বিশ্ব

অরুণাচলম মুরুগানান্থাম: ভারতের প্যাডম্যান1 min read

জুলাই ৩, ২০১৯ 4 min read

author:

অরুণাচলম মুরুগানান্থাম: ভারতের প্যাডম্যান1 min read

Reading Time: 4 minutes

পৃথিবীতে শুন্য থেকে সফলতার শিখরে ওঠা মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়। কিন্তু সফল আপনি কাকে বলবেন? যিনি নিজের সুখ, বিলাসিতার জন্য অট্টালিকা গড়েছেন তাকে নাকি যিনি মানুষের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাকে? এই বিচারের ভার সম্পূর্ণই আপনার। তবে আজকে আমরা যেই মানুষটির কথা বলবো তিনি টাকা-পয়সায় বিশ্বের সেরা ধনীদের কেউ নন। তিনি ভারতের “প্যাডম্যান”।  তিনি ভারতের সাধারণ মেয়েদের কাছে অতি অল্প মূল্যে স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড পৌঁছে দেয়া অরুণাচলম মুরুগানান্থাম।

১৯৬২ সালে ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশে অতি সাধারণ ও দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অরুণাচলম। প্রাথমিক জীবনে লেখাপড়া করলেও  মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর কারণে  লেখাপড়া ছেড়ে তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। তিনি ৩৬ বছর বয়সে সাধারণ ঘরের এক নারীকে বিয়ে করেন।

স্ত্রী শান্তিকে অরুণাচলম প্রচণ্ড ভালবাসতেন। তাই স্ত্রীর প্রতি তার যত্নটাও বেশি ছিল। কিন্তু একদিন তিনি খেয়াল করলেন শান্তি তার থেকে এক টুকরা নোংরা কাপড় লুকাচ্ছেন। শান্তি কিছুতেই এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু  অরুণাচলম অনেক অনুরোধ করলে শান্তি জানায় এই নোংরা কাপড় তিনি তার মাসিকের সময় ব্যবহার করেন।

এই ঘটনায় হতবাক অরুণাচলম ভাবতে থাকেন, এই ধরনের নোংরা কাপড় দিয়ে তো তিনি মোটর সাইকেলও মুছতে আগ্রহ বোধ করবেন না; অথচ এমন নোংরা ন্যাকড়া কীভাবে নারীরা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে। নারীদের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা ভাবতেই তিনি শিহরিত হয়ে ওঠেন। এর মধ্যে অরুণাচলম তার স্ত্রীর মাধ্যমে জানতে পারেন এই নোংরা ন্যাকড়ার বিকল্প স্যানিটারি ন্যাপকিন বাজারে পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলোর দাম অনেক। দরিদ্র নারীদের পক্ষে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা সম্ভব নয়।

এরপর শুরু হয় অরুণাচলমের “প্যাডম্যান” হওয়ার যুদ্ধ। তিনি চিন্তা করা শুরু করেন, কীভাবে অতি অল্প খরচে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করা সম্ভব। কঠোর পরিশ্রম করে বিভিন্ন উপায়ে জ্ঞান সংগ্রহ করে তিনি সুতির এক ধরনের প্যাড তৈরি করেন। এই প্যাড নারীদের ব্যবহারের উপযোগী কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য তিনি তার স্ত্রী, বোন এবং আশেপাশের নারীদের ব্যবহার করতে দেন। কিন্তু উপমহাদেশে মেয়েদের পিরিয়ড বা সেক্স এডুকেশন এখনো ট্যাবুর মতো। তাই তারা সেই প্যাড ব্যবহার করে কেমন বোধ করছে, সে সম্পর্কে লজ্জায় অরুণাচলমকে কিছুই বলতে চায়না।

কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে, তিনি সিদ্ধান্ত নেন তিনি নিজেই সেই প্যাড ব্যবহার করে পরীক্ষা করবেন। কিন্তু এই সংবাদ গ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে সবাই অরুণাচলমকে পাগল বলা শুরু করে। এই কাজ থেকে অরুণাচলমকে নিভৃত করার জন্য তার স্ত্রী ও মা অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু অরুণাচলম নিজের লক্ষ্য থেকে সরে আসার পাত্র ছিলেন না। সমাজের কাছে মুখ দেখানো কঠিন হয়ে পড়ায় অরুণাচলমের মা ও  স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। অনেকটাই একঘরে হয়ে পড়েন তিনি। এমনকি একপর্যায়ে গ্রাম থেকেও তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

তারপর তিনি বাধ্য হয়ে এক অধ্যাপকের বাড়িতে কাজ নেন। সেখান থেকেই তিনি কম খরচে প্যাড তৈরির বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোনো সংস্থাই তাকে প্যাড তৈরির ব্যাপারে সাহায্য করেনি। পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগেই প্রায় দুই বছরের চেষ্টায় গাছের ছালের মন্ড থেকে তুলা নিয়ে খুবই কম খরচে প্যাড বানাতে সক্ষম হন। প্যাড তৈরি করার পরেই তিনি মনোযোগ দেন এমন একটি যন্ত্র তৈরি করার প্রতি, যে যন্ত্রের মাধ্যমে খুব কম খরচে ও সহজেই প্যাড তৈরি করা সম্ভব হবে। ২০০৬ সালে এসে তিনি যন্ত্রও তৈরি করে ফেলেন। এই যন্ত্র তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ৬৫ হাজার টাকা।

অনেক শ্রমের বিনিময়ে গড়ে তোলা নিজের কারখানায় অরুণাচলম ; Image Credit: youngisthan.in

যন্ত্র দিয়ে প্যাড বানানোয় সময় ও প্যাডের মূল্য অনেক কমে আসে, আর উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে যায়।  তখন এক কোম্পানি অরুণাচলমের সঙ্গে কম খরচে প্যাড তৈরিতে চুক্তিবদ্ধ হয়। এরপর থেকে অরুণাচলমকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সফলতার কথা ছড়িয়ে পড়লে তিনি হারানো সম্মান তো ফিরে পান, সেই সাথে তার সম্মান দ্রুত গতিতে আরো বাড়তে শুরু করে। স্ত্রী-মাসহ এলাকাবাসী গর্বের সাথে অরুণাচলমকে আবার গ্রহণ করে নেয়।

বর্তমানে ভারতের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২৩টি রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে অরুণাচলমের স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির এই যন্ত্র ছড়িয়ে গেছে। আর এতে সাধারণত গ্রামের নারীরাই শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। অরুনাচলম নিজেই তৈরি করেছেন জয়শ্রীনামক ইন্ডাস্ট্রি। এখানে তৈরিকৃত প্যাড বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো ক্রয় করে খুবই কম দামে। অরুণাচলম বিনামূল্যেও নারীদের মাঝে প্যাড বিলি করে থাকেন। তিনি এই মহৎ উদ্যোগ দিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন ভারতের গ্রামে গ্রামে যেমন ছড়িয়ে দিয়েছেন, তেমনি গ্রামের নারীদের প্যাড ব্যবহারের প্রতি সচেতন করতেও সক্ষম হয়েছেন। ভারতের সাধারণ নারীরা প্যাড ব্যবহারে আগের থেকে এখন অধিক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

বর্তমানে অরুনাচলম তার আবিষ্কৃত মেশিন ১০৬ টি দেশে পাঠাবার উদ্যোগ নিয়েছেন। নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে গৃহীত তার কার্যক্রমের সাফল্যকে সাধুবাদ জানিয়ে ভারত সরকার তাকে “পদ্মশ্রী” সম্মানে ভূষিত করেছে। ২০১৪ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের ১০০জন সেরা প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় অরুনাচলমের নাম এসেছিল। ২০১৮ সালে তার জীবনকে কেন্দ্র করে “প্যাডম্যান” নামে একটি চলচ্চিত্র বানানো হয়। এই চলচ্চিত্রে অরুনাচলমের ভূমিকায় অভিনয় করেন অক্ষয় কুমার ।

অক্ষয় কুমার ও টুইংকেল খান্নার সাথে অরুণাচলম;
Image Credit: youngisthan.in

প্রাথমিক জীবনে যেখানে লেখাপড়ারই সুযোগ পাননি, সেখানে অরুনাচলম এখন হার্ভার্ডসহ বিভিন্ন নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে প্রধান অতিথির চেয়ার অলংকৃত করেন। অরুনাচলম আফসোস করে বলেন, “একজন স্বল্পশিক্ষিত মানুষ হয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আমি যদি ইতিবাচকভাবে ভাবতে পারি ও সমাজে অবদান রাখতে পারি, তাহলে উচ্চশিক্ষিতরা প্রকৃতপক্ষে সমাজের জন্য কী করছেন?”।

বিল গেটসের সাথে একই মঞ্চে কথা বলছেন অরুণাচলম; Image Credit: www.youngisthan.in

যারা নতুন কিছু করতে গিয়ে মানুষের সমালোচনার ভয়ে হাল ছেড়ে দেন কিংবা একেবারে শুন্য থেকে বড় স্বপ্ন দেখতে ভয় পান; তাদের জন্য অরুণাচল মমুরুগানান্থাম সত্যি এক অনুপ্রেরণাদাক ব্যক্তিত্ব।

লেখক- আমিনুল ইসলাম, হাসান উজ জামান  

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *