আজহারউদ্দীন এবং হ্যান্সি ক্রনিয়ে : যে বিতর্ক থামেনি কখনো 1 min read
Reading Time: 3 minutesদুইজনেই ছিলেন সময়ের সেরা দুই অধিনায়ক। ক্রিকেট বোঝার জন্য তাদের মত অধিনায়ক আর কেউই ছিলেন না সেসময়। ক্লাইভ লয়েড, কপিল দেব আর ইমরান খানের পর ক্রিকেট বিশ্ব আবারো পেয়েছিল সত্যিকারের দুজন অধিনায়ক। মাঠে বা মাঠের বাইরে যারা পারতেন দলকে এক সুতোয় গেঁথে রাখতে। এই দুজনের একজন ভারতের আজহারউদ্দীন। বলা যেতে পারে ভারতীয় ক্রিকেটের আড়ালে থাকা মহানায়ক তিনি। আরেকজন হ্যান্সি ক্রনিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত মুখ। পোলক, ডোনাল্ড, গিবস কিংবা হালের ডি ভিলিয়ার্স, ডু প্লেসি থেকে আরো বেশি আলোচিত ও বিখ্যাত ছিলেন ক্রনিয়ে।
আজহার এবং ক্রনিয়ে। দুজনকেই মনে রাখার মত বেশ কিছু কারণ আছে। দুজনেই জাত অধিনায়ক। মাঠের প্রয়োজন দারুণ মেটাতে পারতেন তারা। আবার দুজনেই বিতর্কের চরম সীমায় গিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে দুজন অভিযুক্ত হয়েছিলেন একইসাথে।
আজহারউদ্দীন হতে পারতেন ভারতের সবচেয়ে পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যান। কি অসাধারণ ব্যাটিংশৈলী তার! কিন্তু বিধিবাম… জড়ালেন ফিক্সিং বিতর্কে।
ঘটনার শুরু ২০০০ সালে। ৭ এপ্রিল দিল্লি পুলিশের সন্দেহ আর তদন্তে বেরিয়ে আসে জুয়াড়ি সঞ্জয় চাওলা আর হ্যান্সি ক্রনিয়ের কথোপকথন। পরবর্তীতে এক বিবৃতিতে ক্রনিয়ে জানান, ১৯৯৬ সালে ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্টের তৃতীয় দিন শেষে আমি আজহারের ফোন পাই। তিনি আমাকে সন্ধ্যায় রুমে ডাকেন। সেখানে তিনি আমাকে মুকেশ গুপ্তা নামক এক বুকির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে একা রেখে আজহার চলে যান। সিবিআই এর রিপোর্টে নাম আসে ভারতের আরেক ক্রিকেটার অজয় জাদেজারও।
ক্রনিয়ের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল ইংল্যান্ড সফরে। ১৯৯৯–০০ সালের ইংল্যান্ড সিরিজে পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দেন অভিনব এক সিদ্ধান্তে। বৃষ্টির কারণে শেষদিনে খেলা হবার সম্ভাবনা ছিল মাত্র ৪৫ ওভার। দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ছিল ১৫৫ রান। আগের রাতেই দুই অধিনায়ক কথা বলে ঠিক করে ফেলেন যে তারা প্রত্যেকেই এক ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেবেন এবং ৭০ ওভারে ২৫০ রানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে। দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক ক্রনিয়ের কথা মেনে নেন ইংলিশ দলপতি নাসির হুসেইন। বিষয়টা ইংলিশ অধিনায়কের কাছে বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল।
কথামত দক্ষিণ আফ্রিকা ২৪৮ রানে পৌঁছালে ডিক্লেয়ার করে দেন ক্রোনিয়ে। চুক্তিমত পরের দুই ইনিংসও ঘোষণা করে দেয় দুই দল। শেষ ইনিংসে ইংল্যান্ডের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৪৯। দর্শকদের কাছে তখন পুরো টেস্ট একদিকে বেশ মজার আর রোমাঞ্চকর হলেও অন্যদিকে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে বেশ জোরেশোরে।
ম্যাচটা ইংল্যান্ড জিতে নেয় ৫ বল ও ২ উইকেট হাতে রেখে। কিন্তু পরে বোঝা যায় এই অভিনব সিদ্ধান্তের আসল কারণ। জুয়াড়িদের কাছ থেকে ৫০০০ ডলার আর চামড়ার জ্যাকেটের বিনিময়ে এই কাজ করেছিলেন ক্রনিয়ে।
এসব ঘটনা তদন্তের মুখে এক সময় আজীবন নিষিদ্ধ হন এই দুই নক্ষত্র। আজহার এরপর নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন। মাঝে ব্যক্তিগত জীবনে ঝামেলা এসেছে। বিবাহিত জীবনে নতুন ছক কেটেছেন। হারিয়েছেন এক সন্তানকেও। কিন্তু তার জীবনে সুদিনও ফিরে এসেছিল। ২০১২ সালে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় আজহারের। নিজ জেলা আহমেদাবাদ থেকে হয়েছেন সংসদ সদস্য। ভারতের ৫০০ তম টেস্টে পেয়েছেন সংবর্ধনাও। কিন্তু জীবন থেকে ক্ষমা পাননি হ্যান্সি ক্রনিয়ে।
২০০২ সালের ১ জুন জোহানেসবার্গ যাওয়ার পথে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান ক্রনিয়ে। ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় ক্রনিয়ে একটি বেসরকারী কোম্পানিতে কাজ নেন। বেল ইকুইপমেন্ট কোম্পানির অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ভালোবাসার মানুষদের হারিয়ে, ক্রিকেটকে আজীবনের জন্য হারিয়ে। সেদিন কোম্পানির মিটিং শেষ করতে দেরি হয়েছিল, স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে ক্রনিয়ে ছুটেন বিমানবন্দরে। নির্ধারিত বিমান ধরতে না পারায় পরিচিত অ্যাভিয়েশন কোম্পানির হকার সিডেলি এইচএস ৭৪৮ এয়ারক্রাফটে চেপে বসেন তিনি। মেঘের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার আগে বিমানের সবকিছুই ঠিক ছিল। জর্জে বিমানবন্দরের কাছাকাছি জায়গায় কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুই পাইলট আর ক্রনিয়ে ছাড়া আর কেউ ছিলেন না সেই বিমানে। দুই পাইলট আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান কন্ট্রোল প্যানেলটাকে নিজেদের কন্ট্রোলে নিয়ে আসার। বিমান দুর্ঘটনার তদন্তে বেরিয়ে আসে এক সময় বিমানের রেডিও, রিসিভার, হুইল কাজ করেনি, তার মাঝেই জ্বালানী ফুরিয়ে যায়। বিমানবন্দরের উত্তর দিকে আউটেনিকুয়া পর্বতের গায়ে ধাক্কা লেগে ক্রোনিয়ের বিমানটি ধ্বংস হয়।
ক্যারিয়ারে ৫৩ টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছিলেন ক্রনিয়ে। এরমধ্যে জিতেছেন ২৭ টি ম্যাচে। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া সিরিজ জিতেছেন সবার বিপক্ষে। ২০০০ সালে তার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতে ‘আইসিসি নকআউট কাপ‘ এর শিরোপা। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘চোকার‘ নামের ক্ষতের প্রলেপ হিসেবে আজো সেটাই আছে একমাত্র বৈশ্বিক শিরোপা হয়ে।
আজহারউদ্দীন বেঁচে আছেন। হ্যান্সি ক্রনিয়ে হারিয়ে গিয়েছেন। তবু বিতর্ক থামে না। কেন সেদিন আজহার ক্রনিয়ের কাছে জুয়াড়িকে নিয়ে গিয়েছিলেন? নাসির হুসেন কি জানতেন কেন এমন চুক্তি নিয়ে তার সামনে এসেছেন ক্রনিয়ে? ক্রিকেটের রং বড় বিচিত্র। সেই রঙের আজহারউদ্দীন আর ক্রনিয়ে বোধকরি একটু বেশিই রঙিন হয়ে গেলেন সবসময়ের জন্যে।