ইতিহাস

অপারেশন ব্লু স্টার: শিখদের ‘খালিস্তান’ গড়ার স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে রুপ দেয়া এক অভিযান1 min read

অক্টোবর ১৩, ২০২০ 5 min read

author:

অপারেশন ব্লু স্টার: শিখদের ‘খালিস্তান’ গড়ার স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে রুপ দেয়া এক অভিযান1 min read

Reading Time: 5 minutes

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এতে ভারতের পাঞ্জাব এলাকার শিখরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে। হিন্দু ও মুসলিমরা তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র পেল, কিন্তু তারা কিছুই পেল না- সময়ের সাথে সাথে  এমন আফসোসের সুর পুরো শিখ সমাজে বিষ বাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তারা প্রথম দিকে নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র দাবি না করলেও চণ্ডীগড়ের একক দখল (চণ্ডীগড় সেসময় পাঞ্জাব ও হারিয়ানা প্রদেশের সম্মিলিত রাজধানী ছিল), নিজেদের এলাকার পানির বন্টন নিজেদের হাতে নেয়া সহ আরও কিছু দাবি তোলে। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ধর্মের ভিত্তিতে কোন প্রদেশকে বাড়তি ছাড় দিতে রাজি ছিল না। এ কথা পাঠকদের জেনে রাখা দরকার, স্বাধীন ভারতের প্রদেশগুলো ভাগ করা হয়েছিল ভাষার ভিত্তিতে।

উগ্র কিছু শিখ ধর্মীয় নেতা শিখদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র “খালিস্তান” দাবি তোলে এক সময়। এমন দাবির প্রেক্ষিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পুরো পাঞ্জাব জুড়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে থাকে৷ একসময় তারা পাঞ্জাবের অমৃতসরে অবস্থিত শিখদের পবিত্র “স্বর্ণ মন্দির” দখল করে নেয়। এবং সেখান থেকে তাদের জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।

তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আলোচনার মাধ্যমে পাঞ্জাব সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তিনি নির্দেশ দেন, যে কোনভাবে স্বর্ণ মন্দিরকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। আর সেই নির্দেশনার প্রেক্ষিতে স্বর্ণ মন্দিরে ভারতীয় সেনারা একটি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়৷ অভিযানের নাম দেওয়া হয় “অপারেশন ব্লু স্টার”।

খালিস্তান আন্দোলনের নেতা জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে

বিচ্ছিন্নবাদী শিখদের খালিস্তান নামের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবী সম্পর্কে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেস অবগত ছিল। কংগ্রেস ভেবেছিল এমন একজনকে শিখদের নেতা বানাতে হবে যার কথা সকলে মেনে চলবে। তাই শিখ আকালীদের দমানোর জন্য কংগ্রেস জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালেকে নেতা হিসেবে নির্বাচন করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হয়। ভিন্দ্রানওয়ালেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বোঝাতে শুরু করে যে, হিন্দুস্তানে থাকা মানে পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকা। তাদের দরকার খালিস্তান নামের আলাদা রাষ্ট্রের।

নিজের সশস্ত্র অনুসারীর মাঝে ভিন্দ্রানওইয়ালে

ভিন্দ্রানওয়ালে নানা রকম উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান শুরু করে শিখদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে থাকে। সত্তর দশকে খালিস্তান আন্দোলন শুরু হলেও প্রথম দিকে কোন রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার কথা শোনা যেত না। কিন্তু ক্রমে ক্রমে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হতে থাকে। খালিস্তান গঠনের আন্দোলনকে “খালিস্তান মুভমেন্ট” নাম দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সরকারি জায়গাতে আক্রমণ চালাতে থাকে। এমনকি সরকারি অর্থও তারা লুট করতে থাকে৷ ভিন্দ্রানওয়ালে নিজের একটি সশস্ত্র বাহিনীই গড়ে তোলে। তাদের মদদ দিতে থাকে পাকিস্তান। সব মিলিয়ে পাঞ্জাবের পরিবেশের ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটতে থাকে।

১৯৮২ সালে ভিন্দ্রানওয়ালে চক গুরদোয়ারা ছেড়ে প্রথমে স্বর্ণ মন্দির চত্বরের গুরু নানক নিবাসে আশ্রয় নেন। কয়েক মাস পর তিনি তার শিষ্যদের সমেত স্বর্ণ মন্দিরের আকাল তখতে নিজের ঘাঁটি গড়ে তোলেন৷ সে সময় পবিত্র স্থান বিবেচনায় মন্দির চত্বরে পুলিশের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। আর এই নিষেধাজ্ঞাকেই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

বিবিসির সিনিয়র সাংবাদিক সতীশ জেকব বেশ কয়েকবার ভিন্দ্রানওয়ালের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। একদিন স্বর্ণ মন্দিরের ছাদে ভিন্দ্রানওয়ালের সাথে আলাপচারিতার সময় তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সরকার যে কোন সময় তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে৷ যদি সত্যি তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয় তখন তিনি করবেন। ভিন্দ্রানওয়ালে তখন তাকে ছাদ থেকে সামনের দিকে ইশারা করে কৃষির জমি দেখিয়ে বলেছিলেন, ঐ জমির সাত-আট কিলোমিটার পার হলেই পাকিস্তান। সে সীমানা পাড়ি দিয়ে পাকিস্তান চলে যাবে আর সেখান থেকেই আক্রমণ চালাবে।

১৯৮৪ সাল, ১ জুন

বিদ্রোহীদের হাত থেকে মন্দিরকে দখল মুক্ত করায় ছিল  “অপারেশন ব্লু স্টার ” এর মূল উদ্দেশ্য। এর নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল সুন্দরজী, জেনারেল দয়াল আর জেনারেল ব্রার। ১ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত চলে এই অপারেশন।

১৯৮৪ সাল, ৩ জুন

দিনটি ছিল পাঞ্জাবের জন্য অন্য দিন থেকে আলাদা৷ সে দিন পুরো শহরে কারফিউ জারি করা হয়৷ সাংবাদিকদের আগেই শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিরাপত্তার খাতিরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে আর্মি চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল। অপারেশন ব্লু স্টারের জন্য পদাতিক সেনাবাহিনীর ব্যাটালিয়ন, দুই কোম্পানি কমান্ডো, ছয়টি ট্যাংক, দুই কোম্পানি প্যারামিলিটারিও প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। ৩ জুন প্যারামিলিটারি কর্তৃক সর্বপ্রথম পুরো মন্দির চত্বর ঘিরে ফেলা। ভেতর থাকা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আহবান জানানো হয় তারা যেন সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে ও ভেতর থেকে হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে৷

১৯৮৪, ৫ জুন

৫ জুন সকালে অপারেশনের ইনচার্জ মেজর কুলদীপ সিং যে সকল সেনা সদস্যরা অপারেশনে অংশ নিবেন তাদের নিজেই ব্রিফ করেন৷ তিনি সদস্যদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন তারা যেহেতু একটি পবিত্র স্থান দখল মুক্ত করতে যাচ্ছে তাই সকলকে খেয়াল রাখতে হবে মন্দিরের যেন কোন ক্ষয়ক্ষতি না হয়। মৃত্যুর সংখ্যা যত কম হবে ততই মঙ্গল। যদি কোন সেনার সেনার স্বর্ণ মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে আপত্তি থাকে তবে সেটা নির্দ্বিধায় জানাতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের উপর কোন চাপ প্রয়োগ বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবেনা৷

রাত দশটায় শুরু হয় “অপারেশন ব্লু স্টার “। প্রথম আক্রমণ করা হয় মন্দিরের সামনের দিক থেকে। কালো পোশাক পরা প্রথম ব্যাটালিয়নের সৈন্যদের ও প্যারাশুট রেজিমেন্টের কমান্ডোদের উপর নির্দেশ ছিল তারা যেন দ্রুত আকাল তখতের দিকে যায়। সে নির্দেশ অনুযায়ী কমান্ডোরা এগোতেই তাদের উপর স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগ কমান্ডো নিহত হয়।

দশ নম্বর ব্যাটালিয়নের সদস্যরা সিঁড়ির দুদিকে ভিন্দ্রানওয়ালের সঙ্গীদের মেশিনগানগুলো অকেজো করতে পারলেও উল্টোদিক থেকে শুরু হয় প্রচন্ড গুলিবর্ষণ। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এমন শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার পেছনে ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর বহিষ্কৃত সেনা জেনারেল শাহবেগ সিং (উল্লেখ্য, এই শাহবেগ সিং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দিয়েছিলেন)। এমনকি শিখ বিদ্রোহীরা রকেট লঞ্চারও ব্যবহার করেছিল৷ সেনাবাহিনীর সদস্যরা শুরুতে ভাবেননি যে, তাদের এতো শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে।

অপারেশনের পর স্বর্ণ মন্দিরের একাংশ

১৯৮৪ সাল, ৬ জুন

ভোরে ভারতীয় বাহিনীর ট্যাংক থেকে আকাল তখতকে লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। বিস্ফোরণে ইঁটের গাথুনি একের পর এক খসে পড়তে থাকে। বিদ্রোহীদের আশ্রয় নেওয়া ভবন গুলো গোলার আঘাতে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

১৯৮৪ সাল, ৭ জুন

সেনাবাহিনীরা আকাল তখতে তল্লাশি চালাতে প্রবেশ করলে সেখান থেকে তারা ৪২টি মৃতদেহ উদ্ধার করে। সে মৃতদেহ গুলোর মধ্যে ছিল জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে আর জেনারেল শাহবেগ সিং এর মৃতদেহ। তবে পাকিস্তানি মিডিয়া দাবি করে যে ভিন্দ্রানওয়ালে তাদের কাছে আছে ও ৩০ জুন তারা ভিন্দ্রানওয়ালেকে টিভিতে দেখাবে। তবে, ভারতীয় সেনাবাহিনী সে দাবীকে ভিত্তিহীন বলে উড়িদে দেয় এবং জানিয়ে দেয় ভিন্দ্রানওয়ালের মৃতদেহ তারা পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছে।

বিদ্রোহী শিখদের লাশের সারি

১৯৮৪ সাল, ৮ ও ১০ জুন

৮ জুন ভারতীয় সেনাবাহিনী একটি টাওয়ার বেসমেন্ট থেকে ৪ জন শিখকে গেপ্তার করেছিল। ১০ জুন বিকেলে ভারতীয় সেনাবাহিনী “অপারেশনের ব্লু স্টারের সমাপ্তি ঘোষণা করে৷ এই গোটা অপারেশনে ৮৩ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছিলেন ও ২৪৮ জন সেনা গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। বিদ্রোহীদের মধ্যে নিহত হয়েছিল ৪৯২ জন আর দেড় হাজারেরও বেশি শিখকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

 অপারেশন ব্লু স্টার ও অজিত দোভাল

অপারেশন ব্লু স্টারের সফলতার পেছনে ভারতের বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তিনি স্বর্ণ মন্দিরে অবস্থানরত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে নিজেকে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর এজেন্ট বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। বিচ্ছিনতাবাদীরা তাকে বিশ্বাস করে মন্দিরের ভেতর নিয়ে যায়। এই ছদ্মবেশী অজিত দোভাল মন্দিরের ভিতরে অবস্থানরত জঙ্গিদের গতিবিধি সম্পর্কে ভারতীয় সেনাদের অবগত করেন। এই সাহসীকতার জন্য তিনি ভারতের “জেমস বন্ড” নামে খ্যাত।

অভিযানের ফলাফল

“অপারেশন ব্লু স্টার” নিঃসন্দেহে ভারতীয় সেনাদের সফল অপারেশনের মধ্যে একটি। কিন্তু এর ফলস্বরূপ নিজ দুই শিখ দেহরক্ষীর হাতে ৩১ অক্টোবর (১৯৮৪) প্রাণ হারাতে হয়েছিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে৷ তার মৃত্যুতে পুরো ভারত জুড়ে শিখ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সে আন্দোলনে প্রাণ হারাতে হয় আরো অনেক নিরাপরাধ শিখকে। সেসময় রাজীব গান্ধীর একটি উক্তি ব্যাপক সমালোচিত হয়। তিনি শিখ বিরোধী আন্দোলন নিয়ে বলেছিলেন, “বড় গাছ পড়লে মাটি একটু কাপবেই।” তবে বর্তমান শিখরা ভারতের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে মিলেমিশে বসবাস করছে। তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় “তারা ভারতীয় “।

লেখক- পূজা ধর

৪ Comments
  1. Sara Das

    Totally copied from BDNews... I will send a DMCA or take legal action.

  • Narayan Saha

    Totally Wrong Information... Poor Writing. Total Copied. Even no link provided.

  • Leave a comment

    Your email address will not be published. Required fields are marked *