বিশ্ব

অযোধ্যার ঐতিহাসিক রায়1 min read

নভেম্বর ১৭, ২০১৯ 3 min read

author:

অযোধ্যার ঐতিহাসিক রায়1 min read

Reading Time: 3 minutes

ইহুদি এবং মুসলিমদের মধ্যকার জেরুজালেম সংঘাত চলছে বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে। সংঘাতটা কেবল দুটি জাতির মধ্যকার নয় বরং দুটি আলাদা রষ্ট্রেরও। ইহুদিরা দাবি করে জেরুজালেম তাদের পবিত্র স্থান, অন্যদিকে মুসলিমদের কাছেও এই স্থান শত শত বছর ধরে পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। 

সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এক ঐতিহাসিক রায়ের প্রেক্ষিতেই জেরুজালেম প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করলাম। বাবরি মসজিদ, মোঘল স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম এক নিদর্শন যা ১৯৯২ সালে হিন্দু মৌলবাদীরা গুড়িয়ে দিয়েছিলো। গেলো কয়েকদিন আগে একই জায়গায় মন্দির স্থাপনের পক্ষে রায় দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। এই রায় কতোটা যৌক্তিক সে বিষয় নিয়েই আজকে আলোচনা করবো।

মোঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে তাঁর সেনাপতি মীর বাকি’র তত্বাবধানে ১৫২৮ সালে নির্মিত হয়েছিলো বাবরি মসজিদ। কিন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, বাবরি মসজিদ যেখানে নির্মিত হয়েছে ঠিক সেই জায়াগতেই জন্মেছিলেন হিন্দু ধর্মের অবতার ভগবান রাম চন্দ্র। এই নিয়ে মুসলিম এবং হিন্দুদের মধ্যে বিতর্ক চলে আসছে বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে। হিন্দুদের দাবী, এই জায়গায় অবস্থিত রামমন্দির ভেঙেই  এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলো মোঘলরা। ভারতের পুরাতত্ব অধিদফতর বা আর্কিলজিওকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া হিন্দুদের এই দাবীর সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাবরি মসজিদটি অন্য একটি স্থাপনার ভিত্তির উপর নির্মাণ করা হয়েছে। ধাপে ধাপে খননকার্য চালিয়ে ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ আরও কিছু নিদর্শন খুঁজে পায়, যা ইঙ্গিত দেয় যে এই জায়গায় অষ্টম বা দশম শতাব্দীর দিকে হিন্দুরা পূজা আর্চনা করতো।  [তথ্য সূত্র]

১৯ শতকের শুরুর দিকে বাবরি মসজিদ নিয়ে হিন্দু-মুসলিমদের বিতর্ক আদালতে গড়ায়। হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলা এসব মামলার কোন সুরাহা হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে হিন্দু মৌলবাদীরা গোপনে বাবরি মসজিদের ভেতর রামের মূর্তি রেখে আসে। এই ঘটনার পর হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। তৎকালীন নব্য ভারত সরকার দঙ্গা ঠেকাতে মসজিদটি সিলগালা করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। তারপর বাবরি মসজিদে প্রবেশাধিকার চেয়ে হিন্দু এবং মুসলিম উভয়ের পক্ষ থেকে আবারও আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। 

রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৮৬ সালের ১-লা ফেব্রুয়ারি স্থানীয় আদালত সরকারকে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বাবরি মসজিদে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে মুসলিমরা আপিল করলে ১৯৮৯ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এই বিতর্কিত জায়গায় স্থিতিবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দু মৌলবাদীরা বাবরি মসজিদে হামলা চালিয়ে গুড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে গোটা ভারতজুড়ে সহিংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এই দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। তবে মৃতের মিছিলে মুসলিমদের সংখ্যাই ছিলো বেশি। এই ঘটনার ১০ দিন পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। দীর্ঘ ১৭ বছর পর ২০০৯ সালে এই তদন্ত কমিটি আদালতে রিপোর্ট জমা দেয়। 

২০০১ সালে হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ভাঙার এক দশক পূর্তি উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলে আবারও সহিংসতার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় ২০০২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজেপেয়ী দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করার জন্য “অযোধ্যা” সেল নামে একটি বিশেষ সেল গঠন করেন। তারপর বলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু এবং মুসলিম নেতাদের সাথে আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়।  কিন্তু সেই আলোচনা তেমন ফলপ্রসু হয় নি। 

২০০৯ সালে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২.৭৭ একরের ঐ জমিটি তিনভাগে ভাগ করে বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। নির্দেশ অনুযায়ী হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের জন্য মোট দুই ভাগ এবং মুসলিমদের মসজিদ নির্মাণের জন্য এক ভাগ বরাদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু উভয়পক্ষই এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করে। 

দীর্ঘদিন ধরে চলা এই মামলার চূড়ান্ত রায় হয়েছে গত শনিবার (৯ নভেম্বর, ২০১৯)। চুড়ান্ত রায় পড়ে শুনানোর আগে বিচারক উল্লেখ করেন, এই রায় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নয় বরং সঠিক ইতিহাস এবং মাটিখুঁড়ে পাওয়া তত্ত্ব প্রমাণাদির ভিত্তিতেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। রায়ে  বলা হয়, মসজিদটি ফাঁকা জায়গায় নির্মাণ হয়নি। এর নিচে অন্য কাঠামো ছিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার খননের ফলে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে, এতে বোঝা গেছে সেগুলো ইসলামি নয়। চূড়ান্ত রায়ের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হলো- 

বিতর্কিত ২.৭৭ একর জায়গায় মন্দির নির্মান হবে

অযোধ্যাতেই ৫ একর জমি মুসলিমদের মসজিদ নির্মাণের জন্য বরাদ্ধ দেওয়া হবে 

বিতর্কিত এই রায়ে মুসলিমদের পক্ষে “সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড”-এর আইনজীবি জাফরাইব জিলানী অখুশি হলেও সারাদেশে মুসলিমদের সহিংসতা সৃষ্টি না করে বরং শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। রায় ঘোষণার পর থেকে ভারতজুড়ে হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তবে বিতর্কিত এই রায় ঘোষণাকে অনেকেই মোদি সরকারের ঐতিহাসিক বিজয় বলেই আখ্যায়িত করেছেন।

লেখক- মিজানুর রহমান 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *