ঝলমলে রৌদ্রের দিন। এমনই এক দিনে আকাশ থেকে ঝুপ করে পড়লো একটা ডায়রি। দেখতে মামুলি মনে হলেও কী ভেবে যেন সেটা তুলেও নিলো ভীষণ বুদ্ধিমান তরুণ লাইট ইয়াগামি।
ক্রমে তার পরিচয় হয় শিনিগামি বা ‘মৃত্যুর দেবতা’ রিউকের সাথে আর জানতে পারে সাধারণ ডায়রির মতো দেখতে এই ‘ডেথ নোট’ এ যার নাম লেখা হবে তারই মৃত্যু অবধারিত। একসময় এই ‘ডেথ নোট’ই তাকে পরিণত করে লোভাতুর, ধূর্ত অপরাধীতে!
বলছিলাম একালের অন্যতম জনপ্রিয় অ্যানিমে সিরিজ ‘ডেথ নোটে’র প্রারম্ভ গল্প। এরকম দুর্ধর্ষ ফ্যান্টাসি, ক্ষুরধার সংলাপ,অনাকাঙ্ক্ষিত সমাপ্তি ও নিখুঁত নির্মাণের অ্যানিমে সংখ্যা মোটেও অল্প নয়। প্রতি বছর লক্ষাধিক অ্যানিমে নির্মিত হচ্ছে শুধু মাত্র ১৩ কোটি জনতার দেশ জাপান থেকে।
কী এই অ্যানিমে?
অ্যানিমে শব্দটা হলো অ্যানিমেশনের সংক্ষিপ্ত রূপ। তবে অ্যানিমে বলতে বর্তমানে শুধু জাপানি ধারার অ্যানিমেশন বা কার্টুনকেই বোঝায়। অনেকে আবার অ্যানিমে আর মাঙ্গাকে গুলিয়ে ফেলেন। মাঙ্গা হচ্ছে স্রেফ ইলাস্ট্রেশন বা গল্প, উপন্যাসের জাপানিজ কমিক রূপ। এই ভুল বোঝাবুঝির কারণটা হচ্ছে অনেক অ্যানিমেই নির্মিত হয়েছে জনপ্রিয় মাঙ্গার উপর ভিত্তি করে।
পথচলার গল্প
অ্যানিমেশন ছবি বলতে গড়গড়িয়ে অনেক নামই মাথায় চলে আসে। এই যেমন ধরুন, Finding Nemo, Toy Story, UP, Frozen, Shrek, Coco, How to train your Dragon… ব্যস ব্যস! ক্ষান্ত দিন। অ্যানিমেটেড ছবির তালিকা দীর্ঘ হলেও এর অধিকাংশই আমেরিকান ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি। তবে জাপানও পিছিয়ে নেই।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমেরিকার কাছাকাছি সময়েই জাপান অ্যানিমের পথে হাঁটা শুরু করে। জাপানি অ্যানিমেশনের ইতিহাসে প্রথম হিসেবে নাম নেয়া যায় ‘কাতশুদো শাশিনে’র। ১৯০৭ সালে প্রকাশিত এই অ্যানিমের নির্মাতা সম্পর্কে কিছু জানা যায় নি। মাত্র তিন সেকেন্ডের সেই অ্যানিমে বর্তমান প্রযুক্তির মতো কোন জাদুর কাঠিতে তৈরি করা হয় নি। মোট পঞ্চাশটি সেলুলয়েড স্ট্রিপের ছবি ফ্রেমে সাজিয়ে, আলো ও গতির কারিকুরিতেই নির্মিত হয় জাপানের সবচেয়ে পুরনো অ্যানিমেটি।
১৯১৭ সালে বাণিজ্যিক পরিসরে শুরু হয় অ্যানিমের যাত্রা। রাজনৈতিক ক্যারিক্যাচারিস্ট ওতেন শিমোকাওয়া ৫ মিনিটের অ্যানিমেটি তৈরি করেন। এর নাম ছিল ‘ ইমোকাওয়া মুকুজো জেনকানবান নো মাকি’। কাছাকাছি সময়ের মধ্যে তিনি আরও চারটি অ্যানিমে নির্মাণ করেন। ওতেন ছাড়াও জুনিচি কৌইচি ও সেন্তারো কিয়াতামাকে অ্যানিমের অন্যতম পথিকৃৎ ধরা হয়।
সময়ের সাথে মেধা আর মননের সম্মিলনে বেশ এগিয়েই চলেছিল অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু ১৯২৩ সালে পরপর দুটি ঘটনা নড়িয়ে দেয় এর ভিত। টোকিওর আট মাত্রার ভূমিকম্পে গুড়িয়ে যায় অনেক অ্যানিমে স্টুডিও। এর সাথে সাথে অ্যানিমে ইন্ডাস্ট্রিকে পাল্লা দিতে আমেরিকায় ‘দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি’ নতুন আঙ্গিকে মাঠে নামে । আমেরিকার বিশাল বাজেট, উন্নত প্রযুক্তির কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জাপান। ফলে টিকে থাকতেই আশ্রয় নেয় রাজনৈতিক প্রচারণা, বিজ্ঞাপনে। অ্যানিমেটেড ছবি প্রায় নির্মাণ হতো না বললেই চলে।
প্রায় দুই দশক থিতিয়ে থাকলেও এর মাঝে ১৯৩৩ সালের প্রথম সবাক অ্যানিমে ‘চিকারাতো অন্না নো ইয়ো নো নাকা’ আশার আলো দেখায়। অস্থির জাপানে তখন অ্যানিমেকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ধরা হতোনা। এর ব্যবহার ছিল রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা বিস্তারেই।
১৯৩৯ সালে অ্যানিমে নির্মাতাদের জন্য সৃজনশীলতার অবারিত দ্বার খুলে দেয় জাপানি চলচ্চিত্র আইন। বিজ্ঞাপন বা ছোট ভিডিও নির্মাণে পটু বিচ্ছিন্ন কোম্পানিগুলো একজোট হয়ে বড় স্টুডিও তৈরি করতে থাকে। ফলে অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হন নির্মাতারা। যার ফল পাওয়া যায় ১৬ মিনিটের ‘কুমো তো চুরিপ্পু’তে। চতুর মাকড়সা আর মিষ্টি লেডিবাগের গল্পের অ্যানিমেটি মুক্তি পায় ১৯৪৩ সালে। এই মাস্টারপিসের বছরই দেখা যায় ৩৭ মিনিটের ফিচার ফিল্ম ‘মোমোতারোস সি ইগল’। দুই বছর পর আসে এর সিকুয়েল মোমোতারোস ডিভাইন সি ওয়ারিয়রস’। জাপানি সেনাবাহিনীর অর্থায়নে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে নির্মিত এই ছবিগুলোর মূল আবেদন ছিল রাজনীতি ও দেশাত্মবোধ জাগরণে।
অ্যানিমের নবজন্ম
উদ্দেশ্য যাই হোক, ‘মোমোতারোস’ এর হাত ধরেই অ্যানিমে নবজন্ম লাভ করে। ১৯৪৮ সালে নতুন পথে যাত্রা আরম্ভ করে জাপানের ডিজনি খ্যাত ‘তোয়েই স্টুডিও’। ১৯৫৬ সালে তারা ‘জাপান অ্যানিমেটেড ফিল্ম স্টুডিও’ কিনে নিলে নতুন নাম হয় ‘তোয়েই অ্যানিমেশন’।
এই স্টুডিওই আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখায় শিল্পীদের। ফলে ১৯৫৮ সালে সাড়ে তের হাজার শিল্পী– কর্মীর সাধনায় জাপানের প্রথম রঙিন অ্যানিমে ‘দ্য টেল অফ দ্য হোয়াইট সারপেন্ট’ তৈরি হয়। ১৯৫৯ সালেও এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে মুক্তি পায় ’ম্যাজিক বয়’। এগুলোর অসামান্য সাফল্য টেক্কা দেয় ডিজনিকে। ১৯৬১ সালে এই দুটি অ্যানিমেকে আমেরিকায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়।
তবে আরও ঘটনা বাকিই ছিল ঘটার। ১৯৬০ সালে জাপানের স্বনামধন্য মাঙ্গা আর্টিস্ট ওসামা তেজুকার ‘মাই সন গোকু’র উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় ‘অ্যালকাজাম দ্য গ্রেট’। নিজের মাঙ্গার অ্যানিমেটেড রূপ দেখে মুগ্ধই হলেন তেজুকা। তাই আটঘাট বেঁধে নিজেই খুলে ফেললেন এক স্টুডিও। তেজুকার ‘মুশি প্রডাকশন’ ই ১৯৬৩ সালে হইচই ফেলে দেয় ‘অ্যাসট্রো বয়’ দিয়ে। তবে প্রথম অ্যানিমে টিভি সিরিজ হলো ১৯৬১ সালের ‘ ওতোগি মাঙ্গা ক্যালেন্ডার’।
সুপারহিরোর লাইন পরিস্কার করেই তেজুকা এগুলেন ছবি নির্মাণে। ১৯৬৫ সালে তাঁর হাত ধরেই এলো ‘Jungle Emperor’ বা ‘Kimba: The White Lion’. সারাবিশ্বে এই কিম্বাই চিনিয়ে দিলো তেজুকাকে।
তোয়েইও অন্যদিকে জন্ম দিতে থাকে অসাধারণ সব অ্যানিমের। One piece, Cyborg, Aladdin, Dragon Ball ইত্যাদির জনক এই স্টুডিও। সাইফাই, একশন জনরাই অ্যানিমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয়। সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখে ‘মেচা’ জনরাও তৈরি হয় ইন্ডাস্ট্রিতে।
রকমফেরের অ্যানিমে
অ্যানিমের প্রকারভেদও আছে অনেক। তবে মূল শ্রেণিবিভাগ করা যায় ৫ ভাগে। বিভিন্ন বয়সের দর্শক, গল্পের ধরণের উপর নির্ভর করেই বিভক্তি।
‘শোনেন’ অ্যানিমের মূল লক্ষ্য ১৫ বছরের নিচের দর্শক। সুপার হিরো ধাঁচের কোন চরিত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় এর কাহিনী। জনপ্রিয় শোনেন অ্যানিমের মধ্যে আছে Attack on the Titan, Naruto, Dragon Ball, One Piece ইত্যাদি। এরপরেই আসে ‘সেইনিনে’র কথা। এই সেইনিন মানে হলো তরুণ অর্থাৎ ১৫–২৪ বছর বয়সী পুরুষ। এই অ্যানিমেগুলো হয় বেশ ভায়োলেন্ট এবং সাইকোলজিকাল বিষয়বস্তু নির্ভর। অন্যদিকে ‘সোজো’ হলো সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার। দশ থেকে আঠার বছরের মেয়েদের ঘিরেই নির্মিত হয় এই অ্যানিমেগুলো। সোজো ধারার মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে Sailor Moon, NANA, Revolutionary Girl Utena ইত্যাদি। রোমান্সে ভরপুর, পূর্ণবয়স্কদের অ্যানিমে হলো ‘জোসেই’। Loveless, Paradise Kiss, Honey and Clover এরকম বহু বিখ্যাত অ্যানিমে আছে এই জনরায়।
তবে ছোটবড় সবার কাছে জনপ্রিয় হলো ‘কোদোমোমুকে’ জনরার অ্যানিমে। কার্টুন ভিত্তিক এই অ্যানিমে শিশুদের জন্যই তৈরি করা হয়। যেমন– Doaremon, Hello Kitty, Heidi, Girl of the Alps প্রভৃতি।
অ্যানিমে ঝড়
নব্বইয়ের দশকে সারাবিশ্ব জয় করে ফেলে অ্যানিমে। এর পেছনে ভূমিকা রাখে ইন্টারনেট,ডিভিডি আর আমেরিকায় অ্যানিমের চাহিদা।
তবে এর পরপরই বেশ কিছু অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয় জাপান। এর প্রভাব পড়ে অ্যানিমের ঘরেও। অক্লান্ত শ্রম দিয়েও এর কলা কুশলীরা লাভের টাকা তুলতে ব্যর্থ হতো। সৃজনশীলতার নিম্নমূল্য দেখে অনেকেই ফিরে যেতে থাকেন। এছাড়া অ্যানিমের বাজারধসে পাইরেসিও বড় এক ভূমিকা রাখে।
মিলেনিয়ামের শুরুতে অনেকে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, অ্যানিমের দুনিয়া খতম। কিন্তু সব আশংকা উড়িয়ে সগৌরবে এগিয়ে চলেছে জাপানি আর্টের দারুণ এই পানকৌড়ি। দুনিয়াজোড়া চাহিদা, ইন্টারনেট স্ট্রিমিং, নেটফ্লিক্সের মতো বড় কোম্পানির অর্থলগ্নি আর সর্বোপরি নিখুঁত শৈলীর জন্যই ঘুরে দাঁড়িয়েছে এই শিল্প।
সাড়া জাগানো যত অ্যানিমে
অ্যানিমের জনপ্রিয়তা যেমন হু হু করে বাড়ছে তেমনি বাড়ছে এর সংখ্যাও। জনপ্রিয় বলে শুধু গুটি কয়ের নাম বলা তাই খানিকটা অবিচারই হবে। তবে সিরিজের মধ্যে Pokemon, Doraemon, Astro Boy, Ghost in the Shell, Death Note, Naruto, Dragon Ball Z, Full Metal Alchemist, Bleach, One Piece উল্লেখযোগ্য। হাল আমলে ‘Attack on Titan’ ও দুনিয়াজোড়া খ্যাতি পেয়েছে।
অন্যদিকে অ্যানিমে চলচ্চিত্রও অনেক এগিয়ে। Grave of the Fireflies, Akira, Your Name, Wind Rises,Ponyo,Kikis service, A silent voice প্রভৃতি জনপ্রিয়তার সাথে সমালোচকদেরও প্রশংসা পেয়েছে।
জনপ্রিয়তার কারণ
অ্যানিমে ভক্তরাই যে শুধু নিত্যনতুন অ্যানিমে সিরিজ, ছবির খোঁজ রাখেন তা কিন্তু না। পিকাচু, ডরেমন, ড্রাগন বল জেড প্রভৃতি তো একেবারে নাদান দর্শকেরও চেনা মুখ।
তবে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, শুধু জাপানে নির্মিত অ্যানিমেশনের কী এমন ক্ষমতা যা পুরো বিশ্বকে মোহিত করেছে? এ ক্ষেত্রে তারা বেশ কিছু টেকনিক মেনে চলেছে। প্রথমত, অ্যানিমে কোন বয়সভিত্তিক দর্শকের জন্য নয়। শিশুদের জন্য যতটা অ্যানিমে, ততটাই অ্যানিমে পূর্ণবয়স্কদের জন্যও। এছাড়া আশির দশকে যৌনাবেদনময় ‘Hentai’ অ্যানিমে তো আছেই পর্ণপ্রেমীদের জন্য!
দ্বিতীয়ত, তাদের কাহিনিবিন্যাস সুসংহত। ২০–৩০ মিনিটের একেক এপিসোডে দর্শক টানার মতো মশলা থাকেই। তাছাড়া সিরিজও হয় ১২–৮৬ পর্বের ভেতর। তবে তাদের নির্মাণে যত্নের ছাপ বেশ গাঢ়– সে কাহিনীতেই হোক বা ইলাস্ট্রেশনে।
তবে আলাদা করে বলতে হবে তাদের সংলাপ ও অরিজিনাল সাউন্ড ট্র্যাকের কথা। বিশ্বাসযোগ্য সাউন্ড তো বটেই শ্রুতিমধুর সঙ্গীতও মেলে অ্যানিমেতে।
কোথায় পাবেন অ্যানিমে?
অ্যানিমে দেখার জন্য বেশ ক’টি স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারতে পারেন। জনপ্রিয় সাইটগুলো হলো– Kissanime, Chia-anime, Animefreak, Funimation ,Gogoanime,9anime ইত্যাদি।
ভবিষ্যৎ আর অ্যানিমে
প্রতি মাসেই এক গণ্ডা অ্যানিমের দেখা মেলে। প্রতিটির মধ্যেই থাকে স্বকীয় ছাপ। শুধু অ্যানিমেটররাই না, এর পাশাপাশি কণ্ঠশিল্পী, আর্টিস্ট, কাহিনীকার, পরিবেশক প্রতিটি মানুষেরই অবদান থাকে এগুলোতে। জাপানি সমাজে তাদের ভীষণ সম্মানের দৃষ্টিতেও দেখা হয়।
মাঙ্গা জাপানি সংস্কৃতির অবিচ্ছদ্য অংশ। ১৯৫২ সালের পর থেকে এই মাঙ্গাকে ঘিরেই এগিয়েছিল অ্যানিমে। এখনও রোমাঞ্চকর মাঙ্গা নির্ভর অ্যানিমে তৈরি হলেও এর বাইরেও ভাবছেন শিল্পীরা। জাপানে গোটা একটা ইন্ডাস্ট্রিই হলো এই অ্যানিমে। প্রতি বছর ২০ বিলিয়নেরও বেশি আয় করে এই খাত। প্রায় ১২০ মিলিয়নের মতো মানুষ অ্যানিমের নিয়মিত দর্শক।