featured বিশ্ব

“অস্ত্র নয়, আলোচনাই সকল সমস্যার সমাধান”: ২০১৯ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ী আবি আহমেদ আলি1 min read

অক্টোবর ২৮, ২০১৯ 3 min read

author:

“অস্ত্র নয়, আলোচনাই সকল সমস্যার সমাধান”: ২০১৯ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ী আবি আহমেদ আলি1 min read

Reading Time: 3 minutes

পাশের দেশ ইরিত্রিয়ার সঙ্গে নিজ দেশ ইথিওপিয়ার দীর্ঘ বিশ বছরের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ইথিওপিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলি। ইরিত্রিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরির পাশাপাশি বর্তমানে ইথিওপিয়ার সাধারণ জনগণের মধ্যে অর্থনীতি আর জীবনমান উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষাও নতুন করে জাগিয়ে তুলেতে পেরেছেন তিনি।

জন্ম  ও পারিবারিক পরিচয়

১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট আবি আহমেদ আলি ইরিত্রিয়ার বিখ্যাত কাফ্ফা প্রদেশের বিশাসা নামক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আহমেদ আলী ছিলেন মুসলমান অরোমু সম্প্রদায়ের লোক। আর মা তিজিন্ডা ওল্ডে ছিলেন খ্রিস্টান আমহারা সম্প্রদায়ের। আহমেদ আলি মোট চারটি বিয়ে করেন। তাদের মধ্যে আবির মা তিজিন্ডা ছিলেন আহমেদ আলির তৃতীয় স্ত্রী।

আবি তাঁর বাবার ত্রয়োদশ সন্তান এবং মায়ের ষষ্ঠ ও কনিষ্ঠ সন্তান। ছোটবেলায় আবি আহমেদের নাম ছিল আবিয়ত। যার অর্থ বিপ্লব। আবির এ নামটি ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়ায় সংঘটিত ডার্গ রিভল্যুশন থেকে নেওয়া।

শিক্ষাজীবন

আবি শিক্ষাজীবন শুরু করেন স্থানীয় এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে সেখান থেকে চলে যান আগারু নামক উপশহরের এক স্কুলে এবং সেখান থেকেই তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। আবি ছাত্র হিসেবে খুব মেধাবী ও বিনয়ী ছিলেন, যা তাঁর পরবর্তী জীবনে সফলতার মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে।

আবির একাডেমিক সার্টিফিকেটের ঝুলি বেশ সমৃদ্ধ। তিনি ২০০১ সালে আদ্দিস আবাবার মাইক্রোলিংক ইনফরমেশন টেকনোলজি কলেজ থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং পরবর্তীতে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব গ্রীনিস থেকে ট্রান্সফরমেশনাল লিডারশীপের উপর এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। বরাবরই পড়াশোনায় আগ্রহী আবি ২০১৩ সালে আদ্দিস আবাবার অ্যাশল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অধীনে লেডস্টার কলেজ অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড লিডারশীপ থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন। সবশেষে তিনি ২০১৭ সালে আদ্দিস আবাবা ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ব্যক্তিজীবন

ইথিওপিয়ান ডিফেন্স ফোর্সে কর্মরত অবস্থায় আবি আহমেদ জিনাস তায়াকিউ নামক এক খ্রিস্টান রমণীকে বিয়ে করেন। ব্যক্তিজীবনে আবি ও জিনাস তিন কন্যা সন্তানের জনক জননী। তবে সম্প্রতি তাঁরা এক পুত্র সন্তানকে দত্তক নিয়েছেন। আবি জন্মসূত্রে মুসলমান হলেও, ব্যক্তিজীবনে যিশুর বাণী ও গসফেলে বিশ্বাস করা একজন পূর্ণ খ্রিস্টান।

বহুভাষী হিসেবেও আবি আহমেদের বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। তিনি ইংরেজ, আফাম, অরুমো, অ্যামারিক ও তিগ্রিনিয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন।

রাজনীতির মাঠে সফলতা

১৯৯১ সালে কিশোর বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া আবি লেফটেন্যান্ট কর্নেলের মতো উচ্চপদেও কাজ করেছেন। মিলিটারি জীবনের পাশাপাশি রাজনীতি নিয়েও তিনি ছিলেন সচেতন। ১৯৯১ সাল থেকেই তিনি আরোমিয়া শাসন করা দল ওডিপির (ওরোমা ডেমোক্রেটিক পার্টি) সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে তিনি সফলতার সাথে ওডিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ইআরডিপির একজন কংগ্রেস সদস্য হিসেবে জায়গা করে নেন।

২০১০ সালে মিলিটারি জীবনের পর্ব শেষ করে তিনি ওডিপি থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় আসার পরে তিনি তার জন্মস্থান “জিম্মা অঞ্চলে” মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে লেগে থাকা দাঙ্গা নিরসনে “রিলিজিয়াস ফোরাম ফর পিস” নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এমন কিছু ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলায় আবি ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিণত হন। ২০১৫ সালে তিনি দ্বিতীয় দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

আন্দোলন ও বিক্ষোভের মুখে ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইথিওপিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাইলেমারিয়াম দেসালজেন পদত্যাগ করলে একই বছরের ২ এপ্রিল আবি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন।

যে কারণে নোবেল জয়

মূলত শান্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় আবি আহমেদের প্রচেষ্টা ও প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ সব পদক্ষেপের জন্য তাকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে।

ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতেও তিনি যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। আবি তার মন্ত্রীসভার অর্ধেক সদস্যপদেই নারী সদস্য নিয়োগ দিয়েছেন। ইথিওপিয়ার প্রথম নারী প্রতিরক্ষামন্ত্রীও এসেছেন তাঁর হাত ধরে। তিনি ইথিওপিয়ায় এমন আরও কিছু বড় ধরণের সংস্কার আনেন যা ছিল উদারনৈতিক।

আবি হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে জেল থেকে মুক্তি দেন এবং বিদেশে আশ্রিত ভিন্ন মতাবলম্বীদের দেশে ফেরার সুযোগ করে দেন। এতে তিনি দল মত নির্বিশেষে সকলের মনে জায়গা করে নেন।

১৯৯৩ সালে ইরিত্রিয়া ইথিওপিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। দেশদুটো লাগোয়া হওয়ায় বিগত বিশ বছর ধরে বাদমে নামক সীমান্তবর্তী অঞ্চলটিকে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে রেষারেষি লেগেই ছিল। এর জের ধরে এ পর্যন্ত ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

এমতাবস্থায় আবি আহমেদ ক্ষমতায় এসে প্রথমেই এ দুই দেশের জটিলতা নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। একইসাথে শুরু করেন নানা অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ।

আবি আহমেদ প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই ইরিত্রিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান আফওয়েরকির সাথে সাক্ষাৎ করেন। আলোচনা করেন দুই দেশের সীমান্ত জটিলতা নিয়ে। দীর্ঘ আলোচনা শেষে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের ৯ জুলাই একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বাদমে অঞ্চলকে ইরিত্রিয়ার হাতে তুলে দেন। ঠিক করা হয়, দুই দেশের মানুষ, পণ্য বা অন্যান্য সেবা আদান প্রদানের উদ্দেশ্য সীমান্ত খুলে দেবে উভয় পক্ষ। অতি চাঞ্চল্যকর এ সিদ্ধান্তে দুই দেশের সম্পর্কের চিত্র আমূল পালটে যায়।

নোবেল কমিটির সভাপতি অ্যানড্রেসেন আবি আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সামাজিক ন্যায় ও ঐক্য স্থাপনে আবি আহমেদের ভূমিকা অতুলনীয়। তাই তাঁকে এ সম্মান জানানো হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে এখনো পুরোপুরি শান্তি না ফিরলেও তার উদ্যোগ শান্তি স্থাপনের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে করেছে নোবেল কমিটি।

তিনি জানান, অনেকে হয়ত ভাবতে পারেন, আবি আহমেদকে তড়িঘড়ি করে পুরষ্কার দেওয়া হয়েছে। আসলে তাঁর এ শুভ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতেই এ পুরষ্কার। অ্যানড্রেসেনের মতে, শুধুমাত্র সামরিক সংঘাত নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নেও জোর দিয়েছেন আবি আহমেদ।

আবি আহমেদ আলি শুধুমাত্র ইরিত্রিয়ার সঙ্গেই সুসম্পর্ক স্থাপন করেন নি, পাশাপাশি অন্য দেশগুলোর সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে দীর্ঘদিনের চলমান সংঘর্ষ নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে ইথিওপিয়াবাসী মনে করেন, মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সামনে আবিকে আরো শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যা তাঁর জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ।

লেখক- নিশাত সুলতানা                                             

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *