাসপ্রথার ঘোর বিরোধী। উইলকিস পেশাগত সমস্যার কারণে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। তবে যুদ্ধের শেষ দিকে উইলকিস ও তার ৬ সহযোগী মিলে প্রেসিডেন্টকে অপহরণ করার মাধ্যমে যুদ্ধের মোড় ঘুরাতে চেয়েছিলেন। এজন্য তারা দিনও ঠিক করেছিলেন ২০ মার্চ, ১৮৬৫। কিন্তু সেদিন সৌভাগ্যবশত লিংকন তাঁর কর্মসূচী পরিবর্তন করে ফেলেন। যেখান থেকে আততায়ীরা তাঁকে অপহরণ করবে বলে ঠিক করেছিল সেখানে তিনি উপস্থিত হন নি। ফলে আততায়ীদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এদিকে এ ঘটনার দু’দিন পরেই কনফেডারেটর নেতা রিচমন্ডকে পরাজিত করে ইউনিয়ন। ফলে কনফেডারেটররা দূর্বল হয়ে পড়ে। তাই উইলকিস বুথ তার সঙ্গীদের নিয়ে প্রেসিডেন্টকে হত্যার জন্য করে ছক আঁকেন।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, যখন আব্রাহাম লিংকন গুলিবিদ্ধ হন তার ঠিক কয়েকঘন্টা আগে তিনি আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিস তৈরির জন্য আইন প্রণয়ন করেন। অবশ্য আইন যদি আরো আগেও জারি হতো, তবুও তারা প্রেসিডেন্টের খুন হওয়া আটকাতে পারত না। কেননা তখন সিক্রেট সার্ভিসের কাজ ছিল যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া মূদ্রা জালিয়াতি বন্ধ করা। লিংকনের পর আরো দুইজন প্রেসিডেন্ট খুন হওয়ার পর অবশেষে ১৯০১ সালে সিক্রেট সার্ভিসকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মোতায়েন করা হয়।
নিঃসন্দেহে আব্রাহাম লিংকন সাবেক প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সম্মানিত একজন ছিলেন। তিনি শত প্রতিকূলতার মাঝেও এমন অনেক কাজ মানুষের জন্য করে গিয়েছেন, যা তাঁর আগে কেউ করার সাহস করেননি। তাঁর অর্জনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মরিল অ্যাক্ট সাইন করা, যার ফলে প্রতিটি রাজ্যে কৃষি ও প্রযুক্তি বিষয়ক কলেজ গড়ে তোলা হয়, জাতীয় ব্যাংকিং সিস্টেম, প্যাসিফিক রেলপথ অ্যাক্ট যার মাধ্যমে প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় রেললাইন তৈরির কাজ শুরু হয় প্রভৃতি।